হেরা গুহা; বর্তমান অতিত

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ২৭ ২০১৮, ১১:২৯

মক্কা থেকে মুফতি মাসরুর অাহমেদ বুরহানঃ
মক্কা শরিফ থেকে ছয় কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত একটি পাহাড়ের নাম জাবালে নূর। এই পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত একটি গুহাকে বলা হয়- ‘গারে হেরা’ বা ‘হেরা গুহা’। নবুওয়ত লাভের পূর্বে নবী করিম (সা.) এই গুহায় ইবাদতে মগ্ন থাকতেন। এখানেই সর্বপ্রথম অহি নাজিল হয়েছিলো।

নিচ থেকে দেখলে মনে হয় পাহাড়টি খুব বেশি উঁচু নয়। কিন্তু আদতে পাহাড়টি বেশ উঁচু। এমনকি জাবালে নূরে যাওয়ার জন্য যেখানে গাড়ি দাঁড়ায়, সেই স্থানটিও জমিন থেকে প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ ফুট ওপরে। সমতল থেকে এটুকু পথ গাড়িতে ওঠা যায়। কেউ অবশ্য হেঁটে ওঠেন। আবার কেউ গাড়ি নিয়ে ওঠেন। মূল পাহাড়ের উচ্চতা ৫৬৫ মিটার। এখানে উঠতে হয় হেঁটে হেঁটে।

অনেক দর্শনার্থী পাহাড়ের চূড়ায় উঠেন। তীব্র গরম, ও অনেক উঁচু  হওয়ায়  আমার উপরে উঠার সাহস হলো না। যদিও উপরে উঠার রাস্তা পাথর কেটে কেটে ছোট ছোট সিঁড়ি বানানো হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও পাইপ বা চিকন রডের রেলিং দেওয়া আছে। অগত্য জাবালে নূর দর্শন হলো- পাহাড়ের গোঁড়া থেকে। পরে অবশ্য পাহাড়ে না উঠার আফসোস অনেকবার হয়েছে।

বায়তুল্লাহর পরশে…

যারা উঠেছেন, তাদের ভাষ্য হলো- এখন ওপরে ওঠা আগের তুলনায় অনেক সহজ। কিছু দূর উঠে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য বসার জায়গা তৈরি করা হয়েছে। পথে এ রকম পাঁচটি বিশ্রামাগার রয়েছে।

ভাবতে অবাক লাগে, আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশত বছর আগে জাবালে নূরের একেবারে চূড়ায় অবস্থিত হেরা গুহায় উঠার জন্য এখনকার মতো রাস্তা ছিলো না। কোনো সিঁড়ি ছিলো না। ছিলো না কোনো রেলিং। তখন এই পথ বেয়ে হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) ওপরে উঠতেন। আর উম্মুল মুমিনিন হজরত খাদিজা (রা.) হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জন্য নিয়ম করে প্রতিদিন তিন বার খাবার নিয়ে যেতেন!

যে গুহায় নবী করিম (সা.) নবুওয়তের আগে ধ্যান করতেন এবং যেখানে কোরআন নাজিল হওয়া শুরু হয়, ওই গুহাটির আয়তন ৬ থেকে ৭ বগফুট। দশনার্থীরা এখানে এসে নামাজ পড়েন। চেষ্টা করেন কিছু সময় ধ্যান বা মোরাকাবা করার।

ইতিহাসে বলা হয়েছে, আল্লাহতায়ালার অদৃশ্য ইশারায় হজরত রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি বছর এখানে মাসখানেক গভীর ধ্যান ও গবেষণায় নিয়োজিত থাকতেন। নিঝুম গবেষণা, একনিষ্ঠ ধ্যান ও নির্জনতা অবলম্বনের যথার্থ পরিবেশ বিরাজমান ছিল এ গুহায়। নবী করিম (সা.)-এর বয়স চল্লিশে পৌঁছার অনেক আগে থেকেই তিনি এখানে নির্দিষ্ট মেয়াদে সময় কাটাতে থাকেন। হজরত খাদিজা (রা.)-এর সঙ্গে বিয়ের পর থেকে প্রতি বছরই তিনি রমজানের একমাস এখানে নির্জনবাস করতেন। এরূপ নির্জনবাস কোরায়েশরাও জাহিলি যুগে করতো।

