একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ফেব্রুয়ারি ১৮ ২০১৯, ১২:৩০

মুফতি আহমদ যাকারিয়াঃ আধুনিক বিশ্বে মধ্যযুগের চিত্রকে বিকৃত করে উপস্থাপন করে মধ্যযুগকে বর্বর আর মুসলমানদেরকে অসভ্য হিসেবে চিত্রিত করার একটা ঘৃণ্য অপপ্রয়াস চালানো হচ্ছে। আর এই প্রবণতায় পা ফেলে প্রকৃত সত্য থেকে অনেকেই থেকে যাচ্ছেন বেখবর। আসলে এর পেছনের মূল রহস্য কী? যা বলা হচ্ছে এটাই কি সত্য? নাকি এর পেছনে অন্য কোন সত্য লুকিয়ে আছে?
মধ্যযুগে ইউরোপের খৃষ্টানরাই ছিলো বর্বর, মুসলমানরা নয়। মধ্যযুগীয় বর্বরতা এমন ঘৃণ্য শব্দ মুসলমানদের উপর চাপানো জঘন্য মিথ্যাচার। মধ্যযুগ ও বর্বরতা এই দু’টি শব্দকে সুশীল সমাজের অনেকেই সমার্থক বিবেচনা করে থাকেন। অমানুষিক ও নির্দয় কার্যকলাপকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে বিশেষায়িত করার প্রবণতা মোটেও বিরল নয়। কারও নীতি-আদর্শ ও চিন্তাধারার নিন্দা করতেও এই বাগধারাটি হর-হামেশাই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সেক্যুলার ব্যক্তিবর্গ অনেক সময় ‘মধ্যযুগীয় বর্বরতা’ শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। তারা মধ্যযুগীয় বর্বরতা বলে ইসলামের দিকে ইঙ্গিত করেন। সাধারণত ৫ম শতাব্দী থেকে ১৫দশ শতাব্দী পর্যন্ত যুগকে মধ্যযুগ বলা হয়। যে যুগ ছিল ইসলামের সোনালী যুগ। যে যুগ ছিল শিরকের বিপরীতে তাওহীদের, সুদের বিপরীতে সদকার। যে যুগে নারীদের সাথে জিনা করার বিপরীতে নারীদের স্বামী লাভের অধিকারকে নিশ্চিত করা হয়েছে। যাকে সেক্যুলাররা উপহাস করে মধ্যযুগ বলে। অথচ সে সময় ইউরোপ ছিল প্রকৃত অর্থে বর্বর। ইউরোপে তখন ছিল চার্চ কেন্দ্রিক বর্বরতা। আজও ইউরোপ ফিউডালিজম ছাড়তে পারেনি, সুদভিত্তিক অর্থনীতি ছাড়তে পারেনি, নারীদের পণ্যরূপে ব্যবহার করা ছাড়তে পারেনি।। শুধু যুগের নাম বদলিয়ে আধুনিক যুগ করা হয়েছে।
৫ম শতাব্দী থেকে ১৫দশ শতাব্দী এই হাজার বছরের ইতিহাস বিশ্বময় ইসলাম ধর্মের প্রসার এবং মুসলমান শাসকদের বিজয়গাথায় পরিপূর্ণ। আরবের অন্ধকার যুগের অবসান ঘটে মধ্যযুগের ঊষাকাল ৬১০ খ্রিস্টাব্দে নবী সঃ এর রিসালতের মাধ্যমে। মদীনায় খিলাফত গঠন এবং মক্কা বিজয়ের মধ্য দিয়ে অবসান ঘটে আরবের বর্বর যুগের। নবজাগরণ ঘটে নতুন শতাব্দীর। ইসলাম ও মুসলমানদের বিকাশ ও বিজয়ের হাজার বছরকে পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদগণ বর্বরতার যুগ হিসাবে কেন বিশেষায়িত করতে চাইছেন তা সচেতন মহলের কাছে খুব সহজেই অনুমেয়। অথচ এই মধ্যযুগে বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, রসায়ন, শিল্প-সাহিত্য ও দার্শনিক চিন্তার বিপুল বিকাশ ঘটে। ইউরোপে যখন একটা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল না তখন আরব, ইরান, সিরিয়াসহ মুসলিম সভ্যতার প্রতিটি শহরে গড়ে উঠে অসংখ্য বিজ্ঞানাগার, পাবলিক লাইব্রেরী, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়। মধ্যযুগের বাগদাদের বায়তুল হিকমাহ তো ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রাণভোমরা। বিজ্ঞানের ব্যবহারিক দিক অর্থাৎ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পদ্ধতি সর্বপ্রথম মুসলিম বিজ্ঞানীরাই প্রবর্তন করেছিলেন, গ্রিক যুগে এটা কারও জানা ছিল না। মুসলমানদের আর একটি প্রধান কীর্তি হলো অবলুপ্ত প্রায় গ্রীক ও ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আহরণ, অনুবাদ ও সংরক্ষণ। তা না হলে অনেক আগেই এ দুই সভ্যতার বহু দানের চিহ্ন পর্যন্ত অবশিষ্ট থাকত না । ফলে মধ্যযুগেই ইসলামী সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার মধ্য দিয়ে নতুন রেনেসাঁর জন্ম দেয়। এই মধ্যযুগীয় রেনেসাঁর ফলেই জন্ম নেয় শত শত পণ্ডিত, দার্শনিক, বিজ্ঞানী; যারা জ্ঞান -বিজ্ঞান-দর্শন এসবের বিকাশ ও আবিস্কার করে মানব সভ্যতার ক্ষেত্রে অভাবনীয় অবদান রেখেছেন। রসায়নের জনক: জাবির ইবনে হাইয়ান, বিশ্বের সেরা ভূগোলবিদ: আল-বিরুনি, আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক: ইবনে সিনা, হৃদযন্ত্রে রক্ত চলাচল আবিষ্কারক: ইবনুল নাফিস, বীজগণিতের জনক: আল-খাওয়ারিজমি,  পদার্থ বিজ্ঞানে শূন্যের অবস্থান নির্ণয়কারী: আল-ফারাবি, আলোক বিজ্ঞানের জনক: ইবনে আল-হাইসাম, এনালিটিক্যাল জ্যামিতির জনক: ওমর খৈয়াম, সাংকেতিক বার্তার পাঠোদ্ধারকারী: আল-কিন্দি, গুটিবসন্ত আবিষ্কারক: আল-রাযী, টলেমির মতবাদ ভ্রান্ত প্রমাণকারী: আল-বাত্তানি, ত্রিকোণমিতির জনক: আবুল ওয়াফা, স্টাটিক্সের প্রতিষ্ঠাতা: ছাবেত ইবনে কোরা, পৃথিবীর আকার ও আয়তন নির্ধারণকারী: বানু মুসা, মিল্কিওয়ের গঠন শনাক্তকারী: নাসিরুদ্দিন তুসি, এলজাব্রায় প্রথম উচ্চতর পাওয়ার ব্যবহারকারী: আবু কামিল, ল’ অব মোশনের পথ প্রদর্শক: ইবনে বাজ্জাহ, ঘড়ির পেন্ডুলাম আবিষ্কারক: ইবনে ইউনূস, পৃথিবীর ব্যাস নির্ণয়কারী: আল-ফরগানি, পৃথিবীর প্রথম নির্ভুল মানচিত্র অঙ্কনকারী: আল-ইদ্রিসী, বিশ্বের প্রথম স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের আবিষ্কারক: আল-জাজারি, সূর্যের সর্বোচ্চ উচ্চতার গতি প্রমাণকারী: আল-জারকালি, বীজগণিতের প্রতীক উদ্ভাবক: আল-কালাসাদি সহ আরো অনেকে কোন যুগের বিজ্ঞানি, জ্ঞানী, তাত্ত্বিক?
উনারা যে রসায়ন, পদার্থ, চিকিৎসা বিজ্ঞান , উদ্ভিদ বিজ্ঞান, ফার্মেসি, গনিত, ব্যাকরণ, অলংকার শাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, ভূগোল, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা সহ জ্ঞানের সব শাখায় নতুন নতুন তত্ত্ব ও তথ্য আবিস্কার করলেন তা কোন যুগে?
রেনেসাঁ তো মধ্যযুগের এই রেনেসাঁর কাছে সুস্পষ্টভাবে ঋণী ! কিন্তু ইউরোপীয় আধিপত্যবাদিরা এই ঋণ স্বীকার করতে রাজি নয়! কারন মধ্যযুগ মানেই ইউরোপের অন্ধকার, বর্বর যুগ।
সেখানে ধর্মযাজক ও রাজতন্ত্রের যৌথশাসন মানুষের জন্য শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। ধর্মের নামে যাবতীয় অযৌক্তিক, অবৈজ্ঞানিক চিন্তা, কূপমণ্ডূকতা , অন্ধত্বের প্রসার চূড়ান্তরূপ ধারণ করেছিল। কোনো চিন্তাশীল মানুষ, দার্শনিক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী বা যেকোনো পরিবর্তনকামী মানুষ গীর্জার অনাচারের বিরুদ্ধে টু শব্দ করলেই তাকে পুড়িয়ে মারা হতো, শূলে চড়ানো হতো, গিলোটিনে শিরোচ্ছেদ করা হতো, ফুটন্ত তেলের পাত্রে ফেলে দেওয়া হতো।
মূলত ইউরোপ ৫ম শতাব্দী থেকে ১৫দশ শতাব্দী পর্যন্ত অন্ধকার যুগে ছিল বলেই পুরো মধ্যযুগকেই বর্বরতার আর অন্ধারের যুগ বলে হেজেমনিক প্রচার চালিয়ে তারা মুসলিম সভ্যতার ঐতিহাসিক অবদানকে নাকচ করে দিতে চায়। এটাকে বলা যায় সভ্যতা আর জ্ঞান বিজ্ঞানের ইতিহাসকে হাইজ্যাক করার পশ্চিমা বর্ণবাদী আচরণ!
মধ্যযুগের আলোকিত মুসলিম সভ্যতাকে অস্বীকার করে একে অন্ধকার যুগ বলে চালিয়ে দেয়ার মানে হচ্ছে ঐতিহাসিক শঠতা এবং তা সভ্যতা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় দুর্বৃত্তায়নকে মেনে নেয়া, যে দুর্বৃত্তায়ন মদিনা, বাগদাদ, দামেস্ক, খোরাসানকে বাদ দিয়ে আধুনিক ইউরোপের বিজ্ঞান আর প্রযুক্তির চর্চাকেই কেবল রেনেসাঁ বলে চালিয়ে দেয়।
অতএব যারা মধ্যযুগের ইউরোপীয় বর্বরতাকে মুসলমানের বর্বরতা বলে প্রোপাগান্ডা করে তারা মিথ্যাবাদী, ধোকাবাজ, প্রতারক এবং ইতিহাস বিকৃতকারী নরপশু।
আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন।