হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর জীবন-সংগ্রাম

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মে ০৭ ২০২৩, ১৭:২৫

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমে দ্বিন মাওলানা মুহাম্মদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। বাংলাদেশে ইসলাম ও ইসলামী শিক্ষার প্রসার, আধ্যাত্মিক সাধনা, ইসলামী জ্ঞান-গবেষণা ও ইসলামী রাজনীতির ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন তিনি। তাঁকে বলা হয় তাওবার রাজনীতির প্রবর্তক। স্বাধীন বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তাঁর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ এরশাদবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরব হয়েছিলেন। তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান মিশন ছিল বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার মক্তব প্রতিষ্ঠা করা।

হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ১৮৯৫ সালে লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার লুধুয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ইদ্রিস ও মায়ের নাম খাদিজা। তাঁর দাদা আকরামুদ্দিন (রহ.) ছিলেন সাইয়েদ আহমদ বেরলভি (রহ.)-এর খলিফা। নয় ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম এবং তাঁদের বোন ছিলেন পাঁচজন। পারিবারিক পরিমণ্ডলে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) নিজ গ্রামের অদূরে ফতেপুর প্রাইমারি স্কুলে প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেন। এরপর চন্দ্রগঞ্জ মাদরাসায় এবং কুমিল্লার লাকসামে নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণীর মাদরাসায় এক বছর করে পাঠ গ্রহণ করেন।

একদিন আবর্জনার মধ্যে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ লেখা এক টুকরা কাগজ দেখে তিনি তা তুলে এনে পরিষ্কার করে সযত্নে রেখে দেন। এই ঘটনার প্রভাবে তাঁর মন গভীরভাবে আল্লাহ ও কোরআনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। তিনি কোরআন হিফজ করার জন্য কাউকে না বলে মাত্র দেড় টাকা সম্বল নিয়ে ভারতের পানিপথের উদ্দেশে বেরিয়ে যান। ১৯১৩ সালে তিনি পানিপথের কারি আবদুস সালাম (রহ.)-এর অধীনে হিফজ শুরু করেন। হিফজ শেষ হওয়ার আগেই মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে কারি আবদুস সালাম (রহ.)-এর মৃত্যু হলে বাকি হিফজ কারি আখলাক হুসাইন (রহ.)-এর অধীনে ১৯১৫ সালে শেষ করেন। এরপর ১৯১৫ থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত সাহারানপুর মাদরাসায় পড়াশোনা করেন এবং সেখান থেকে দাওরা শেষ করে ১৯২৩ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে ফুনুনাত আলিয়া তথা ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ স্তরের সনদ লাভ করেন।

দেশে ফেরার পর হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) দেশের একাধিক মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখেন এবং সেখানে শিক্ষকতা করেন। অবশেষে ১৯৬৫ সালে ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে তাঁর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় জামিয়া নূরিয়া ইসলামিয়া।

কোরআনি শিক্ষা প্রসারে হাফেজ্জী হুজুর (রহ.)-এর বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি প্রতিবছর রমজান মাসে জামিয়া নূরিয়ায় তাঁরই ছাত্র নাদিয়াতুল কোরআনের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আবদুল ওহাব ও নূরানি শিক্ষা পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা বেলায়েত হুসাইনের মাধ্যমে কোরআন শেখানোর প্রশিক্ষণ কোর্সের ব্যবস্থা করতেন। বড়কাটারা মাদরাসা প্রতিষ্ঠার পর তিনি পানিপথের পদ্ধতি অনুসরণে একটি আদর্শ আবাসিক হিফজখানা প্রতিষ্ঠা করলেন। তখন ঢাকায় এটাই ছিল প্রথম আবাসিক আদর্শ হিফজখানা। তাঁর জীবনের অন্যতম মিশন ছিল বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামে ৬৮ হাজার মক্তব প্রতিষ্ঠা করা।

হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ছিলেন হাকিমুল উম্মত মাওলানা শাহ আশরাফ আলী থানভি (রহ.)-এর বিশেষ খলিফা। থানভী (রহ.)-এর সুদীর্ঘ সাহচর্যের বরকতে শরিয়তের জ্ঞানের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতায় মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে হজরত হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ইরান-ইরাক সফর করেন এবং ইমাম খোমেনি ও মরহুম সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধের চেষ্টা করেন। এর মাধ্যমে তিনি নিজেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে সক্ষম হন।

১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপাতি মেজর জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ১৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিন্দ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় তিনি আলেমসমাজের রাজনীতি বিমুখতার বিপরীতে তাওবার রাজনীতির আহ্বান জানান। ২৯ নভেম্বর ১৯৮১ সালে তিনি খেলাফত আন্দোলন নামে একটি রাজনৈতিক দল ঘোষণা করেন। ২১ অক্টোবর ১৯৮৪ সালে তাঁর নেতৃত্বে ১০টি রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৫ অক্টোবর ১৯৮৬ অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রার্থী হন এবং দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন।

হাফেজ্জী হুজুর (রহ.) ৭ মে ১৯৮৭ সালে ইন্তেকাল করেন। জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় দেশের বিভিন্ন স্থান ও অঞ্চল থেকে হাজার হাজার আলেম উলামা ও শোকার্ত জনতা অংশগ্রহণ করে। জামিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া প্রাঙ্গণে তাঁকে দাফন করা হয়।