খেলাফত মজলিসের ৩০ বছর: গঠন, ভাঙ্গন, পুনর্গঠন ও অঙ্গীকার

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ১১ ২০১৯, ২০:২৫

ফুজায়েল আহমাদ নাজমুল

বাংলাদেশের ইতিহাসে নানা সময়ে নানা প্রেক্ষাপটে ইসলামী দলগুলো ভেঙ্গেছে। একটি দল ভেঙ্গে আরেকটি দলের জন্ম হয়েছে। এতে সমর্থক-কর্মীদের সংখ্যা না বাড়লেও নেতাদের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য সফলতা লক্ষ করা যায়নি। আমরা লক্ষ করছি, দীর্ঘ সময় ধরে দলগুলো ধর্মভিত্তিক ইস্যুতে আটকে আছে। একটি সুন্দর উন্নয়নশীল বাংলাদেশ গড়তে কেউই সন্তোষজনক রূপরেখা ও সুস্পষ্ট কোন অঙ্গীকার জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেনি। এছাড়াও দেশের সর্বশ্রেণী ও পেশার মানুষকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসতে পারেনি। কিছু দল রয়েছে শুধুমাত্র কওমীপন্থী ওলামাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। জেনারেল শিক্ষিতদের নিয়ে তাদের কোন কর্মসূচী নেই। কোন প্ল্যান নেই। যুগযুগ ধরে তাঁরা ময়দানে কাজ করলেও সমাজের জেনারেল শিক্ষিত বিশাল এ গোষ্ঠীকে কাছে টানতে ব্যর্থ হয়েছে রীতিমতো। আবার কোন দল রয়েছে শুধুমাত্র আলীয়া মাসরাসা ও জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আদর্শগত মতপার্থক্যের কারণে তাঁরাও কওমী অঙ্গন তথা হক্কানী আলেম-ওলামাদের সমর্থন আদায় করতে পারেনি।

আলেম-ওলামা যেমন সমাজের বিশাল একটি অংশ, ঠিক তেমনি জেনারেল শিক্ষিত যারা, তাঁরাও সমাজের বিশাল একটি অংশ। এক অংশ অপর অংশকে মাইনাসে রেখে নিজস্ব বলয়ের প্রতিষ্ঠানের রিজার্ভ ছাত্র-শিক্ষক দ্বারা বিশাল বিশাল সমাবেশ, সম্মেলনসহ রাজপথে লোকদেখানো বড় বড় কর্মসূচি পালন করা যায়, সাময়িক চমক দেখানো যায়, কিন্তু কাংখিত লক্ষে পৌঁছা কঠিন। প্রচলিত সমাজ কাঠামোর পরিবর্তনের লক্ষে আদর্শহীন, সুবিধাবাদী, দুর্নীতিপরায়ণ, অসৎ ও স্বৈরাচারী নেতৃত্বের অবসান ঘটিয়ে জনগণের আস্থাভাজন সৎ ও আদর্শবান নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে এ দু’শ্রেণির ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের বিকল্প নেই। আর এ দু’শ্রেণির মধ্যে সুষম সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি আন্দোলন তার কাংখিত লক্ষে পৌঁছতে পারে বলে আমি বিশ্বাস করি।

যাহোক, সময়ের দাবী ছিলো আলেম-ওলামা, দ্বীনদার বুদ্ধিজীবি ও ইসলামী চিন্তাবিদদের সমন্বয়ে একটি আন্দোলন গড়ে ওঠার। যেখানে মাদ্রাসা শিক্ষিত, জেনারেল শিক্ষিত ও কৃষক শ্রমিকসহ সব পেশা ও শ্রেণির মানুষের সতস্ফুর্ত অংশগ্রহণ থাকবে। কিন্তু নানা কারণে এ দাবী ছিলো উপেক্ষিত। স্বাধীনতার  দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও নব্বইয়ের দশকে এ মহান দাবী পূরণে এগিয়ে আসেন শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.), প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা শায়েখ আব্দুল গফফার (রহ.), অধ্যাপক মাওলানা আখতার ফারুক (রহ.), অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক, প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান (রহ.), অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মাসউদ খাঁন, অধ্যাপক ড. আহমদ আবদুল কাদেরসহ আরো অনেক।

