ঈদুল আযহার তাৎপর্য ও আমল

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ০৪ ২০১৯, ১৪:৪৮

মাওলানা আমিনুর রশিদ

عيد( ঈদ) শব্দটি আরবী ‍। عيد অর্থ হল আনন্দ, উৎসব, পূণরাগমন, পুনরাবৃত্তি, বার বার ফিরে আসা ইত্যাদি। আরবী ভাষাবিদগণ বলেন, আরবী ع،+و+د বর্ণ সমৃদ্ধ ধাতু হতে ঈদ শব্দটি গঠিত। আর الاضحى ( আল-অয্হা) শব্দটি আরবী । এর অর্থ ,কুরবানী করা। প্রতিবৎসরপবিত্র জিলহাজ্ব মাসের নির্দিষ্ট তারিখে, নির্দিষ্ট সময়ে মহান আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট পশু কোরবানীর মাধ্যমে খুশি ও আনন্দ উদযাপন করার দিবসকে ( ঈদুল আযহা) বা কুরবানীর ঈদ বলা হয়। প্রতি বৎসর পর্যায়ক্রমে এই ঈদের পূনরাগমন হয় বলেই একে ঈদ বলে ।

যে কোন জাতি বা সম্প্রদায়ের খুশি – আনন্দের জন্য আছে নির্দিষ্ট দিন বা সময়। তেমনিভাবে আরবের মদিনাবাসীও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আগমনের পুর্বে নির্ধারিত দিনে আনন্দ – উৎসব উদযাপন করত। তারা মিহিরজান ও নওরোজ ( বা নায়মুক) নামে দুইটি দিবসে ক্রিড়া ও উৎসব পালন করত। যেহেতু এই উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত ক্রিড়া, খেলাধুলা ও আনন্দ- উৎসবের আয়োজনের মধ্যে কোন কিছুই ইসলামী বিধান মোতাবেক ছিলনা। তাই রাসুল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় তাশরিফ আনার পর তাদেরকে জিজ্ঞাস করেন, এদিন তোমাদের আনন্দ- উৎসব উদযাপনের কারণ কি? তারা বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এদুইদিন খেলাধূলা ও উৎসব করতাম। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এই দুদিনের বিনিময়ে অন্য দুটি উত্তম দিন দান করেছেন এবং তা হল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা।

 

এব্যাপারে সুনানে আবু দাউদে হযরত আানাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় পৌঁছে দেখতে পান যে, সেখানের অধিবাসীরা বছরে দুদিন ( নায়মুক ও মিহিরজান) খেলাধুলা ও আনন্দ উৎসব করে থাকে। তিনি (রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) জিজ্ঞাস করেন এদুটি দিন কিসের ? তারা বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এদুইদিন খেলাধূলা ও উৎসব করতাম। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ আল্লাহ তায়ালা তোমাদের এই দুদিনের বিনিময়ে অন্য দুটি উত্তম দিনদান করেছেন এবং তা হলঃ কোরবানী ও রোজার ঈদের দিন।

সুত্র: সুনানে আবু দাউদ, খন্ড-02, পৃ:-১৩৯,হাদিস নং-১১৩৫, (ইফা বাংলা)

ঈদুল আযহা মহান আল্লাহর বিশেষ উপহার:

প্রতি বৎসরের ঈদুল আযহা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পক্ষ থেকে মুসলিম উম্মাহর জন্য বিশেষ উপহার। আল্লাহ তায়ালার নৈকট্য লাভের জন্য এইটি বড় একটি মাধ্যম। ঈদুল আযহার দিন কেুরবানী করার চেয়ে অধিক প্রিয় আমল নয়। উম্মুল মোমিনীন হযরত আয়শা রা. বর্ণনা করেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ঈদুল আযহা দিবসে রক্ত প্রবাহিত করন( অর্থ পশু জবেহ করা) ব্যাতিত বণি আদমের জন্য অন্য কোন আমল আল্লাহ তায়ালার দরবারে অধিক প্রিয় নয়।কিয়ামতের দিন কুবানীকৃত পশুকে উহার শিং, লোম ও খুর সহ উপস্থিত করা হবে এবং নেকীর পাল্লায় ওজন করা হবে। আর কুরবানীর পশুর রক্ত মাটিতে পতিত হওয়ার পূর্বেই আল্লাহ তায়ালার দরবারে কবুল হয়ে যায়। সুতারাং এই সমস্ত নেকীর দিকে লক্ষ করে কুরবানী করিয়া সন্তুষ্ট থাক। তিরমিযি- হাদিস নং -১৪৯৩.

ঈদুল আযহার দিনের সুন্নত সমুহ:

প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম রা. পবিত্র ঈদুল আযহার দিনে বিশেষ কিছু আমল করতেনঃ যা মুসলিম উম্মাহর নিকট সুন্নত হিসাবে পরিচিত।

ঈদুল আযহার পালনীয় সুন্নত সমুহ নিম্মে দেওয়া হল।

১.অন্যদিনের তুলনায় সকালে ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। [বায়হাকী, হাদীস নং-৬১২৬]

২.মিসওয়াক করা। [তাবয়ীনুল হাকায়েক-১/৫৩৮]

৩.গোসল করা। [ইবনে মাজাহ, হাদীস নং-১৩১৫]

৪.শরীয়তসম্মত সাজসজ্জা করা। [বুখারী, হাদীস নং-৯৪৮]

৫.সামর্থ অনুপাতে উত্তম পোশাক পরিধান করা। [বুখারী, হাদীস নং-৯৪৮, মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং -৭৫৬০]

৬.সুগন্ধি ব্যবহার করা। [মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং-৭৫৬০]

৭.ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাবার আগে মিষ্টি জাতীয় যেমন খেজুর ইত্যাদি খাওয়া। তবে ঈদুল আযহাতে কিছু না খেয়ে ঈদের নামাযের পর নিজের কুরবানীর গোশত আহার করা উত্তম। [বুখারী, হাদীস নং-৯৫৩, তিরমিজী, হাদীস নং-৫৪২, সুনানে দারেমী, হাদীস নং-১৬০৩]

৮.সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া। [আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৫৭]

৯.ঈদুল ফিতরে ঈদগাতে যাওয়ার পূর্বে সদকায়ে ফিতর আদায় করা। [দারাকুতনী, হাদীস নং-১৬৯৪]

১০.ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করা, বিনা অপরাগতায় মসজিদে আদায় না করা। [বুখারী, হাদীস নং-৯৫৬, আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৫৮]

১১.যে রাস্তায় ঈদগাতে যাবে, সম্ভব হলে ফিরার সময় অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরা। [বুখারী, হাদীস নং-৯৮৬]

১২.পায়ে হেটে যাওয়া। [আবু দাউদ, হাদীস নং-১১৪৩]

১৩.ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাবার সময় আস্তে আস্তে এই তাকবীর পড়তে থাকাঃ

اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ

তবে ঈদুল আযহায় যাবার সময় পথে এ তাকবীর আওয়াজ করে পড়তে থাকবে। [মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদীস নং-১১০৫

 

ঈদের রাতের ফজিলত:

ঈদের দিন যেভাবে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য আনন্দ উপভোগ ও তাঁর নৈকট্য লাভের বিভিন্ন কর্মসুচীর ব্যবস্থা রেখেছেন।, তেমনিভাবে তিনি ঈদের রাতকেও ফজিলতপূর্ন রাত হিসাবে ঘোষণা করেছেন। বান্দা তার আনন্দ উৎসবের মধ্যেও যখন তার প্রভুকে রাত জেগে স্বরণ করবে এবং আপন মালিককে ডাকবে, রাহমানুর রাহিম মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাকে আপন রহমতের ছাদরে ঢেকে রাখবেন। দয়াময় প্রভু ঘোষনা করবেন তার জন্য জান্নাতের সু-সংবাদ। সাথে সাথে বান্দার গোনাহ সমুহ ক্ষমার ঘোষণা তিনি দিতে থাকবেন। এই বিষয়ে হাদিসের কিতাবে অসংখ্য হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

নিম্মে কয়েকটি হাদিস বর্ণনা করা হল।

১.হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে

عن معاذ بن جبل -رضي الله عنه- قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: ((من أحيا الليالي الخمس وجبت له الجنة، ليلة التروية، وليلة عرفة، وليلة النحر،وَلَيْلَة الْفطر وليلة النصف من شعبان .(

 

হযরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যে ব্যাক্তি পাঁচটি রাত (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) জাগ্রত থাকবে তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে। তারবিয়ার রাত( জিলহাজ্ব মাসের আট তারিখের রাত) আরাফাতের রাত, কুরবানীর দিবসের রাত ( ঈদুল আযহার রাত), ঈদুল ফিতরের রাত। সুত্র: আততারগীব ওয়াত তারহীব লিল অসবাহানী, প্রথম খন্ড-২৪৮ পৃষ্ঠা, লিল মুনজেরী ২/৯৮ , হাদিস নং-১৬৫৬

 

২. হযরত আবু উমামা রা. থেকে বর্ণিত

عَنْ أَبِي أُمَامَةَ، عَنْ النَّبِيِّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -، قَالَ:”مَنْ قَامَ لَيْلَتَيْ الْعِيدَيْنِ مُحْتَسِبًا لِلَّهِ، لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوتُ الْقُلُوبُ”

হযরত আবু উমামা রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণণা করেন, যে ব্যাক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত্রে (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) জাগ্রত থাকবে, সে ব্যাক্তির হৃদয় ঐদিন মৃত্যুবরণ করবে না যে দিন হৃদয়গুলো মৃত্যুবরণ করবে। ( অর্থাৎ কিয়ামতের দিন তার কোন ভয় থাকবেনা।)

সুত্র: ইবনে মাজাহ2য় খন্ড, হাদিস নং-১৭৮

৩. হযরত উবাদা বিন সাবিত থেকে বর্ণিত

 

عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «مَنْ صَلَّى لَيْلَةَ الْفِطْرِ وَالْأَضْحَى، لَمْ يَمُتْ قَلْبُهُ يَوْمَ تَمُوتُ الْقُلُوبُ»

হযরত উবাদা বিন সাবিত রা. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণণা করেন, যে ব্যাক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার রাত্রে (ইবাদতের উদ্দেশ্যে) জাগ্রত থাকবে, সে ব্যাক্তির হৃদয় ঐদিন মৃত্যুবরণ করবে না যে দিন হৃদয়গুলো মৃত্যুবরণ করবে। ( অর্থাৎ কিয়ামতের দিন তার কোন ভয় থাকবেনা।)

সুত্রঃআল মুজামুল আওসাত-১/৫৭, হাদীস-১৫৯।

মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে ঈদুল আযহার রাতের ফজিলতপূর্ণ আমল সমুহ ও ঈদের দিনের সুন্নাত সমুহ পালনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ও রাসুল স. সন্তৃষ্টি অর্জনের তাওফিক দান করুন।

 

সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি, লংগদু উপজেলা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা।