আমার বাংলাদেশঃ মেধার জয় হোক- ফুযায়েল আহমাদ নাজমুল

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ০৩ ২০১৮, ১২:১৯

একুশে জার্নাল মতামত: বাংলাদেশ কি সত্যিই একটি স্বাধীন দেশ? যে দেশে স্বাধীনভাবে কথা বলা যাচ্ছে না, স্বাধীনভাবে লিখা যাচ্ছে না, জাতির বিবেক সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে পারছেন না, একটি যৌক্তিক দাবী উত্থাপন করা যাচ্ছে না, ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন করতে দেয়া হচ্ছে না, বিচারকদের স্বাধীনভাবে বিচারকাজ করতে দেয়া হচ্ছে না, সে দেশকে আপনি স্বাধীন বলবেন? সে দেশেকে গনতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে স্বীকার করা যাবে? বলতে গেলে রাষ্ট্র, মানবতা ও স্বাধীনতা আওয়ামী শক্তির কাছে আজ অসহায়। যখন সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি আন্দোলনকেও দমন করার অপচেষ্টা করা হয় দলীয় ক্যাডার বাহিনী দিয়ে তখন বলতে হবে বাংলাদেশে আজ গনতন্ত্র নেই। স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। নেত্রীকে গনতন্ত্রের মানসকন্যা বলে আওয়ামীলীগের ভাইবোনেরা যে শ্লোগান দেন আসলে তা ভন্ডামী ও প্রতারণা ছাড়া আর কিছু নয়।

সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। এ দাবীর সাথে রাজনৈতিক নুন্যতম কোন সংশ্লিষ্টতা আমরা দেখছি না। দেশের সচেতন মহল মনে করেন তাদের এ দাবী সম্পূর্ণ যৌক্তিক ও অরাজনৈতিক। এদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও বারবার বলে আসছে “কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধে নয়, এ আন্দোলন কাউকে ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য নয়, আবার কাউকে ক্ষমতায় বসানোর জন্যও নয়, এ আন্দোলন ছাত্র সমাজের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলন। আমাদের দাবী মেনে নিলে আমরা ঘরে ফিরে যাব”

আওয়ামীলীগ সরকারের দীর্ঘ এই শাসনামলে রাজনৈতিক ছোট বড় অনেক আন্দোলন হয়েছে। সব আন্দোলনই সরকারের পক্ষ থেকে হোক আর আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে হোক কমবেশি জ্বালাও পোড়াও এর মধ্যদিয়ে হয়েছে। তাতে দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। সরকারও বিশ্ব মোড়লদের কাছে নালিশ করেছে যে, বিরোধীদল দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার জন্য আন্দোলনের নামে জ্বালাও পোড়াও করছে। নানা কারণে একপর্যায়ে বিরোধীদলও কঠিন আন্দোলনের পথ থেকে সরে এসেছে। যাই হোক, এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল। রাজনৈতিক বক্তব্য ছিল। আমার কথা হচ্ছে, সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে। এ আন্দোলনের দাবীর সাথে রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সবার স্বার্থ জড়িত। মেধার ভিত্তিতে চাকরি হলে ছাত্ররা ভাল রেজাল্ট করার জন্য মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করবে। একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে মেধার লড়াইয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাবে। এ দাবী মেনে নিলে সরকারের কোন ক্ষতি নেই। এ দাবী মেনে নিলে সর্বমহলে সরকারের প্রসংশা হবে। নিশ্চিত এ দাবী দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এতো সুন্দর ও যৌক্তিক একটি দাবী নিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের ওপর সরকার ভীষণ ক্ষেপেছে। আমরা দেখলাম গত ৩০ জুন, শনিবার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরদের পূর্ব ঘোষিত সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যে হামলা চালায় ছাত্রলীগ। এসময় তারা কোটা আন্দোলনকারীদেরকে মারধর করে। অান্দোলনের আহ্বায়ক নুরুল হক নুর সহ বেশ কয়েকজন আহত হন। নুরুল হক নুরকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও রাত আড়াইটার দিকে নুর -কে প্রশাসনের নির্দেশে হাসপাতাল থেকে বের করে দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ!

ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে আবার ১জুলাই রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সারাদেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন এবং অবরোধের ঘোষণা দেয় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। কিন্ত সেদিনও কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের সকল জায়গায়ই শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের হামালার শিকার হয়। ছাত্রলীগের ছেলেরা দেশীয় অস্ত্র ও লাঠিসোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিতে হামলা চালায়। তারা অনেক শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করে।

ছাত্রলীগ কেন শান্তিপূর্ণ এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলো? এ আন্দোলনে ছাত্রলীগের এতো মাথা ব্যাথা কেন? এ দাবী বাস্তবায়ন হলে তাদের স্বার্থে কি আঘাত আসবে? না, তারা সবাই কি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে অত্যন্ত কৌশলে ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটার তালিকায় স্থান করে নিয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আজ খুজে বের করতে হবে।

সরকারের নির্দেশে তার দলীয় ক্যাডাররা দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আন্দোলনরত সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর আক্রমণ করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের শারীরিকভাবে আহত ও লাঞ্ছিত করেছে যা অত্যন্ত অমানবিক, নিন্দনীয়, বেআইনি এবং সংবিধান প্রদত্ত নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। যৌক্তিক দাবি নিয়ে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা প্রদানের পরিবর্তে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও অহিংস আন্দোলনকে দমনের অপচেষ্টায় ইন্ধন দিচ্ছে, যা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক এবং অসাংবিধানিক।

রাজধানী শাহবাগ থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইনে ছাত্রলীগের এক নেতার করা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে কোটা আন্দোলনের শীর্ষনেতা নেতা মোহাম্মদ রাশেদ খাঁনকে এবং তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে। তাকে কেন রিমান্ডে নেয়া হল? তার কি অপরাধ?

এই আওয়ামীলীগ সরকারের শাসনামলই আমরা বিরোধীদলের রাজনৈতিক বহু নেতাকর্মীর রিমান্ডের গল্প শুনেছি। যে গল্পে রয়েছে সাদাকে কালো আর ন্যায়কে অন্যায় বানিয়ে দেয়ার নির্মম কাহিনী। রয়েছে নির্মম ইতিহাস। আমি আশংকা করছি রাশেদকেও রিমান্ডে নিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায় করা হবে। তাকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে সত্যকে আড়াল করা হবে মিথ্যা দিয়ে। হয়তো তাকে জামাত শিবির নেতা বানিয়ে দেয়া হবে। অথবা বিরোধী রাজনৈতিক কোন দলের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে স্বীকার করানো হবে। অথবা ২০ দলীয় জোটের কাছ থেকে বিশাল অংকের পয়সা নিয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে স্বীকারোক্তি আদায় করা হবে। তখন রাশেদের কিছু করার থাকবে না। আল্লাহ রাশেদকে তার কুদরতি শক্তি দিয়ে হেফাজত করুন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে সরকারি দল আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগ তা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। এহেন পরিস্থিতিতে ছাত্রদল, ছাত্র শিবির, ছাত্র মজলিস সহ সকল রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে দাড়ানো উচিত। ২ জুলাই সোমবার, সুপ্রিম কোর্টের ল’রিপোর্টার্স ফোরামের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলন করে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা, হয়রানি এবং নির্যাতনের ঘটনায় ফ্রী ভাবে আইনী সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের ২০ জন আইনজীবী। এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে হামলাকারীদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে জাতি আজ চরম দুশ্চিন্তায় ভুগছে। যে দেশের মেধাবীদের মুল্যায়ন করা হয় না সে দেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত অন্ধকারের দিকে ধাবিত হবে তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। তাই আসুন, দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে ছাত্র সমাজের ন্যায্য এই দাবীর প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াই। আমার প্রিয় এই বাংলাদেশে মেধার জয় হোক। মেধাবীরা এগিয়ে যাক।