আমাদের মহান বিজয় দিবস

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ডিসেম্বর ১৬ ২০১৮, ০৫:৩১

মোজাক্কির আহমেদ নাজু


বিজয় এসেছে অনেক রক্তের বিনিময়ে। অনেক জীবন ও স্বপ্নের বিনিময়ে। অনেক আশা ও সাধনার উচ্ছ্বাসে। বিজয়ের কথা যখন স্মরণ করি তখনই অনুধাবনে আসে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় ছিল এ জাতির চার হাজার বছরের দীর্ঘ ইতিহাসের উজ্জ্বলতম অধ্যায়। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধারা হলেন এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সমুদ্রসৈকতে বালুকারাশির মধ্যে তিল তিল করে যেমন সঞ্চিত হয় মহামূল্যবান রতœভাণ্ডার সমুদ্রের বেলাভূমিতে, সমুদ্রের আকর্ষণে, অসংখ্য স্রোতস্বিনী বাহিত পলি হাজার হাজার বছর সঞ্চিত হয়ে তেমনি সৃষ্টি করে উন্নত জীবনের স্বর্ণদ্বীপ। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, স্বর্ণালী দ্বীপ বাংলাদেশের জন্ম এভাবেই হয়েছে। সৃষ্টির এ প্রক্রিয়ার শুরু কখন তা কেউ জানি না বটে, ইতিহাসবিদদের ধারণায় কিন্তু এ জনপদে মানুষের বসবাস শুরু হয় খ্রিষ্টের জন্মের দুই হাজার বছরেরও আগে। ইতিহাস সাক্ষী, দক্ষিণ এশিয়ার প্রান্তসীমায় অবস্থিত এ জনপদের রাজনৈতিক ভাগ্য প্রায় সব সময় জড়িত ছিল উত্তর-পশ্চিম অথবা মধ্য ভারতের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্যগুলোর সাথে, যদিও এ জনপদ দীর্ঘ দিন কোনো সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সর্বপ্রথম এ জনপদ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয় এবং এর শাসন-প্রশাসনের সার্বিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন এই সন্তানেরা। এ কারণেই একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বিজয় এ জাতির ইতিহাসে উজ্জ্বলতম একটি মাইলফলক। একটি নতুন স্বপ্নের জন্মকাহিনী।

সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার মহান মন্ত্রের উচ্চারণে যেমন ফ্রান্সের রাজনৈতিক আকাশে সূচনা হয়েছিল প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের; সাম্য, স্বাধীনতা এবং স্বাচ্ছন্দ্যের অšে¦ষণের স্বতঃস্ফূর্ত দাবি যেমন আমেরিকার ১৩টি কলোনিকে উদ্বুদ্ধ করেছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে, বাংলাদেশের জনগণও তেমনি সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়পরায়ণতার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররূপে প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আত্মনিবেদন করেন। একাত্তরের ডিসেম্বরে প্রায় অসম্ভব কাজটি সম্ভব হয়েছে জনগণের সাহস, শৌর্য ও সীমাহীন ত্যাগের মাধ্যমে। এ জন্য ডিসেম্বরকে আমরা বিজয়ের মাসরূপে চিহ্নিত করি। একাত্তরের মার্চে যার সূচনা, ডিসেম্বরেই তার চূড়ান্ত পরিণতি। তাই ডিসেম্বর এলেই অনিন্দিত এক অনুভূতির সন্ধান পাই। ডিসেম্বরে পা দিয়েই অনুভব করি পায়ের নিচে শক্ত মাটির স্পর্শ। লাভ করি অনির্বচনীয় আত্মবিশ্বাস। ফিরে পাই এক অনিন্দ্যসুন্দর আত্মশ্লাঘা। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর একটি আঙিনা।