১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকাস্থ ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় প্রত্যাশা পূরণে এক ঐতিহাসিক ঘোষণার মধ্যদিয়ে উপরোল্লিখিত মহান মনিষীগণ ও তাঁদের সহযোদ্ধারা গণ-মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল দল হিসেবে জন্ম দেন ‘বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।’ একক কারো চিন্তা বা উদ্যোগে এ দলের জন্ম হয়নি। মূলতঃ শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. এর নেতৃত্বাধীন খেলাফত আন্দোলন এবং ড. আহমদ আবদুল কাদের এর নেতৃত্বাধীন ইসলামী যুব শিবির একীভূত হয়েই দলটির আত্মপ্রকাশ। যারা এককভাবে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. -কে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের রূপকার বা প্রতিষ্ঠাতা দাবী করেন তাদের এমন দাবী সঠিক নয়। আমি তাদেরকে প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণা পত্র খুঁজে বের করে পড়ার অনুরোধ করবো।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রথম সাংগঠনিক সেশনে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. অভিভাবক পরিষদের চেয়ারম্যান, প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা শায়েখ আব্দুল গফফার রহ. আমীর এবং ভাষা সৈনিক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মাসউদ খাঁন মহাসচিব নির্বাচিত হন। মাওলানা আব্দুল গফফার রহ. এর পরববর্তী সময়ে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. দলের আমীর নির্বাচিত হন।

প্রতিষ্ঠাকালীন আমীর মাওলানা আব্দুল গফফার রহ. (বামে) ও প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব ভাষাসৈনিক অধ্যক্ষ মুহাম্মদ মাসউদ খাঁন (ডানে)

খেলাফত মজলিস আত্মপ্রকাশের পর জনমনে ব্যাপক আশার সঞ্চার করে। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ৯২-সালের বাবরী মসজিদ আন্দোলন, ফারাক্কা ও বরাক বাঁধ বিরোধী সংগ্রাম, ৯৪ সালের নাস্তিক-মুরতাদ প্রতিরোধ আন্দোলন, ৯৬ সালের পার্বত্য চুক্তি বিরোধী আন্দোলন, ৯৭ সালের মুর্তি বিরোধী আন্দোলন এবং ফতোয়া বিরোধী রায় প্রতিরোধ আন্দোলন, নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলন সহ দেশ ও ইসলামের পক্ষে সকল ন্যায্য দাবীতে রাজপথে সোচ্চার ভুমিকা পালন করে এ দলটি। এ ছাড়াও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার জন্য দেশের সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং মুসলিম উম্মাহর বিরোধ-বিভেদের অবসান ও ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় খেলাফত মজলিসের ভুমিকা ছিলো বেশ প্রসংশনীয়।

এক মঞ্চে শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ. ও ড. আহমদ কাদের সহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ

শায়খুল হাদীস রহ. সুস্থ থাকা পর্যন্ত অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে ‘বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস’ এগুতে থাকে আপন গন্তব্যের পথে । তবে বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে ২০০০ সালের পর থেকে ধীরেধীরে তিনি শারীরিকভাবে বেশ দুর্বল হয়ে পড়েন। আর এই সুযোগে তখনকার শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা অসাংগঠনিক ও অসাংবিধানিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়েন। সংগঠনের কল্যাণ, যোগ্যতা ও দক্ষতার বিবেচনায় কেন্দ্রীয় মজলিসে শুরার অধিকাংশ সদস্য ড. আহমদ আবদুল কাদেরকে মহাসচিব হিসেবে দেখতে চাইলে তারা বাঁধা হয়ে দাঁড়ান। শায়খুল হাদীস রাহ. -কে তারা বুঝানোর চেষ্টা করেন, ড. আহমদ আবদুল কাদেরকে মহাসচিব করা হলে “বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস” জামায়াতে ইসলামীর সাথে যুক্ত হয়ে যাবে। কোন অবস্থায় ড. আহমদ আবদুল কাদেরকে বিশ্বাস করা যায় না। শায়খুল হাদীস রহ. তখন ভীষণ অসুস্থ। আমীরের দায়িত্ব পালনের মতো স্মৃতি ও স্মরণশক্তি কিছুই নেই। এক কথায়, একজন আমীর হিসেবে কোন অসাংগঠনিক বা অসাংবিধানিক তৎপরতাকে রুখে দেয়ার মতো শক্তি ও সামর্থ ছিল না তাঁর। কোনমতে দু’জনের কাঁধের ওপর ভর করে গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামগুলোতে হাজির হতেন। একপর্যায়ে ষড়যন্ত্রকারীরা বয়োবৃদ্ধ শায়খুল হাদীস রহ. -কে অতি সহজেই প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। এরই সূত্র ধরে  অনাকাঙ্ক্ষিতভাবেই ২০০৫ সালের ২২’মে ‘বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস’ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।

২২মে ভোরের সূর্যোদয়ে উভয় পক্ষের দলপ্রেমিক নেতাকর্মীরা চোখের সামনে আলোকোজ্জ্বল সকাল দেখতে পায়নি। চোখজুড়ে কান্নার ঢল, মনের গহীনে বেদনার ঢেউ অস্থির করে তোলে সবাইকে। ওইদিন বিকাল ৩টা পর্যন্ত ঢাকায় অনুষ্ঠিত দু’টি মজলিসে শূরার অধিবেশনের কোনটাতেই না গিয়ে কি করে এক সাথে থাকা যায় সে ভাবনায় আচ্ছন্ন ছিলেন দলের অন্যতম শীর্ষনেতা, প্রখ্যাত  মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী রাহ.। সংকট নিরসনের জন্য তিনি কয়েকজন শীর্ষনেতাকে নিয়ে শায়খুল হাদীস রহ. এর সাথে জরুরী ভিত্তিতে দেখা করতে বেশ চেষ্টা করেন। পরিবেশ পরিস্থিতি খারাপ দেখে অশ্রুসজল নয়নে কাতর হয়ে শায়খুল হাদীসের চারপাশ ঘেরা লোকদের বলেন  “তোরা দলটা ভাঙিস না, আমাদেরকে শাইখের সাথে দেখা করতে দে।” কিন্তু দুর্ভাগ্য, শায়খুল হাদীসের পাশে থাকা স্বার্থান্বেষী লোকগুলো সে সুযোগ দেয়নি। যখন মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী রহ. শুনতে পেলেন জামেয়া রাহমানিয়ায় গুটিকয়েক মজলিসে শূরার সদস্যদের নিয়ে একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়ে গেছে এবং মজলিসে শূরার দুই তৃতীয়াংশ সদস্য রাজধানীর তোপখানাস্থ রুপসী বাংলা হোটেল মিলনায়তনে বসে আছেন। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের প্রতিষ্ঠাকালীন অঙ্গীকার হাতমী নয়, শূরায়ী ফায়সালা এবং ওলামা মাশায়েখ ও দ্বীনদার বুদ্ধিজীদের সমন্বয়ের প্রতিনিধিত্বকারীদের সাথে কাজ করার। অবশেষে তোপখানাস্থ রূপসী বাংলায় মজলিসে শূরার অধিবেশন শুরু হলে সেখানে অশ্রোভেজা চোখ, দৃঢ় প্রত্যয়ী মনোভাব আর ওলামা-মাশায়েখ ও বুদ্ধিজীবিদের সন্বয়ের দৃঢ়সংকল্প, সর্বাবস্থায় শূরায়ী ফায়সালার বলিষ্ঠ উচ্চারণ যেন এক নতুন শক্তির সঞ্চার করে।

২৩ মে পত্রিকার রিপোর্ট:  “২০০৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার অধিবেশনে মহাসচিব পদ নিয়ে কোনো সুরাহা না হওয়ায় শূরার অধিবেশন ছয় মাসের জন্য মুলতবি রাখা হয়েছিলো। সেই মুলতবি অধিবেশনের পূর্ব নির্ধারিত তারিখ ছিলো ২২ মে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ। স্থান ছিলো ঢাকা ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন মিলনায়তন। শূরার সদস্য এবং জেলা কমিটিসমূহের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকরা ২১মে রাতেই গিয়ে উপস্থিত হলেন ঢাকায়। কিন্তু রাত নয়টায় হঠাৎ অধিবেশনের স্থান পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। নতুন স্থান ঘোষণা করা হয় শায়খুল হাদীসের মোহাম্মদপুরস্থ মাদ্রাসা জামেয়া রহমানিয়ায়। স্থান পরিবর্তনের ভেতর শূরার অধিকাংশ সদস্যরা আগাম ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পান। তারা আপত্তি করেন জামেয়া রহমানিয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে। রাত তিনটায় মহাসচিব মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফীর লোকেরা পুলিশ নিয়ে এসে শূরার সদস্যদেরকে জোরপূর্বক মাদ্রাসায় নিয়ে যায় এবং দলের প্রধান কার্যালয়ে তাদের একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। কওমী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে শায়খুল হাদীস-ইউসুফী গ্রুপের লোকেরা সকাল থেকে ফটো জার্নালিস্ট এসোসিয়েসনের মিলনায়তন দখল করে রাখলে বিক্ষুব্ধ শূরার সদস্যরা সেখানে শূরার অধিবেশন করতে ব্যর্থ হন। পরে তারা পুরানা পল্টনের একটি রেস্টুরেন্টে শূরার মুলতবি অধিবেশন করে শায়খুল হাদিস আজিজুল হককে অভিভাবক পরিষদের প্রধান করে মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাককে আমীর এবং অধ্যাপক আহমদ আব্দুল কাদেরকে সদস্য সচিব পদ দিয়ে ৪১ সদস্যবিশিষ্ট নতুন কমিটি ঘোষণা করেন। অন্যদিকে জামেয়া রহমানিয়ায় অনুষ্ঠিত মুলতবি শূরার বৈঠকে শায়খুল হাদিস মাওলানা আজিজুল হককে আমীর এবং মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফীকে সদস্যসচিব করে নতুন কমিটির অন্যান্যদের নাম ঘোষণা করা হয়।” (সূত্র: ভোরের কাগজ, ২৩ মে ২০০৫)

নব্বইয়ের দশকে রাজপথে মিছিলের প্রথম সারিতে মুষ্টিবদ্ধ উঁচু হাতে শ্লোগান ধরছেন ড. আহমদ আবদুল কাদের

৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করলে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস উভয় পক্ষই নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেন নির্বাচন কমিশনে। তবে সমান নাম দু’পক্ষকেই দিতে পারে না নির্বাচন কমিশন। অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মাদ ইসহাক ও ড. আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশ পুরাতন নাম নিয়ে টানাটানি না করে দলের নাম থেকে ‘বাংলাদেশ’ বাদ দিয়ে অর্থাৎ শুধুমাত্র “খেলাফত মজলিস” নামে (২০০৮ সালে) আবেদন করলে ঝামেলা ছাড়াই নিবন্ধন লাভ করে। যার নিবন্ধন নং- ৩৮ এবং দলীয় নির্বাচনী প্রতীক হচ্ছে ‘দেয়াল ঘড়ি’। অপরদিকে  প্রিন্সিপাল মাওলানা হাবীবুর রহমান ও মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফীর নেতৃত্বাধীন অংশ পুরাতন নামেই অর্থাৎ “বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস” নামে নিবন্ধন লাভ করে। এবং তাঁরা দলীয় নির্বাচনী প্রতীক পান ‘রিক্সা’। মজলিসের উভয় অংশকে এখন আর গ্রুপ বলা যায় না। নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হবার পর পৃথক দু’টি সংগঠনে রূপান্তরিত হয়ে যায় । উভয়ের দলীয় মনোগ্রাম, গঠনতন্ত্র ও নির্বাচনী প্রতীক সবই পৃথক হয়ে যায়।

তবে সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যারা অতি উৎসাহী হয়ে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে দু’টুকরো করতে অগ্রণী ভুমিকা পালন করেন তারা আজ কেউই শায়খুল হাদীসের অংশ অর্থাৎ বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের রাজনীতিতে নেই। ২০১৪ সালের এপ্রিলে মাওলানা আবদুর রব ইউসুফী সাহেব কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা তাফাজ্জুল হক আজিজ সহ বেশ কিছু নেতাকর্মী নিয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামে যোগদান করেন। রাজধানীর একটি হলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম আয়োজিত যোগদান অনুষ্ঠানে মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী সাহেব অতি খোশ মেজাজে, উৎফুল্ল বদনে বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর অনুভূতি পেশ করেন। একপর্যায়ে তিনি বলেন, শায়খুল হাদীস রহ. এর ইন্তেকালের পর ওই সংগঠন (বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস) একটা মরা লাশে পরিণত হয়েছে। এই লাশ টানার দায়িত্ব আমি কেন নেব? পাইপ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে, এখন লোক আসতেই থাকবে। (সুত্র: আওয়ার ইসলাম, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭)

মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী সাহেব সেদিন অত্যন্ত কৌশলে জমিয়ত নেতাকর্মীদের নজরকাড়ার চেষ্টা করেন। তিনি বুঝাতে চেষ্টা করেন যে, শাইখুল হাদীসের “বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস” একটা মরা লাশ। এ লাশ তিনি আর টানতে পারবেন না। তিনি মজলিস থেকে জমিয়তে আসার জন্য পাইপ লাগিয়ে দিয়েছেন। সেই পাইপ দিয়েই মজলিস থেকে দলে দলে লোকজন জমিয়তে যোগ দিতে থাকবে। ১৯৮৯ থেকে ২০১৪। প্রায় ২৫ বছর মজলিস পরিবারের সাথে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করে দলের প্রথমসারির ওই নেতার বক্তব্য অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয় মজলিস পরিবারে।

ভাঙ্গনের পর বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ত্যাগকারী দুই শীর্ষনেতা মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী (বামে) ও মুফতি মাওলানা শহিদুল ইসলাম (ডানে)

মাওলানা ইউসুফী সাহেবের দল ত্যাগের আগেই খেলাফত মজলিস ভাঙ্গার অন্যতম কারিগর তৎকালীন নায়েবে আমীর, শায়খুল হাদীস রাহ. এর নিকটাত্মীয়, সাবেক সাংসদ মুফতি মাওলানা শহীদুল ইসলাম বেশ কিছু নেতাকর্মী নিয়ে “গণ সেবা আন্দোলন” নামে নতুন একটি দল গঠন করে ‘বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস’ ত্যাগ করেন। একপর্যায়ে মাওলানা আব্দুর রব ইউসুফী সাহেবের পরবর্তী মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা হুমায়ুন কবিরও দল থেকে বহিস্কৃত হন। এভাবে অনেক আছেন যারা ২০০৫ সালের দল ভাঙ্গার কারিগরদের সহযোগী ছিলেন তাঁরা আজ আর বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসে নেই। যারা শায়খুল হাদীস রাহ. -কে বলেছিলেন, ড. আহমদ আবদুল কাদের মহাসচিব হলে দলকে জামায়াতে ইসলামী বানিয়ে ফেলবে। তাদের মুখে আজ নিশ্চয়ই চুনকালি পড়েছে। তাদের কথা, অবিশ্বাস, এবং সন্দেহ আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। ২০০৫ এর পরথেকে ‘খেলাফত মজলিস’ একযুগ পার করলেও জামায়াতে ইসলামীর সাথে ড. আহমদ আবদুল কাদের বা তাঁর দলের নুন্যতম সংশ্লিষ্টতা তারা প্রমাণ করতে পারেননি। যদি আজ শায়খুল হাদীস রহ. দুনিয়াতে স্মৃতি ও স্মরণশক্তিসহ সুস্থ অবস্থায় জীবিত থাকতেন তাহলে তাদের ষড়যন্ত্র সব বুঝতে পারতেন। আল্লাহ শায়খুল হাদীস রহ. -কে জান্নাতের সুউচ্চ মাক্বাম দান করুন।

দীর্ঘ দুই যুগের লম্বা এই পথচলায় অসংখ্য বাধা-বিপত্তির মোকাবেলা করতে হয়েছে খেলাফত মজলিসকে যা কেবল কাফেলার নেতাকর্মীরাই বলতে পারবে। প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পর্যায়ে বন্ধু সংগঠনের মিথ্যাচার ও হিংসা-বিদ্বেষের নির্মম অত্যাচারে কোমর ভেঙ্গে যাবার কথা থাকলেও নেতাকর্মীদের ঐক্য, দৃঢ় মনোবল, বিশ্বাস, সবর এবং বিরামহীন প্রচেষ্টা সব বাঁধা ও প্রতিবন্ধকতাকে পরাজিত করে দেশের রাজধানী থেকে তৃনমূল পর্যন্ত সুবিস্তৃত একটি সংগঠন হিসেবে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের! ২০০৫ সালের বিভক্তি দলের অগ্রযাত্রায় প্রচন্ড আঘাত করে অপূরণীয় ক্ষতি ঘটায় যা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন প্রখ্যাত মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী রহ.

আন্দোলন সংগ্রামে এমন আঘাত মাঝেমধ্যে আসে এবং তা মোকাবেলাও করতে হয়। যারা একটি নির্দিষ্ট লক্ষে পৌছতে চায় তারা যেকোন কঠিন পরিস্থিতিতেও এগিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখে। থেমে যেতে পারে না বরং  অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আরো বহুগুণ সাহস নিয়ে এগুতে চায় মঞ্জিলের দিকে। অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ ইসহাক ও ড. আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্বাধীন ‘খেলাফত মজলিস’ ময়দানে এমনি উদাহরণ পেশ করেছে। কেন্দ্রীয় সংগঠন সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষকে দলের সাথে সম্পৃক্ত করতে শ্রমিক সংগঠন (শ্রমিক মজলিস), পেশাজীবী সংগঠন (ডক্টর সোসাইটি অব বাংলাদেশ), আইনজীবী সংগঠন (আইনজীবী মজলিস), মহিলা সংগঠন (মহিলা মজলিস) গড়ে তুলেছে। মধ্যপ্রাচ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও গড়ে ওঠেছে দলের শাখা প্রশাখা । দেশ-বিদেশে প্রচুর সমর্থক, কর্মী ও শুভাকাঙ্খী রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সকল পর্যায়ের জনশক্তির আদর্শিক সচেতনতা ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি এবং তাদের আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মানোন্নয়নের মাধ্যমে উপযুক্ত কর্মীরূপে গড়ে তুলতে রয়েছে দলের নানামুখী কর্মসূচী। বলা যায়, ক্যাডারভিত্তিক পরিচ্ছন্ন এ দলের কাজ বর্তমানে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, গতিশীল ও সু-সংগঠিত।

সব শ্রেণী ও পেশার মানুষকে এক প্লাটফর্মে একত্রিত করতে যখন অন্যান্য দল ব্যার্থ হয়েছে তখনই খেলাফত মজলিস সফল হয়েছে। কওমী-আলীয়া পন্থী আলেম, মাদরাসা শিক্ষক, স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, কৃষক-শ্রমিক সহ সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষ এ দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। এমনকি সরকারের নীচ থেকে উচ্চপর্যায়েও এ দলের অনেক জনশক্তি রয়েছেন যারা সততা ও দক্ষতার সাথে রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসেবে কাজ করছেন। এটা একটি দলের জন্য বিশাল প্রাপ্তি।

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের দলীয় মনোগ্রাম (বামে) ও খেলাফত মজলিসের দলীয় মনোগ্রাম (ডানে)

খেলাফত মজলিস রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে না পারলেও দীর্ঘ তিন দশকে দেশ ও জাতিকে নেতৃত্ব দেবার মতো একঝাঁক সৎ, যোগ্য ও দক্ষ লোক তৈরী করতে সক্ষম হয়েছে। আমি মনে করি দলটি যথেষ্ট সম্ভাবনাময়। এ সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো উচিত। যারা এখনো এ দল সম্পর্কে তেমন জানাশোনা নেই তাদেরকে জানার আহবান করছি। এ দলটি ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে সমাজ কাঠামোর পুনর্গঠন, জনগণের সকল প্রকার মৌলিক মানবিক অধিকার সংরক্ষণ ও নিশ্চিতকরণ এবং ন্যায় ও ইনসাফভিত্তিক জনকল্যাণমূলক প্রতিনিধিত্বশীল একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে বাংলাদেশকে একটি দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। এজন্যে দলটির রয়েছে সুনির্দিষ্ট বেশ কিছু অঙ্গীকার। আর তা হচ্ছে নিম্নরূপ:

১. মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণঃ ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করাণার্থে’ ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। মুক্তিযুদ্ধের এই আদর্শ নিশ্চিতকরণ ও তৎসঙ্গে জনগণের ইস্পাত কঠিন ঐক্য গড়ে তোলার মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ এবং যাবতীয় আধিপত্যবাদ ও আগ্রাসী তৎপরতার মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

২. জনপ্রতিনিধিত্বশীল ও জবাবদীহিমূলক সরকারঃ অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই সরকার পরিচালনা করবে এবং সরকার তার সব কর্মকান্ড পরিচালনার ব্যাপারে জনগণের কাছে দায়ী থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।

৩. মানবাধিকার সংরক্ষণঃ সকল মানুষই জন্মগতভাবে স্বাধীন ও সমান। আইনের কাছে সবাই সমান। কাউকে নির্যাতন, অমানুষিক অথবা অবমাননাকর আচরণ অথবা শাস্তি ভোগে বাধ্য করা যাবে না। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নারী-পুরুষ, ভাষা, জাতীয়তা, জন্ম এবং রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে প্রত্যেক মানুষের সকল মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হবে।

৪. সুবিচার ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাঃ সামাজিক ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিচারব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। স্বল্প ব্যয়ে দ্রুত সুবিচার পাওয়ার নিশ্চয়তা একটি উন্নত বিচারব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য। একটি কার্যকর, স্বাধীন ও সুদক্ষ বিচার ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

৫. মাতৃভাষা ও সংস্কৃতিঃ বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। মাতৃভাষাই জ্ঞান অর্জন ও ভাব বিনিময়ের সর্বোত্তম বাহন। তাই বাংলা ভাষা এবং বাংলা সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের বিষয়ে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া হবে। সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশ, সুন্দর রুচিশীল বিনোদন ও খেলাধূলার প্রসার এবং উন্নয়নের ব্যবস্থা করা হবে। নৈতিকতাবর্জিত অসুস্থ- অপসংস্কৃতি নির্মুলে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহন করা হবে।

৬. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মীয় অধিকারঃ বাংলাদেশে বসবাসরত সকল ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মৌলিক, মানবিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকারসমূহ সংরক্ষণ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সুনিশ্চিত করা হবে।

৭. শিক্ষা সংস্কারঃ ইসলামী মূল্যবোধের ভিত্তিতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে সংস্কার করা হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধুনিক তথ্য- প্রযুক্তি শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। শিক্ষার লক্ষ্য হবে একটি উন্নত নৈতিক মানসম্পন্ন, বিজ্ঞান মনস্ক ও দক্ষ জাতি গড়ে তোলা। বিনামূল্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে উন্নত মান সংরক্ষণ ও পর্যাপ্ত গবেষণার ব্যবস্থা করা হবে। আলিয়া ও কওমী মাদ্রাসা শিক্ষাকে যথাযথ মূল্যায়ন ও স্বীকৃতি প্রদানসহ এর মানকে আরো উন্নত করা হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে বেসরকারি খাতকে আরো কার্যকর ও গতিশীল করা হবে। বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর যথাযথ গুরুত্ব প্রদান করা হবে। উপযুক্ত শিক্ষক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য করা হবে। শিক্ষার অবকাঠামো উন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

৮. সৎ ও দক্ষ প্রশাসনঃ একটি সৎ, দক্ষ ও গণমুখী প্রশাসন উন্নত জাতি গঠনের জন্যে অপরিহার্য। তাই দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতামূলক এবং গণমুখী প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৯. জনকল্যাণমুখী অর্থ ব্যবস্থাঃ বাংলাদেশে এমন একটি অর্থব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে যা জনগণের উৎপাদন ক্ষমতার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের সাথে সাথে সম্পদের সুষম বন্টনও নিশ্চিত করবে। সুদ ব্যবস্থার অবসান এবং যাকাত ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করা হবে, যাতে সমাজের কেউ অভুক্ত না থাকে এবং কোথাও কোনো অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে না উঠে। সব ধরণের দুর্নীতি কঠোর হস্তে দমন করা হবে। দেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

১০. প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাঃ বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীসমূহকে সকল দিক থেকে আরও শক্তিশালী করার সাথে সাথে গোটা জাতিকে প্রতিরক্ষা কাজে প্রস্তুত রাখার উদ্দেশ্যে স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসা ছাত্রসহ সব সম নাগরিকদের দুই বছর মেয়াদী সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।

১১. পররাষ্ট্রনীতিঃ পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সমতা ও সমঅধিকারের ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন। “সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়” এ নীতি নিষ্ঠার সাথে পালন করা হবে। ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশসমূহের সাথে বিশেষ সৌহার্দমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হবে। আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরোধিতা, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকল মজলুম জাতিসমূহের পাক্ষাবলম্বন এবং তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন থাকবে।

১২. গণ-মাধ্যমের স্বাধীনতাঃ রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে বিবেচিত গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হবে। সাংবাদিকদের অধিকার নিশ্চিত করা, সাংবাদিকতার মানোন্নায়নে এবং সংবাদ মাধ্যমের অপব্যবহার রোধে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে। সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমের ইতিবাচক চর্চা অবাধ করা ও নেতিবাচক চর্চার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও সাইবার অপরাধ দমনে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে।

১৩. কৃষি উন্নয়ন ও ভূমি ব্যবস্থাপনাঃ বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষি উন্নয়নের লক্ষ্যে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক গবেষণার উদ্যোগ নেয়া হবে। কৃষি জমি সংরক্ষণ ও ভূমির ঊর্বরতা অনুয়ায়ী কৃষি জমির শ্রেনিবিন্যাস করা হবে। কৃষি উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে কৃষকদের বিনা সুদে ঋণ দান, কৃষি উপকরণে পর্যাপ্ত ভর্তুকি প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে। নতুন জেগে উঠা চর ও সরকারি খাস জমি ভূমিহীন ও ছিন্নমূল চাষীদের মধ্যে বণ্টন নিশ্চিত করা হবে। দিনমজুরদের স্বার্থ সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় আইন প্রণয়ন করা হবে। ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিরাজমান দুর্নীতি ও জটিলতা দূর করা হবে এবং ভূমির মালিকানা সংশ্লিষ্ট আইনী প্রক্রিয়া সরলীকরণ এবং ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা হবে।

১৪. শিল্পোন্নয়নঃ জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করার জন্যে প্রয়োজনবোধে সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করার ব্যবস্থা রেখে বেসরকারি সেক্টরকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হবে। দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য পদক্ষেপ নেয়া হবে। দেশের শিল্পায়ন ও শিল্প-কারখানা পরিচালনার ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত এবং দেশ ও জনগণের স্বার্থানুকূল নীতি-পলিসি অনুসরণ করা হবে। এক কথায় দ্রুত দেশকে একটি আধুনিক শিল্পোন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

১৫. গ্রামীণ উন্নয়নঃ গ্রামই বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র। দেশের ৯০ শতাংশ মানুষের বাস গ্রামে। অবহেলিত গ্রামে কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে শহরমুখী জনস্রোত ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গ্রামের উন্নয়ন হলে বাংলাদেশের ৯০ ভাগ উন্নয়ন হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। গ্রামীণ উন্নয়নের লক্ষ্যে গ্রামে গ্রামে উন্নত মানের কৃষি, মৎস্য ও গবাদিপশু খামার, কৃষি নির্ভর শিল্প, কুটির শিল্প প্রভৃতি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে গ্রহণ করা হবে।

১৬. কল্যাণমুখী শ্রমনীতিঃ শ্রমিকদের সম্মানজনক জীবনধারণের উপযোগী বেতন-ভাতার ব্যবস্থা করা হবে। তৎসঙ্গে তাদের বাসস্থান ও চিকিৎসা সুবিধা, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ ইত্যাদিরও ব্যবস্থা করা হবে। শিল্প-কারখানার মালিকানায় শ্রমিকদের অংশীদারিত্বের ব্যবস্থা থাকলে শিল্পক্ষেত্রে শুভ ফল বয়ে আনবে। শ্রমিক-মালিক বিরোধে যাতে উৎপাদন ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় আবার শ্রমিকদের ন্যায়সংগত অধিকারও যাতে আদায় হয় তার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। যাবতীয় শ্রম শোষণ বন্ধ করা হবে এবং সুস্থ গঠনমূলক ট্রেড ইউনিয়নকে উৎসাহিত করা হবে।

১৭. মানব সম্পদ উন্নয়নঃ একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ জাতি গঠনের জন্যে দেশে নৈতিকগুনসম্পন্ন দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে। যুবকদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে কারিগরি শিক্ষা বিস্তার এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে। নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা হবে। সাথে সাথে দেশ জুড়ে কুটির শিল্প ও ক্ষুদ্র শিল্প বিস্তারে উদ্যোগ গ্রহণ এবং ঋণ সহায়তা কর্মসূচি চালু করা হবে।

১৮. প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের সুরক্ষাঃ দেশের সর্বপ্রকার খনিজ সম্পদের মালিক জনগণ। এই সম্পদকে বিদেশীদের লুটপাট থেকে রক্ষা ও দেশের উন্নয়ন ও কল্যাণে যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। দেশের প্রতিটি খনিজ সম্পদের সঠিক ব্যবহারের জন্যে জাতীয় খনিজ নীতি প্রণয়ন করা হবে। দেশে নতুন নতুন খনিজের অনুসন্ধান ও জরিপের উপযুক্ত পদপে গ্রহণ করা হবে।

১৯. নারী ও শিশু অধিকার সংরক্ষণঃ দেশে মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। নারী সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে। যৌতুক প্রথাসহ নারী নির্যাতনমূলক সকল প্রকার কার্যকলাপকে কঠোরভাবে দমন করা হবে। শিশু নির্যাতন, শিশু শ্রম বন্ধ করে শিশুদের সহজাত বিকাশের মাধ্যমে আগামী দিনের উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হবে।

২০. স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণঃ স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানো হবে এবং স্বাস্থ্য রাক্ষায় যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করা হবে। দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্যে সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা হবে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করার পদক্ষেপ নেয়া হবে। সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করে সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয় রোধ এবং ছোটদের স্নেহ, বড়দের সম্মান ও পিতা-মাতার অধিকার নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

২১. মাদকদ্রব্য ও মাদকাশক্তি নির্মুলঃ সামাজিক অবক্ষায় রোধে যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণীদের মাদকাশক্তি থেকে ফিরিয়ে সুস্থ্য ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার উপরে বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হবে। ভয়াবহ ও মারাত্মকব্যাধি মাদকাশক্তি নির্মুলে সব ধরনের মাদকদ্রব উৎপাদন, আমদানি ও সরবরাহ রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

২২. সামাজিক নিরাপত্তাঃ সমাজের সকল মানুষের মৌলিক অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। যার অভিভাবক নেই রাষ্ট্রই তার অভিভাবক- এ নীতির ভিত্তিতে ইয়াতিম, বৃদ্ধ- বৃদ্ধা, বিধবা, শারিরীক প্রতিবন্ধী, মানসিক প্রতিবন্ধী( অটিস্টিক), পথশিশু ও নি:স্ব মানুষের অধিকার সুনিশ্চিত করা হবে।

২৩. তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও নিরাপদ যোগাযোগ ব্যবস্থাঃ বর্তমান বিশ্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি উন্নয়নের অন্যতম প্রধান উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি দ্রুত পরিবর্তনশীল। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, কৃষি, বাণিজ্য, প্রশাসন, প্রতিরক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে গতিশীলতা বৃদ্ধি, উন্নয়ন ও স্বচ্ছতার জন্যে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। সারাদেশের সড়ক, নৌ, বিমান ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আধুনিক, বিস্তৃত ও নিরাপদ করার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহন করা হবে।

২৪. স্থানীয় সরকার ও সুষম উন্নয়নঃ দেশের সব অঞ্চলের সুষম উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাকে শক্তিশালী ও গতিশীল করার পদক্ষেপ গ্রহন করা হবে। নির্বাচিত ও কার্যকর ক্ষমতার অধিকারী সকল পর্যায়ে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে।

২৫. পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষাঃ বৈশ্বিক আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সামগ্রিক উষ্ণতা বেড়েই চলছে। ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাও বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ভবিষ্যৎ পৃথিবী ও মানব জাতির জন্যে এক মারাত্মক হুমকী। এ অবস্থা মোকাবেলায় কার্বণ নির্গমনের হার কমানো, বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণসহ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং এ উদ্দেশ্যে আন্তর্জাতিক ফোরামে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা হবে।

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, খেলাফত মজলিস রাষ্ট্রক্ষমতায় গেলে এসব অঙ্গীকার বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে। সামাজিক বৈষম্য, অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন, হানাহানি, সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য ও দেউলিয়াপনা এবং বৈদেশিক আধিপত্যের অবসানে গোটা সমাজ ব্যবস্থাকে ইসলামের আলোকে পুনর্গঠন করবে। আর এমন একটি সোনালী দিনের অপেক্ষায় আছে গোটা জাতি।

লেখক : সহ-সাধারণ সম্পাদক, খেলাফত মজলিস, লন্ডন মহানগরী।