হযরত শায়খে বর্ণভী রাহ. : যে ছবি আঁকা যায় না

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ১৬ ২০১৯, ১৭:৪৩

মুফতি মুশাহিদ কাসিমী

বাগানে সুবাস ছড়াতে ফুলের কলি বাগানে আসে এবং ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হয়ে সুবাস ছড়িয়ে হৃদয় রাঙ্গিয়ে এক সময় ঝরে পড়ে। ঘোর অমানিশাকে আলোকিত করতে একটি জ্যোৎস্না ভেসে ওঠে আকাশ বুকে। সমস্ত অন্ধকার দুর করে এক সময় জ্যোৎস্নার কিরণ বিলিন হয়ে যায় এবং তা হারিয়ে যায় দিনের আলোয়। যুগে যুগে সর্ব শক্তিমান আল্লাহ যাদের সীমাহীন ত্যাগ, অনুপম সাধনা ও সাগরসম দ্বীনী জ্ঞান দিয়ে ইলমে ইলাহী ও ইলমে নববীর ময়দানকে আবাদ রেখেছেন, যারা ইছলাহে বাতেনীর বিস্তৃত ময়দানে রাহবার হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন, ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়ে যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে খচিত, যাদের নম্রতা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচার দেখলে মানুষেরা বিমুগ্ধ হয়ে যেত। মরেও যারা মানবহৃদয়ে অমর হয়ে আছেন, চির অমর। যাঁদের নাম শুনলে মানবহৃদয় নুয়ে পড়ে ভক্তি ও শ্রদ্ধায়। নূরানী চেহারায় থাকালেই সগীরাহ গোনাহগুলো বৃষ্টির মত ঝরে যায়। তাদেরই একজন হলেন মুসলিহে উম্মাহ, মুর্শিদে কামিল হযরত লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.।

তিনি ছিলেন অতুলনীয় কর্মদক্ষ ও কর্মতৎপর এক মহান পুরুষ। ছাত্র জীবন ও কর্ম জীবনে অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অবিরাম প্রচেষ্টার বরকতে আল্লাহ তাআলা তাঁকে সম্মানের উচ্চাসনে সমাসীন করেছিলেন। নিজেকে তিনি একজন প্রকৃত নায়েবে রাসূল (সা:) রূপে গড়ে তুলে ছিলেন। যার কথা-বার্তা, চাল-চলন ও কর্ম পদ্ধতি দেখলে আল্লাহ, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবা রাযিআল্লাহু তাআলা আনহুদের কথা মনে পড়ত। দ্বীনের খেদমতে তিনি ছিলেন এক নিবেদিত প্রাণ ও মহান ব্যক্তিত্ব। মানুষের প্রতিটি কাজ কর্ম সুন্নত মোতাবেক হোক এটাই ছিল তাঁর সাধনার লক্ষ্য। এই মহামনীষী ১৯১৬ ইংরেজীতে কোন এক সোমবার ছোবহে ছাদিকের শুভলগ্নে ছায়া ঢাকা সবুজ-শ্যামল ঐতিহ্যবাহী বরুণা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন, এ যেন প্রকৃতির কোলে সূর্যোদয়। বরুণা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছেন বলেই তাকে “শায়খে বর্ণভী” বলা হয়। তার মরহুম পিতা মুন্সী হামিদ উল্লাহ রহ.-এর দিকে সম্বন্ধ করে তাকে ‘হামিদী’ বলা হয়। গাজী শেখ বুরহান উদ্দীন রহ.-এর বংশধর হওয়ায় তাদের নামের শুরুতে শেখ উপাধি ব্যবহার করা হয়।

আমীরে হেফাজত শায়খুল হাদীস হযরতুল আল্লাম খলিলুর রহমান হামিদী দা.বা.-এর বর্ণনায় “আমাদের আব্বা সাহেব রূপে গুনে বাংলাদেশের একজন মহা মানুষ হিসাবে গণ্য ছিলেন। চেহারা ছিল উজ্জ্বল নূরানী, সভা সমিতিতে যোগদান করলে পূর্বেকার ওলীগনের মত সামান্য বয়ানেই হেদায়তের আছর (প্রভাব) চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ত। দেখার বেলা যেমন একজন বাদশাহের মত মনে হত। ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধের সময় একজন বীর সৈনিক, সেনাপতির মত কাজ করে যেতেন। সারাটি জীবন দোয়া-জিকির এবং তালীমের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। দোয়া এবং জিকিরের মধ্যে এমন আছর ছিল যে, মানুষ প্রজাপতির মত দোআতে এসে শামিল হত এবং পথহারা অনেকেই পথের সন্ধান পেয়ে নববী আদর্শে নিজেকে পরিচালনা করার শপথ গ্রহণ করত। আর এজন্যই আলেমগণ হযরতকে ‘কুতবে জামান’ তথা যুগের ওলী উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন।

শায়খে বর্ণভী রহ. জন্মসূত্রে শেখ বুরহান উদ্দীন রহ.-এর উত্তর পুরুষ, ফার্সিপন্ডিত শেখ মুন্সী মোহাম্মদ হামিদ উল্লাহ সাহেব ও আরবী শিক্ষিতা মহিয়সী নারী আমিনা খাতুনের আদরের দুলাল, স্নেহাস্পদ পুত্র, তাহাজ্জুদ গোজার একটি সম্ভ্রান্ত আদর্শ পরিবারের উজ্জ্বল নক্ষত্র, হেদায়াতি সূর্য।
সেই সূর্যের চার পাশে গাঢ় কালো
অগুনতি মেঘের আনাগোনা;
যেন তারা কোটি আধার আত্মা
খুঁজে ফেরে আলোর কণা ।
হযরত বর্ণভী রহ.) প্রাথমিক শিক্ষা মাতা-পিতার তত্ত্বাবধানে লাভের পর কুরআন-হাদিসের উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য ১৩৩৬ বাংলার প্লাবনের পর আসাম প্রদেশের অন্যতম মাদ্রাসা জামেউল উলুম গাছবাড়ীতে ছাফেলা চাহারম অর্থাৎ নবম শ্রেণীতে ভর্তি হন। প্রতিটি ক্লাসেই তিনি প্রথম নম্বরে পাশ করেন।

১৯৩৬ ইংরেজীর ১৩৪১ বাংলা সনে এশিয়ার ইউনিভার্সিটি, আযহরে হিন্দ খ্যাত, দারুল উলুম দেওবন্দে ৬ বৎসর অধ্যয়ন করে উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। হযরত মাওলানা আখতার হুসেন সাহেবের কাছে তার ভর্র্তি পরীক্ষা নেওয়ার ভার পড়ে। হযরত বর্ণভী রহ. উক্ত পরীক্ষায় পুরস্কার সহ পাশ করতে সক্ষম হন। এরপর প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি এক নাম্বার হন এবং বহু পুরস্কারে পুরস্কৃত হন। দাওরায়ে হাদিসের ক্লাসে হযরত মাদানী রহ.-এর খেদমতে আসার সৌভাগ্য লাভ করেন। এ বৎসরটি দেওবন্দ মাদ্রাসার সত্তরতম বৎসর ছিল। হাদিস শরীফ যাদের কাছে অধ্যয়ন করেন, তাদের মধ্যে শায়খুল আরব ওয়াল আযম, শায়খুল ইসলাম সায়্যিদ হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর কাছে বোখারী ও তিরমিযী শরীফ, ইব্রাহীম বলয়াবী রহ.-এর কাছে মুসলিম শরীফ, সৈয়দ আসগর হোসাইন সাহেবের কাছে আবুদাউদ শরীফ, হযরত এজাজ আলী রাহ. সাহেবের নিকট শামায়েলে তিরমিজী শরীফ এবং অন্যান্য কিতাব শামসুল হক আফগানী রহ.-এর নিকট অধ্যয়ন করেন। হাদীস অধ্যয়নের পরদিনই মাদানী রহ.-এর কাছে বাইয়াত হয়ে যান।

