আখেরী চাহার সম্বা : মা লাহা ওয়ামা আলাইহা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ২৩ ২০১৯, ১৫:৪০

হুসাইন আহমদ মিসবাহ

“আখেরী চাহার সম্বা” আরবী ফার্সি মিশ্রিত যৌগিক শব্দ। আরবী ‘আখেরী’ অর্থ ‘শেষ’ আর ফার্সী ‘চাহার সম্বা’ অর্থ ‘বুধবার’।সুতরাং ‘আখেরী চাহার সম্বা’ অর্থ ‘ শেষ বুধবার’। এই দিনটি নিয়ে আমাদের মাঝেও কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। দিনটির মর্যাদা ও তাৎপর্য নিয়ে কিছু তথ্য প্রচলিত আছে, যার উপর ভিত্তি করে অনেকে দিনটির বিশেষ মর্যাদার দাবী করেন। যার শক্ত কোন ভিত্তি পাওয়া যায়না।

প্রচলিত তথ্য : এই দিনটি নিয়ে যে তথ্য সমাদৃত তার সারাংশ হল, “বিশ্বনবী মুহাম্মদ সা. ইহকালিন জীবনের একেবারে শেষ দিকে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার পর ইন্তেকালের ১৫ দিন পূর্বে ১১ হিজরী সালের সফর মাসের শেষ বুধবার ২৭/২৮ তারিখ সুস্থ হন। ঐদিন নবী সা. গোসল করেন, মসজিদে নববীতে ইমামতি করেন, সাহাবীদের উদ্দেশ্য বিশেষ নসিহত প্রদান করেন। দীর্ঘদিন অসুস্থতার পর রাসুল সা. সুস্থ হওয়ায় সাহাবায়ে কেরাম খুবই আনন্দিত হন এবং বিপুল পরিমাণে আল্লাহর রাস্থায় দান করেন। এই জন্যই দিনটি বিশ্ব মুসলিমের কাছে বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। তাই প্রতি বছর দিনটিকে স্মরণ করা হয়”।

প্রাসঙ্গিক ভাবনা : 

প্রথমত : রাসুলুল্লাহ সা. সফর বা রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে হাদীস শরীফে কোনরূপ সুস্পষ্ট উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই। অগনিত হাদিসে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থতাকালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, ইন্তিকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন দিন, তারিখ বা সময় বলা হয়নি। কবে তাঁর অসুস্থতা শুরু হয়, কতদিন অসুস্থ ছিলেন, কত তারিখে ইন্তেকাল করেন সে বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে।

ক. তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে হাদীসবিদ ও ঐতিহাসিকগণ ঐক্যমতে আসতে পারেন নি। কেউ বলেছেন সফর মাসের শেষ দিকে তাঁর অসুস্থতার শুরু। কেউ বলেছেন তাঁর অসুস্থতার শুরু রবিউল আউওয়াল মাসের শুরু থেকে। দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত তাবিয়ী ঐতিহাসিক ইবনে ইসহাক (১৫১হি/৭৬৮ খ্রি) বলেন, “রাসুলুল্লাহ সা. যে অসুস্থতার উসিলায় ইন্তিকাল করেন, সেই অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষ কয়েক রাত থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে।” (ইবনে হিশাম, আস-সীরাহ আন- নববিয়্যাহ ৪/২৮৯)

খ. কি বার থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কারো মতে শনিবার, কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়।

গ. কয়দিনের অসুস্থতার পরে তিনি ইন্তেকাল করেন, সে বিষয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন, কেউ বলেছেন ১২ দিন, কেউ ১৩ দিন, কেউ বলেছেন ১৪ দিন অসুস্থ থাকার পর রাসুল সা. ইন্তিকাল করেন।

ঘ. তিনি কোন তারিখে ইন্তকাল করেছেন সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছনে ১লা রবিউল আউয়াল, কেউ ২রা রবিউল আউয়াল, এবং কেউ বলেছেন ১২ই রবিউল আউয়াল তিনি ইন্তেকাল করেন।

ঙ. কেউ কোনভাবে বলছেন না যে, অসুস্থতা শুরু হওয়ার পরে মাঝে কোনদিন রাসুল সা. সুস্থ হয়েছিলেন। অসুস্থ অবস্থাতেই, ইন্তিকালের কয়েকদিন আগে তিনি গোসল করেছিলেন বলে সহীহ হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। বুখারী শরীফের হাদীস, আম্মাজান হযরত আয়েশা সিদ্দিকা রা. বলেন, “রাসুলুল্লাহ সা. যখন আমার গৃহে প্রবেশ করলেন এবং তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেল, তখন তিনি বললেন, ‘তোমরা আমার উপরে ৭ মশক পানি ঢাল, যেন আমি আরাম বোধ করে লোকদের নির্দেশনা দিতে পারি’। তখন আমরা এভাবে তাঁর দেহে পানি ঢাললাম। তারপর তিনি মানুষদের নিকট বেরিয়ে গিয়েয়ে তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করলেন এবং তাদেরকে খুৎবা প্রদান করলেন বা ওয়াজ করলেন।” (সহীহ বুখারী ১/৮৩, ৪/১৬১৪, ৫/২১৬০)