নবী করিম (সা.)-এর বয়স চল্লিশ বছর পূর্ণ হলে তার প্রতি অহি নাজিল হয়। নবী করিম (সা.)-এর গারে হেরায় নির্জন বাস বিষয়ে কোরায়েশরা তার সঙ্গে দুশমনি করেনি। কারণ তাঁর দাদা আবদুল মুত্তালিবই সর্বপ্রথম এখানে নির্জনবাস করেছেন এবং তিনি এ প্রথার সূচনা করেছেন। বর্বরতার তিমির পরিবেশে কেউ পাপমুক্তি ও পরিশুদ্ধি অর্জন করতে চাইলে তার সংশোধনাগার ছিল এ গারে হেরা।

জাবালে নূর


মূলত এখানে নির্জনবাসের কারণ ছিলো- পাপ বর্জন করা, সব ধরনের অন্যায় থেকে দূরে থাকা, একত্ববাদের আদর্শে অটুট থাকা, মূর্তিপূজা পরিহার করে পূণ্য কাজে মনোনিবেশ করা। নির্জনতা অবলম্বন করে ধ্যান-গবেষণা করা, নিভৃতে সাধনা সংযম করা।

নবী মুহাম্মাদ (সা.) মানবজাতির শান্তির জন্য, মুক্তি ও কল্যাণের জন্য আজীবন সাধনা করে গেছেন। তিনি মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর উপলব্ধি জাগানো এবং মানুষকে কুফর ও শিরিক হতে মুক্ত করার ভাবনায় নিমগ্ন থাকতেন সদা সর্বদা। নিজ বাসস্থান থেকে অনেক দূরে হেরা গুহায় একাকী নিজনে থাকা তারই একটি প্রক্রিয়া।

হেরা গুহা ও জাবালে নূর এ দু’টি স্থান ও মুসলমানদের কাছে খুবই প্রিয়। এই পাহাড়ের হেরা গুহায় প্রথম অহি নিয়ে আসেন হজরত জিবরাইল (আ.)। তিনি এসে নবী করিম (সা.) কে বলেন, ‘পড়ুন।’ নবী করিম (সা.) বললেন, ‘আমি পড়তে জানি না।’ হজরত জিবরাঈল (আ.) নবী করিম (সা.) কে আলিঙ্গন করলেন। জিবরাঈল (আ.) পুনরায় তাকে বললেন, পড়ুন। এভাবে তিন বার ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) তাকে আলিঙ্গন করেন। এরপর নবী করিম (সা.) পড়তে শুরু করলেন। প্রথমে হজরত জিবরাঈল (আ.) সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত পড়ে শোনান। এভাবেই সূরা আলাক নাজিলের মধ্য দিয়ে শুরু কোরআন নাজিল। সূচনা হয় নতুন ধর্ম- ইসলামের।

বস্তুত হেরা গুহা বা গারে হেরা ইসলামের ইতিহাসে একটি আলোচিত জায়গার নাম। ইসলামের ঐতিহাসিক নির্দেশনাবলীর অন্যতম। মানব জাতির মুক্তির দিক নির্দেশনা সম্বলিত গ্রন্থ এবং প্রিয় নবীর শ্রেষ্ঠ মুজেজা সব শেষ ও সেরা আসমানি কিতাব কোরআনে কারিম দুনিয়ার বুকে সর্ব প্রথম এখানে নাজিল হয়, যে কারণে এই গুহার মূল্যায়ন এতো বেশি।