১৯৪১ সালের ১৩৪৬ বাংলার ১০ই মাঘ সকাল বেলা ইজাজত ও খেলাফত লাভ করেন এবং হাকীমুল উম্মত হযরত থানবী রহ.-এর দোআ গ্রহণ করেন। এরপর হযরত বর্ণভী রহ. দেশে ফিরে এসে ১৩৪৮ বাংলা খেকে ১৩৫৮ বাংলা পর্যন্ত দীর্ঘ ১০ বৎসর মৌলভীবাজার শহরস্থ দারুল উলুম মাদ্রাসায় সুনামের সাথে দরস তাদরিছের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। দারুল উলুমে থাকাবস্থায় যুগের সংস্কারক হযরত বর্ণভী রাহ. হেফাজতে ইসলামের ডাক দেন। হেফাজতে ইসলাম গঠন প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, বহুগ্রন্থ প্রণেতা বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ শাহ নজরুল ইসলাম সাহেব লিখেন যে “শায়খ বর্ণভীর দেশে প্রত্যাবর্তন “১৯৪০ সাল, ১৩৪৬ বাংলা। যখন উপমহাদেশ জুড়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম তুঙ্গে। অন্যদিকে ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, এমনি এক প্রেক্ষাপটে উচ্চ শিক্ষা সমাপ্ত করে তাযকিয়া ও ইহসানের দীক্ষা ও স্বীকৃতি নিয়ে দেশে ফিরেছেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নি পুরুষ শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.-এর প্রিয় ছাত্র ও খলিফা হযরত শায়খ মাওলানা লুৎফুর রহমান বর্ণভী রহ.। তখন গ্রামের যুব সমাজকে সুশৃঙ্খল, ঐক্যবদ্ধ ও দ্বীনদার হিসেবে গড়ে তুলতে ১৯৪৪ সনে/ ১৩৪৯ বাংলা ( মতান্তরে ১৯৪৬) বাংলা ‘হেফাজতে ইসলাম, কমিটি গঠন করা হয়”।

আন্জুমানে খাওয়াতীনে হেফাজতে ইসলামের সম্পাদিকা, মা তুল্য মুহতারামা দিলরুবা রহমান হামিদী কর্তৃক রচিত হায়াতে বর্ণভীতে লিখেছেন “দারুল উলুম দেওবন্দ থাকাবস্থায় যুগের সংস্কারক হযরত বর্ণভী রহ.-এর অন্তরে আলোড়ন জাগিয়ে তুলে অরাজনৈতিক সংগঠন আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম। তখন ১৩৪৯ বাংলা, হেফাজতে ইসলামের সূচনা হল”। এরই উদ্দ্যোগে বাতিল মতবাদ সর্ম্পকে মুসলমানদেরকে সজাগ-সচেতন করার জন্য এবং ইসলাম বিরোধী মহলের লেখনির জবাব লেখনির মাধ্যমে প্রদানের জন্য ১৯৭৩ সালে ‘হেফাজতে ইসলাম’ নামক পত্রিকা প্রকাশের উদ্দ্যোগ গ্রহণ করা হয় । আজ ১৬ ই ফেব্রুয়ারী ২০১৬ ইং বর্ণভী রহ.-এর স্মৃতিগুলি এমনি এক মুহুর্তে লিখতে বসেছি যখন অভিশপ্ত আত্মার ক্ষমতা লিপ্সায় পৃথিবী জুড়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজছে, পৃথিবী নামক এই গ্রহের চার দিকেই মুসলিম নির্যাতন, মুসলিম দেশে সা¤্রাজ্যবাদিদের অপ্রতিরোধ্য আগ্রাসন, অত্যাচার ও নিপীড়ন সইতে না পেরে আল্লাহর জমিন কেপে উঠছে, নড়েচড়ে উঠছে ভূমিকম্পে, সমগ্র বিশ্বে নিপীড়িত নির্যাতিত মুসলিমদের রক্ষা করার জন্য সৌদি বাদশাহ সালমান ও তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদুগান সমগ্র মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সমগ্র মুসলিম বিশ্ব যেন তদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে তার জন্য মহান আল্লাহর কাছে আমরা দোয়া করছি। মানব সভ্যতার এমনই এক অদ্ভুু¢ত আধারের মুহুর্তে মুর্শিদে কামিলের জ্ঞানের স্বর্ণশিখরে বিচরণের স্মৃতি সহ মনের নিভৃত অনূভুতিকে ব্যক্ত করার প্রয়াস পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে করছি। তিনি ছিলেন ইলমের মহাসাগর; যে বিশাল সাগরের বেলাভূমিতে এসে আমরা আলোর সন্ধান পেয়েছি, যার স্পর্শে জীবনে রেনেসাঁর আবির্ভাব হয়েছিল।

মাতৃভূমি বাংলাদেশ মুর্শিদে কামিলকে বুকে ধারণ করে ধন্য হয়েছিল। কারণ তিনি যেখানেই হাত দিয়েছেন সেখানেই সোনা ফলেছে। কাজেই তার গগণচুম্বী ব্যক্তিত্বের সাথে আর কারো তুলনা চলেনা। তিনি নিজেই নিজের উপমা। পৃথিবীতে প্রথমত একটি চেরাগ জ্বলে উঠে, অত:পর সেই চেরাগের আলোদিয়েই লাখো চেরাগ জ্বলে। সূর্য থেকেই আলো গ্রহণ করে চন্দ্র। সে চন্দ্র রাতকে আলোকিত করে।‘পূর্ণিমা’ পূর্ণিমা হতে পারে সূর্যের আলো দিয়েই। সূর্যের প্রদক্ষিণ শেষ হলে চন্দ্র পায় আলো। ঠিক তেমনি ভাবে আধ্যাত্মিক জগতের সূর্য বর্ণভী রহ নিজ শায়খের কাছে সুলুক ও আধ্যাত্মিকতার মেহনত করে খেলাফত প্রাপ্ত হয়ে জান্নাত লাভের গুনগত মাপকাঠি ঈমান ও নেক আমলের মেহনতে জাতিকে তোলে দেওয়ার কাজই করে গেছেন আজীবন।

বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে মৌলিক ভাবে মুলত: তিনটি কাজ করে গেছেন, (১) তালিম ও তরবিয়ত (২) দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজ (৩) তাযকিয়া তথা আতাœশুদ্ধির কাজ। যার ফলে দেশের আনাচে-কানাচে তৈরী হয়েছে মাদ্রাসা, খানকা ও মক্তব। হাজার হাজার পথহারা মানুষ পেয়েছে সরল-সঠিক পথের সন্ধান ও আপন প্রতিপালকের পরিচয়। এই লক্ষেই কাজ করে যাচ্ছে স্বীয় প্রতিষ্ঠিত বরুণা মাদ্রাসা ও আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম। এদুটির দিকে ইঙ্গিত করেই বর্ণভী রহ. বরুণার জলসায় জীবনের শেষ অসিয়ত হিসেবে বলে গিয়েছিলেন “বন্ধুগণ আমি তোমাদের সামনে দুটি মিশন রেখে গেলাম। তোমরা এ দুটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রচেষ্ঠা চালাবে। (১) আঞ্জুমানে হেফাজতে ইসলাম (২) ইলমে ওহীর সুতিকাগার প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি বিদ্যাপীঠ “জামেয়া লুৎফিয়া আনওয়ারুল উলুম হামিদ নগর বরুণা”
“নাহি সেতো আজ ধুলির ধরায়
আছে শুধু তার জ্বালানো আলো,
পথহারা কত লক্ষ পথিক;
সে আলোতে পথ পেল।
(তার) নিজ হাতে সাজানো
ফুলে ফলে ভরা এ বাগান
হয়ে গেল খালি
আজ সবই আছে
নেই শুধু বাগানের মালী।”

হযরত বর্ণভী রহ. অনেক কষ্টসহ্য করে আদিম যোগাযোগ ব্যবস্থার যুগেও বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অজপাড়া গাঁয়ে দ্বীনি মাহফিলে যোগদান করতেন। তিনি যেখানেই যেতেন সেখানেই দোয়া তাবিজ, তদবির, মুরিদ এমনকি অনেকে নিজ বাড়িতে নেয়ার জন্য ভীড় জমাতো। হযরত বর্ণভী রহ. শত ব্যস্ততার মাঝেও হাসিমুখে সকলের আবদার রক্ষা করার চেষ্টা করতেন।

আমার শ্রদ্ধেয় আব্বা হযরত বর্ণভী রহ. সর্ম্পকে স্মৃতিচারণ করে বলেন যে, একবার হযরত মাওলানা শায়খে মাড়কুনী ও হযরত বর্ণভী রহ. আমাদের বাড়ী সংলগ্ন মাহফিলে এসেছিলেন, তখন পিতা মুহতারাম যুবক বয়সে পদার্পণ করেছেন মাত্র, কিন্তু তাকে অসুস্থতা পেয়ে বসেছিল। আমার মুহতারাম চাচা মাওলানা আব্দুল কাইয়ুম উরফে আপ্তাব আলী রহ. হযরত বর্ণভী রহ.-এর খেদমতে নিয়োজিত ছিলেন। তাদেরকে তিনি আব্বার অসুস্থতার সংবাদ জানিয়ে আমাদের বাড়ীতে আসার আবদার করলে তাঁরা দেখতে আসেন। তাঁদের পদদুলিতে ধন্য হয় উর্ধ পুরুষ সফর মুন্সীর স্মৃতী বিজড়িত আমাদের গরীবালয়। তাঁদের দোয়ায় আব্বা মুহতারামের রোগ মুক্তি হয় এবং বর্ণভী রহ.-এর সাহচার্য লাভে বাড়ীর সকলই ধন্য হন। শায়খুল হাদীস মুশাহিদ বায়মপুরী রহ., মুফাক্কিরে ইসলাম সামছুল হক ফরিদপুরী রহ., হযরতুল আল্লাম বশির আহমদ শায়খে বাঘা রহ., ফখরে বাঙ্গাল আল্লামা তাজুল ইসলাম রহ., হযরত মাওলানা শামছুল ইসলাম শেরপুরী রহ., মাওঃ বশির উদ্দীন গৌড়করনী রহ., মহতরমুল মাকাম হযরত মাও: নূরুল হক শায়খে ধরমন্ডলী রহ., কায়িদে উলামা শায়খুল মাশায়িখ হযরত মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া রহ. সহ ইসলাহী কাজের সমসাময়িক সহযোদ্ধা উলামাদের সাথে ছিল তার হৃদতাপুর্ণ সম্পর্ক। হযরত বর্ণভী রহ. ইসলাহী কাজে যোগদান করেছেন বিভিন্ন বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। উদ্দেশ্য ছিল তার পদচারণায় যেন বাতিলের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে। ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন নির্ভীক ও অত্যন্ত সাহসী। মনে হতো কবির নিম্নোক্ত পংক্তির বাস্তব নমুনা।
“মুসলিম আমি, সংগ্রামী আমি, আমি চির রণবীর;
আল্লাহকে ছাড়া মানিনা কাউকে না‘রায়ে তাকবীর।”
এ কারণেই আয়্যুবী সামরিক সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত জন্মনিয়ন্ত্রণ আইন বিরোধী পল্টন সমাবেশে নির্ভীক সিপাহসালারের মত নির্ভয়ে সভাপতিত্ব করেন । তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ ও দূরদর্শী। পাক ভারত আলাদা হওয়ার পরে সিলেট প্রশ্নে হযরত ইন্দেশ্বরী রহ. ও আল্লামা বর্ণভী রহ. পাকিস্তানের পক্ষে রায় দেন। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সম্পর্কে হযরত ধরমন্ডলী রহ. কে হযরত বর্ণভী রহ. বলেছিলেন; আমি সূর্যের মত দেখতে পাচ্ছি যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েই যাবে। তার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হলো, পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ইসলাম ও মুসলমানের শত্রুরা মাতৃজাতিকে দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালাবে। এ জন্য তিনি হেফাজতের কর্মসুচিতে মহিলা তা‘লিম অন্তর্ভুক্ত করেন। যাতে বিধর্মী সংস্থাগুলো মহিলাদেরকে অনৈসলামিক কাজে লিপ্ত করতে না পারে।
হযরত বর্ণভী রহ. যুবক অবস্থায়ই ইজাজত লাভ করেন। যুবক বয়সে মুরিদ করতে আরম্ভ করলে কতিপয় আলেমের কানাঘুষার জবাবে হযরত মাদানী রহ. রমজানুল মুবারকে এ‘তেকাফ চলাকালীন নয়া সড়ক মসজিদে উলামা মাশায়েখ সহ সর্বস্তরের মানুষের সমাবেশে বললেন, হে লোক সকল, তোমরা জেনে রাখ, আমি হুসাইন আহমদ একবার খেলাফত পেয়েছি কিন্তু বাংলার কৃতিসন্তান লুৎফুর রহমানকে দুইবার খেলাফতি দিয়েছি। হযরত বর্ণভী রহ. ১৩৫৯ বাংলায় পবিত্র হজ্জব্রত পালন করেন।
যে উজ্জ্বল নক্ষত্রটি উদিত হয়েছিল বরুণার নিসর্গ প্রকৃতির মায়াবী পরিবেশের মুক্ত আবহাওয়ায়; তা অস্তমিত হয়ে যায় ১৭ইমে ১৯৭৭ ইংরেজী, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৪ বাংলা, মোতাবেক ২৮ জুমাদাল উলা ১৩৯৭ হিজরী মঙ্গলবার ভোর ৫ ঘটিকায়। সে দিন চিরকালের জন্য নিভে গেল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন না ফেরার দেশে, যেখান থেকে কেউ কোন দিন ফিরে আসেনি। আমাদের জন্য শুধু রেখে গেলেন সমুজ্জ্বল অবদান গুলো।
“এখন ফিরাবে তাঁরে কিসের ছলে?
বিদায় করেছ যারে নয়ন জলে,
আজি মধু সমীরণে-
নিশীতে কুসুম বনে,
মধু নিশী পূর্ণিমায়,
ফিরে আসে বার বার।
সে জন ফিরে না আর, যে গেছে চলে,
এখন ফিরাবে তাঁরে কিসের ছলে?”
জানাযার পূর্বে সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। এলাকার মাটি ও মানুষ, ইট পাথর, পাখ পাখালী, গাছ গাছালী সব যেন নীরব ভাষায় কেঁদে চলেছে। লুৎফাবাগের আকাশে বাতাসে তখন কান্নার আওয়াজ ধ্বনিত হতে থাকে। সকলই শোকে মুহ্যমান, সকলের চোখেই পানি। মুখে হতাশা আর নিরাশার কালো ছোঁয়া। এক পর্যায়ে সবাই শেষ শ্রদ্ধাটুকু নিবেদন করতে নামাযে জানাযায় দাড়িয়ে যায়। এক আবেগপূর্ণ ও ভাবগম্ভীর পরিবেশে শেষ হয় হযরতের নামাযে জানাযা। যে যেখানে জায়গা পেয়েছে দাড়িয়ে গিয়েছে। হযরত বর্ণভী রাহ.র নিকটাত্মীয় ও পরিবার বর্গের পরামর্শে দাফন করার সিদ্ধান্ত হয় বর্তমানে যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সেই স্থানে দুই মসজিদের মধ্যখানে জামেয়ার কোল ঘেষে পুকুর পাড়ের সবুজ শ্যামল দক্ষিণ পশ্চিম কোনে। প্রচন্ড ভীড়ের মধ্যে হাজার হাজার জনতার অপ্রতিরোধ্য ¯্রােত ডিঙ্গিয়ে হযরত বর্ণভী রহ. কে আনা হয় কবর প্রাঙ্গনে। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম ও অব্যাহত সাধনার ফলে মাদ্রাসা সমূহের হাজার হাজার উলামায়ে কেরাম ও ভক্তবৃন্দের বুকফাটা কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে।
উপরে চাদের ¯িœগ্ধ আলো, ঝিরঝির বাতাস, প্রস্ফুটিত ফুলের সুরভিত সুবাস, মনোরম শীতল হাওয়া আর জান্নাতী খোশবু এরই মাঝে প্রশান্তচিত্তে শুয়ে আছেন শায়খুল হাদিস হযরত বরুণী রহ.।
জায়গাটি ঘাসে ছাওয়া, ছাঁয়া ঘেরা ও নিরিবিলি, মসজিদ সংলগ্ন। যেথায় জোনাকিরা আলো জেলে সঙ্গ দেবে রাতের আধাঁরে, গাছেরা ছায়া দিবে প্রখর রোদে, ভোর বেলায় কয়েকতলা বিশিষ্ট মসজিদে আবু বকরে শিশুদের সূললিত কণ্ঠের তিলাওয়াত, হুফ্ফাজদের তিলাওয়াতের মধুর আওয়াজ তার আত্মাকে করবে বিমোহিত। মুয়াজ্জিনের আযানের সুমধুর ধ্বনি শুনতে পাবেন সকাল সন্ধা অবিরত। আর রুহানী চোখে দেখবেন জীবনভর যে চেতনা মনে লালন করে জীবন উৎসর্গ করেছেন, তার সুতিকাগারেই তিনি আছেন শায়িত। তার লালিত স্বপ্ন, কল্পিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে তাঁরই খুব কাছ থেকে। কুদওয়াতুস সালিকীন হযরত হামিদী বর্ণভী রাহ.-এর শেষ রাতের আবেগময়ী দোয়া, সাজারায়ে ত্বায়্যিবাহ বা মোনাজাতে মক্ববুলের পংক্তিগুলো আজও বিভিন্ন জলসায় ওয়ায়িযিনে কেরাম পাঠ করেন। বর্ণভী ভক্তদের ঘরে ঘরে তা আজও স্বযতেœ ভাবাবেগের সাথে পড়া হয়।
হযরত বর্ণভী রহ. সহ চার ত্বরীকার বুযুর্গানে দ্বীন, আকাবীর-আসলাফ ও মরহুম সমস্ত আসাতিযায়ে কেরামের মাগফিরাত কামনা করে এই ক্ষুদ্র প্রায়াসের সমাপ্তি টানছি।
“জীবনের যাত্রা পথে
হাজারও যাত্রী চড়ে
কার পরিচয় বা কে রাখে
যারা কিছু রেখে যায়
তাদেরই শুধু মনে থাকে।”

লেখক: মুহাদ্দিস, খতিব

একুশে জার্নাল/ইএম/১৬-১৭