আমি স্বপ্ন দেখি আমার জন্মভূমিকে নিয়ে। স্বপ্ন দেখি এমন এক বাংলাদেশেরÑ যা প্রাণপ্রাচুর্যে ভরা, যুক্তিবাদী মুক্তমনের অধিকারী, হৃদয়বান নাগরিকের বাংলাদেশ। আকাশছোঁয়া আত্মবিশ্বাসে সমৃদ্ধ, সৃজনশীলতায় উদ্দীপ্ত, নিজেদের ভাগ্য গড়ার দৃঢ়প্রত্যয়ে আস্থাশীল নাগরিকের বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশে থাকবে না দারিদ্র্য, থাকবে না অপুষ্টি, ব্যাধি। সমাজ থাকবে দুর্নীতির কলুষমুক্ত, স্বার্থপরতা এবং সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে, আকাশের মতো উদার, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পশূন্য, সব মত-পথ-বিশ্বাসের অবাধ চারণক্ষেত্র। মিলনের তীর্থক্ষেত্র, শহীদ মিনারের মতো। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির কেন্দ্র হয়েও আন্তর্জাতিকতা এবং মানবমুখিতার আদর্শে উদ্বুদ্ধ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের নাগরিকদের এক দিকে যেমন রূপান্তরিত হতে হবে দক্ষ, সুশিক্ষিত, সৃজনশীল মানবসম্পদে, অন্য দিকে তেমনি পরিণত হতে হবে উত্তম ব্যক্তিতে। প্রথম শ্রেণীর ব্যক্তিতে। বিশাল জনসমষ্টির এই দেশটাকে তার ঐতিহাসিক গন্তব্যে উপনীত হতে হলে, বিশেষ করে তার উন্নত সাংস্কৃতিক আবহ সংরক্ষণে সক্ষম হতে হলে বৃহত্তর বৈশ্বিক আরণ্যে সুদৃশ্য এবং স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছোট্ট বাগানের মতো হয়েই বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করতে হবে। মানব উপাদান হিসেবে উন্নত বিশাল জনসমষ্টির এই বাংলাদেশকে আমি দেখি শত সম্ভাবনাময়, প্রগতিশীল, অগ্রগামী, শান্তিপূর্ণ, কল্যাণমুখী, সৃজনশীল এক জনপদরূপে। যে জনপদ হবে বিশ্ব দরবারে একটি দৃষ্টান্ত।

এমন বৃহৎ অর্জনের পরও কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা তা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছি বলে মনে হয়। জাতীয় ঐক্য খণ্ড-ছিন্ন হয়েছে। জাতীয় লক্ষ্যও অস্পষ্ট হয়েছে। জাতীয় সংস্কৃতির প্রাণশক্তি আজ ক্ষয়িষ্ণু। জাতিসত্তার যে অমিত তেজ অসম্ভবের বিন্ধ্যাচল টলিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল, তা যেন চলৎশক্তিহীন ও নিশ্চল। কেন এমন হলো? এ প্রশ্নের উত্তর এই লেখায় নেই। শুধু এটুকু বলতে চাই, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অর্জন বিজয় এ জাতির শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এই অর্জনের তাৎপর্য হলোÑ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে জাতির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ভাবনাকে ধারণ করা এবং অগ্রগতির শত পথকে নির্বিঘœ করে তোলা, যেন কোনো অপরিণামদর্শী চিন্তা ও উচ্চারণ জাতীয় ঐক্যে ভাঙন ধরাতে সক্ষম না হয়। এই অর্জনের মৌল তাৎপর্য হলোÑ এই ঐতিহাসিক বিজয়কে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থপূর্ণ করে তোলা। প্রতি মুহূর্তে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই বিজয় পুরো জাতির বিজয়, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা কোনো দলের বিজয় নয়। এই সত্যের বিকৃতি ঘটানোর স্পর্ধা যেন কারো না হয়। ভাবতে হবে, দেশের কোটি কোটি সন্তানের কথা। তাদের ভাবনা-চিন্তা এবং আশা-আকাক্সক্ষা ধারণ করার কথা। তাদের দুঃখ-বেদনার কথা। তাদের বঞ্চনার কথা। যেভাবে সর্বগ্রাসী ব্যর্থতা আমাদের আড়ষ্ট করে রেখেছে, তার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার কথা। আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ সার্থকভাবে মোকাবেলা করার কথা এবং ভয়হীন একটি সমাজ নির্মাণের কথা।