আমার ছফা পাঠ -আরিফ আজাদ

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ১৪ ২০২০, ০০:৩৬

আরিফ আজাদ


কিছু কিছু মানুষ থাকেন যারা সময়কে অতিক্রম করে যান। সময়ের যে ফ্রেমে বন্দী মানুষ, সেই গন্ডি থেকে নিজেকে মুক্ত করে, নিজেকে আসীন করেন এক অনন্য উচ্চতায়। সেই উচ্চতা যুগ, মহাযুগ, শতাব্দী পেরিয়ে মহাকাল পর্যন্তও বিস্তৃত হতে পারে। নিজেদের সময়ে তো বটেই, তারা প্রাসঙ্গিক হতে পারে ভিন্ন কোন সময়ের আয়নাতেও। আহমদ ছফা কি তেমন কেউ? প্রশ্নটা একটা সময় আপেক্ষিক মনে হতো, কিন্তু নিজের অভিজ্ঞতা এবং অপরিণামদর্শী দূরদর্শীতা থেকে দুঃসাহস করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘হ্যাঁ! আহমদ ছফা ঠিক তেমনই একজন’।

ছফাকে এই আসনে আসীন করার দুঃসাহস করেছি তার ‘গাভী বিত্তান্ত’ পড়েই। নিজের সময়ের উপাখ্যান লিখে যাওয়া একটা রচনা, কিভাবে এতো দীর্ঘকাল ধরে প্রাসঙ্গিক এবং প্রায়োগিক হয়ে উঠতে পারে, ছফার ‘গাভী বিত্তান্ত’ আমাদের সামনে তার স্পষ্ট উদাহরণ।

আবু জুনায়েদ, যিনি একেবারে নিরীহ গোছের, কারো সাতে-পাঁচে না থাকা লোক, কোন এক দৈব-বলে, তিনি রাতারাতি হয়ে উঠেন দেশের সবচেয়ে সেরা, সবচেয়ে নামী এবং দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য৷ কাজটাকে আবু জুনায়েদ যতো সহজ আর মোলায়েম ভেবেছিলেন, কাজটা বস্তুতপক্ষে ততোই কঠিন আর দুর্বোধ্য। উপাচার্যের চেয়ারে বসার পরে তিনি গভীর বিস্ময়ে অবলোকন করতে থাকেন চারপাশে লকলকিয়ে উঠা লোভাতুর জিহ্বাগুলোকে, যে জিহ্বাগুলো গিলে ফেলতে চায় আবু জুনায়েদকে। চর্বিত চর্বন করতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, এখানকার আইন-কানুন সব। সুযোগ পেলে তারা যেন আস্ত বিশ্ববিদ্যালয়টাকেই উদরপূর্তি করতে রাজি। শুধু তাই নয়, নীল, সবুজ আর হলুদ দলের ছায়ায় যে অপরাজনীতি চর্চা হয়ে চলেছে দীর্ঘকালব্যাপী, এবার আবু জুনায়েদের সামনেই তা যেন চির ভাস্বর হয়ে ফুটে উঠল।

তবে, আবু জুনায়েদ ছাড় দেবেন কেনো? সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট থিওরির মান রেখে, পরিবেশের সাথে বেশ খাপ খাইয়ে নেন তিনিও। হয়ে উঠেন নটেশ্বর। চুলোয় যাক বিশ্ববিদ্যালয়৷ ছাত্রদের পড়াশুনা, সুপ্ত আন্দোলন-সংগ্রামের সকল সম্ভাবনা, আবু জুনায়েদ বাঁচলেই যেন পৃথিবী বেঁচে যায়৷ তাই, নিজের চারপাশে, দিলরুবা খানম, তবারক আলীদের মতোন জোঁক তৈরি করে নিয়ে, আবু জুনায়েদ ব্যস্ত হয়ে পড়েন নিজেকে ঘিরেই।

তবুও হাঁপিয়ে উঠেন তিনি। আর পেরে উঠে পারা যায়না। শেষমেষ তার অদ্ভুত শখের বসে, বিশ্ববিদ্যালয় বাংলোতে তিনি একটা গাভী পালতে শুরু করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তৈরি হয় একটা গোয়ালঘর৷ একপর্যায়ে সেই গোয়ালঘর থেকেই পরিচালিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়। রাষ্ট্রের সবচেয়ে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়টির এমন সকরুণ দৃশ্য বারবার আমাদের বর্তমান বাস্তবতাকে তুলে আনবে আবু জুনায়েদের গোয়ালঘর থেকে। আমাদের চারপাশে আজ অসংখ্য আবু জুনায়েদ। আরো আছে অসংখ্য অদৃশ্য গোয়ালঘর। একজন আবু জুনায়েদ অতীত হয়েছেন, কিন্তু চারপাশে আজ তৈরি হয়েছেন অসংখ্য আবু জুনায়েদেরা! আর বিশ্বদ্যালয়গুলো? ওই যে, তার মনোরম গোয়ালঘর!

আহমদ ছফা লিখেছেন তার জীবনের ধারাভাষ্য। সেই ধারাভাষ্য আজও জীবন্ত, প্রাণবন্ত এবং প্রাসঙ্গিক হয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত। আমাদের বিশাল একটা ব্যর্থতা, আমরা ছফাকে ঠিক সেভাবে মূল্যায়ণ করতে পারিনি যেভাবে মূল্যায়িত হবার দাবি ছফা রাখেন৷ হাফেজ্জি হুজুর একবার ছফাকে কামরাঙ্গীরচরের একটা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে বক্তা হিশেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছফার ক্ষমতাকে অন্তর্চক্ষু দিয়ে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন হয়তো। আমরা পারছি কি?