আমাদের হাতেই সংকট উত্তরণের চাবিকাঠি

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ১০ ২০১৮, ১৮:২৪

সৈয়দা শামছুল হুদা:
বাংলাদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায়টা একটু ভিন্ন ধরণের। বিষয়টা এমন না যে, এদেশে ইসলাম সম্পর্কে ধারণা রাখে এমন লোকের সংখ্যা কম। অথবা কুরআন ও হাদীসের বিশুদ্ধ চর্চা এদেশে নেই। ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে এমন লোকের সংখ্যা প্রচুর। রয়েছে অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠান। দ্বীনি মারকাজ। খানকাহ। দরবার শরীফ। রাজনৈতিক দল। তারপরেও কেন যে, ইসলামের প্রকৃত চেতনার বিকাশ এদেশে প্রতিষ্ঠা লাভ করছে না, এদেশে বিজয়ী আদর্শ হিসেবে ইসলামকে চিন্তা করা যাচ্ছে না সেটাই ভাববার বিষয়। বারবার ঘুরে-ফিরে একই চিন্তার লোকজন ক্ষমতায় আসছে। ক্ষমতায় বসছে। ক্ষমতা থেকে সরে যাচ্ছে। কেন এমন হচ্ছে?
আপনি যদি দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতের দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন, লক্ষ কোটি মানুষ এই মেহনতের সাথে জড়িত। বিশ্ব ইজতেমার মুনাজাতে কী পরিমান লোক অংশগ্রহন করে তা ধারণারও বাইরে।
আপনি যদি চরমোনাই অনুসারীদের দিকে তাকান, তাহলে মনে হবে, বাংলাদেশে ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু চিন্তাই করা যায় না। তাদের বার্ষিক মাহফিলগুলো, তাদের বিভিন্ন বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে কী পরিমান লোক হয় তা পরিমান করা কঠিন।
আপনি যদি জামায়াতে ইসলামী চারদলীয় জোট সরকারের সময়কার সমাবেশগুলোর দিকে তাকান বা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সাহেবের একেকটা সমাবেশে উপস্থিতির পরিমান দেখেন তাহলে নিশ্চয় হতবাক হতে বাধ্য হবেন।
আপনি যদি আটরশির বার্ষিক ওরসগুলোতে লোকজনের উপস্থিতি দেখেন তাহলেও আপনি খুবই অবাক হবেন যে, এত মানুষ কোথা থেকে আসলো? এছাড়া এদেশে বিশাল একটি জনগোষ্ঠী আছে যারা নিজেদের আহলে হাদীস নামে পরিচয় দেয়, তাদেরও অনুসারী কম নয়।
মাইজভান্ডারীর ওরসগুলোও দেখেছি। শুধু মানুষ মানুষ। এসব ছাড়াও যদি আপনি সারা বছর বাংলাদেশে যে পরিমান ওয়াজ মাহফিল হয়, সে সমস্ত মাহফিলগুলোতে যে পরিমান মানুষ উপস্থিত হয় সেগুলি যদি চিন্তা করি, তাহলে ভাবতেও কষ্ট হয় যে, এদেশে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে ইসলাম কেন প্রতিষ্ঠিত নয়। প্রতিটি ইসলামী মহাসম্মেলন লোকে লোকারণ্য থাকে। এছাড়া ১২রবিউল আওয়ালের মিছিলগুলো দেখেন, দেখেন শর্ষিণার মাহফিলগুলো, ফুলতলির মাহফিলগুলো দেখেন তাহলে ভাবতেও হিমশিম খাই, এ সমস্ত দরবারগুলোর প্রতিনিধিদের মানুষ কেন জাতীয় সংসদে পাঠায় না! কেন যাদেরকে মানুষ পদচুম্বন করে, সেই লোকগুলোকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যোগ্য মনে করে না!!
আসলে বাংলাদেশের সংকটটা অনেক গভীরে। ছোট ছোট মতভিন্নতার জন্য নতুন নতুন ফেরকা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। আর একে অপরকে গোমরাহ, ইসলাম থেকে খারিজ, বাতিল হিসেবে আখ্যায়িত করছে। পারলে একে অপরকে ধ্বংস করে দেয় এমন অবস্থা। কথায় কথায় ইহুদীদের দালাল, মুরতাদ ঘোষণা করে দিচ্ছে। আবার একসময় দেখা যাচ্ছে তারা একে অপরে কাছাকাছিও আসছে।
বাংলাদেশে ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রেও এমন চিরস্থায়ী বিভাজন তৈরী করে দেওয়া হয়েছে যা মনে হয় দূর হওয়া সম্ভব নয়। আলিয়া, কওমী এই যে, ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভাজন তা ঘুচবে বলে মনে হয় না। অথচ এই দুটি শিক্ষার অনুসারী কিন্তু অনেক।
উপরোক্ত সব ধারা, তরিকা, শিক্ষা ব্যবস্থার পরস্পরের মধ্যে গড়ে উঠেছে বিভেদের মহাপ্রাচীর। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারে না। কোন পরিস্থিতিতেই একসাথে চলার, একসাথে বসার কল্পনাও কেউ করতে পারে না। অথচ এই সবগুলো তরিকা, পন্থা, আদর্শ কাউকেই আপনি ইসলাম থেকে খারিজ বলতে পারবেন না।
বাংলাদেশে একটি বিষয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হয়, এদেশে একেবারেই ইসলাম থেকে খারিজ এমন দলের উপস্থিতি নাই বললেই চলে। তারপরেও আমরা এক হতে পারছি না। এটা বড় দুর্ভাগ্যের বিষয়।
আমরা সকলেই নিজ নিজ নেতার গুণকীর্তন করি, নিজ নিজ আদর্শ, মতবাদ, দল এর অন্ধ অনুসরণ করি, আর সকলেই স্বপ্ন দেখি, দেশে আমরা ইসলাম কায়েম করেই ফেলবো। কিন্তু কেউ কাউকে সহ্য করতে পারি না। ফলে যা হবার তাই হয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় উপরোক্ত দল ও শক্তির কাউকেই কেউ গণনায় নেয় না।
আসলে এর থেকে উত্তরণের ‍উপায় কি? এর কি কোন সমাধান নেই? আমরা কি সারাজীবনই এভাবে অন্যদের দ্বারা ব্যবহৃত হতে থাকবো? আমাদের কোন অংশকে কেউ মাথায় হাত বুলিয়ে তাদের ছায়াতলে আশ্রয় দিয়ে এক পক্ষকে আরেক পক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেই যাবে শাসক গোষ্ঠী ও শাসন প্রত্যাশীরা?
না, এথেকেও উত্তরণের পথ আছে। মুক্তির উপায় আছে। প্রয়োজন শুধু একটু মানসিকতার বিকাশায়নের। ইসলামের মৌলিক উসুল বা নীতিমালার সরাসরি বিরোধী নয় এমন শক্তি সমূহের সাথে আজিমত ও রুখসতের ক্ষেত্রবিশেষে আমলের।
আমরা জাতিগতভাবে খুব অসহনশীল। অসহিষ্ণু। ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আমাদের ধৈর্য খুবই কম। প্রতিক্রিয়াশীলতা আমাদের রক্তে মাংসে। মজ্জাগত। আমরা খুব ক্ষেপে যাই, আবার পরক্ষণে ভুলেও যাই। কিন্তু সময় মতো এক হতে পারি না। এক হয়ে কাজ করতে পারি না।
সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া দুয়েকটি উদাহরন দিলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। ধরুন, ইফা ডিজি শামীম আফজাল। তাকে আমরা সবসময়ই তুলোধুনো করে অভ্যস্ত। সেই লোকটিই ১লা ডিসেম্বর টঙ্গী ইজতেমা মাঠে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতে অনুষ্ঠিত এক টকশোতে এমন কিছু কথা বললেন, যে কারণে গোটা কওমী অঙ্গন তাকে বাহবা দিতে শুরু করলো। তার মানে কেউ আমাদের চিরস্থায়ী শত্রু না।
মাওলানা ইয়াহইয়া মাহমুদ, সব সময়ই তিনি জনাব ফরিদ উদ্দীন মাসউদ সাহেবের পক্ষে থাকেন। তিনিও সেদিন সাদ সাহেবের অন্ধ অনুসারীদের দ্বারা ঘটে যাওয়া অঘটনের বিরুদ্ধে উলামা হযরতদের আহবানে রাস্তায় নেমে আসেন। খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। আমরা খুশি হয়ে যাই। তার মানে তিনিও আমাদের স্থায়ী প্রতিপক্ষ না।
এনায়েতুল্লাহ আব্বাসী। কওমী আলেমদের বিপরীত মতই লালন করেন। সেই তিনি হেফাজতের আন্দোলনের সময় হেফাজতের পক্ষে রাজপথে নেমে আসেন। বড় ভালো লাগে সে দৃশ্য। আল্লামা আহমদ শফী দা.বা. এর পক্ষে হুঙ্কার ছাড়েন। তিনিও আমাদের স্থায়ী শত্রু না।
কিছুদিন পুর্বে সিলেটের ফুলতলীর অনুসারীরা আহলে হাদীস বিরোধী আন্দোলনে কওমীদের পাশে এসে দাঁড়ান। কওমীয়ানরাও খুশি হয়। একসাথে মঞ্চ গরম করে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে সবসময়ই কওমিয়ানদের ঝগড়া লেগেই থাকে।

চারদীয় জোট সরকারের আন্দোলনের সময় শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ, মুফতি ফজলুল হক আমিনী রহ. প্রমুখ মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীদের পাশে দাঁড়িয়ে একসাথে জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। বিজয় ছিনিয়ে এনেছিলেন। তখন পরস্পরে এত দূরত্ব ছিল না। অনেক দূরত্বই ঘুচে গিয়েছিল। যদিও আদর্শগত কিছু মতবিরোধ তখনও ছিল, এখনও আছে। পুর্বেও ছিল।
সবগুলো মতবাদ, আদর্শ আবার একসাথে হয়ে উঠে শাহবাগের নাস্তিকবিরোধী আন্দোলনে হেফাজতের ব্যানারে। সেই ব্যানারে কী জামায়াত, কী মীলাদপন্থী, কী কওমিয়ান, এমন কি সবগুলো রাজনৈতিক দলের ইসলাম অনুসারী মানুষের মিলনমেলা হয়ে উঠে হেফাজত। লংমার্চে এমন জাগরণ হয়, যা ইতিপুর্বে বাংলাদেশে আর কোনদিন দেখা যায় নি।
তাহলে বুঝা গেল, আমরা এদেশে যারা ইসলাম বুকে লালন করি, ধারণ করি, আমরা কেউ কারো চিরস্থায়ী শত্রু না। আমাদেরকে তৃতীয়পক্ষ মাঝে মাঝে বাতাস দিয়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দলটা একটু বেশিই জিইয়ে রাখে। এই ক্ষেত্রে আমাদের মাঝে করণীয় নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার।
এদেশে ইসলামকে বিজয়ী করতে হলে সবগুলো মতের মধ্যে, মতাদর্শের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন বিষয়ে ভিন্নতা সত্ত্বেও কিছু কিছু জায়গায় এক থাকতে হবে। কখনো কখনো একসাথে বসার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। পরস্পরে চরম পর্যায়ের কাদা ছুঁড়াছুড়ি বন্ধ করতে হবে। এক ঘরে পাঁচ ভাই কোনদিন একমতের হয় না। নানা ক্ষোভ-খেদ লেগেই থাকে। কেউ কারো থেকে দোষ কম ধরতে পারে না। মা, বোন, ভাই-ভাবী, দেখেন কী প্রচন্ড রকম যুদ্ধ। মনে হয় এক জন অপরজনকে গোষ্ঠী শুদ্ধ খেয়ে ফেলবে। তারপরেও পরিবার এভাবেই টিকে থাকে। ধ্বংস হয়ে যায় না। ধ্বংস করে দেওয়া হয় না।
এই সবগুলো শক্তি যদি একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়, ভিন্ন মতের প্রতি একটু উদার হয়, কেউ কিছু বললেও সেটা সম্পর্কে ধৈর্য ধারণ করে, তাহলে অনেক সমস্যার খুব সহজ সমাধান হয়ে যায়। মতবিরোধ সত্ত্বেও ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন বড়ত্বের লক্ষণ।
প্রিয় পাঠক, একবার চোখটা বন্ধ করে দেখুন তো, উপরোক্ত শক্তিগুলো যদি বাংলাদেশে কোন একটা বিষয়ে একমত হয়, তারা যদি বলে, আগামী সংসদটা আমরাই চালাবো, তাহলে সম্ভব কি না? আপনার অন্তর কী বলে?
আসলে আমাদেরকে বৃটিশরা এমনভাবে বিভাজিত করে গিয়েছে, আমরা মরে যেতে রাজি, কিন্তু ভাইয়ে ভাইয়ে আপোষ করতে রাজি না। মিলে মিশে চলতে রাজি না। এক ভাই অপরভাইকে প্রাধান্য দিতে রাজি না। প্রয়োজনে আপন ঘরের দায়িত্ব শত্রুর হাতে তুলে দিতে রাজি, ভাইয়ের হাতে না।
যতদিন না এই মনোভাব দূরীভুত না হবে, ততদিন আমরা আসলে মুক্তিও পাবো না। বৃহৎশক্তি হিসেবে কোনদিন প্রকৃত শত্রুকে রুখে দাঁড়াতেও পারবো না। কোন একটি বিষয়ে ভিন্নমত হলেই সে আমার চিরস্থায়ী শত্রু না। সব বিষয়েই সে আমার বিরোধী হবে এমনও না। পাকিস্তানের উলামায়ে কেরাম, ভারতের উলামায়ে কেরাম জামায়াতে ইসলামীর সাথে, বেরলভিদের সাথে বসতে পারে। ধর্মের প্রয়োজনে, রাষ্ট্রের প্রয়োজনে তারা একটেবিলে বসতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের সব দলের মানুষই এতটা পিউর যে, কেউ কারো ছায়া মারাতেও রাজি না।
কেউ যদি কারো সাথে একটু মিশতে চেষ্টা করে, তাহলে তার আর রক্ষা নাই। যে উদারভাবে চলতে চায়, তাকে যে কোন মুল্যে হেয় করা, অপমান করা, তুচ্ছ করাই আমার একমাত্র কর্তব্য। তাকে হেয় করার জন্য কুরআন ও হাদীসের এমন সব দলীল উপস্থাপন করি, যা শত্রুর বিরুদ্ধেও ব্যবহার করি না।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে বুঝার তৌফিক দান করুন। ভিন্নমতের সাথে মিলে মিশে চলার তৌফিক দান করুন। সকল শক্তিকে এককরে, পাশ্চাত্যের সকল ষড়যন্ত্রকে ভেদ করে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দান করুন। আমীন।