এখানে স্পষ্ট যে, রাসুলুল্লাহ সা. তাঁর অসুস্থতার মধ্যেই অসুস্থতা ও জ্বরের প্রকোপ কমানর জন্য এভাবে গোসল করেন, যেন কিছুটা আরাম বোধ করেন এবং মসজিদে গিয়ে সবাইকে প্রয়োজনীয় নসীহত করতে পারেন।

এই গোসল করার ঘটনাটি কত তারিখে বা কি বারে ঘটেছিল তা হাদীসের কোন বর্ণনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়নি। তবে আল্লামা ইবনে হাযার আসকালানী রাহ. সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের অন্যান্য হাদীসের সাথে এই হাদীসের সমন্বয় করে উল্লেখ করেছেন যে, এই গোসলের ঘটনাটি ঘটেছিল ইন্তিকালের আগের বৃহস্পতিবার, অর্থাৎ ইন্তিকালের ৫ দিন আগে (ইবনে হাযার, ফাতহুল বারী ৮/১৪২)। ১২ই রবিউল আউয়াল ইন্তিকাল হলে তা ঘটেছিল ৮ই রবিউল আউয়াল।

উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবার রাসুলুল্লাহ সা. এর সুস্থ হওয়া, গোসল করা এবং এ জন্য সাহাবীগনের আনন্দিত হওয়া ও দান-সদকা করার এ সকল কাহিনীর কোনরূপ ভিত্তি নেই। আল্লাহই ভাল জানেন।

দ্বিতীয়ত : কোন আনন্দের বা দুঃখের ঘটনায় আনন্দিত ও দুঃখিত হওয়া এক কথা, আর প্রতি বছর সেই দিনে আনন্দ বা দুঃখ প্রকাশ করা বা ‘আনন্দ দিবস’ বা ‘শোক দিবস’ উদযাপন করা সম্পূর্ণ অন্য কথা। উভয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।

রাসুলুল্লাহ সা. এর জীবনে অনেক আনন্দের দিন বা মুহূর্ত এসেছে, যখন তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন, শুকরিয়া জ্ঞাপন করেছেন আল্লাহর দরবারে। কোন কোন ঘটনায় তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবীগণও আনন্দিত হয়েছেন ও বিভিন্ন ভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। অপরদিকে নবী সা. কোন ঘটনা বা বিষয়ে মর্মাহত হয়েছেন। এমনকি নবুওয়াতের দশম বছর আম্মাজান খাদিজা রা. ও হুজুরের চাচা আবু তালিব ইন্তেকাল করায় রাসুল সা. চরম ভাবে ব্যাথিত হয়ে সে বছরকে “আমুল হুযন” বা দুঃখের বছর ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু পরের বছর বা পরবর্তী কোন সময়ে সেই দিনগুলি বা মুহূর্তগুলিকে বাৎসরিক ‘আনন্দ দিবস’ কিংবা ‘শোক দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেননি। তাই রাসুলুল্লাহ সা. এর নির্দেশ বা সাহাবীদের কর্ম ছাড়া কোন দিন বা মুহূর্ত পালন করাকে বিশেষ ইবাদত মনে করার কোন সুযোগ নেই।

তৃতীয়ত : শরীয়ত নির্ধারিত কিছু দিন ছাড়া ব্যক্তি কেন্দ্রীক দিবস পালনের কোন রীতি ইসলামে নেই। আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছি যে, প্রত্যেকটি তারিখ ও দিন নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। যদি নবী সা., সাহাবায়ে কেরাম রা. ও পরবর্তী যুগে এসব দিবস পালন করা হত, তাহলে অন্তত দিন-তারিখ নিয়ে মাতানৈক্য হতনা। নবী সা. এর যুগ, সাহাবী রা. এর যুগ, তাবেঈ-তাবে তাবেঈ যুগ ও আয়িম্মায়ে মুজতাহিদিনের যুগে ব্যক্তি কেন্দ্রীক দিবস পালনের কোন রীতি কুরআন, হাদীস বা ইসলামের ইতিহাসে পাওয়া যায়নি।

আল্লাহ আমাদের সকলকে সঠিক তথ্য বুঝার ও তদানুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন।