স্মরণে প্রিন্সিপাল হাবিবুর রহমান ; ঈমানদীপ্ত সংগ্রামী জীবনের গল্প

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

অক্টোবর ১৯ ২০১৯, ০০:২৬

মুহাম্মাদ মাহবুবুল হক

হারানোর আগে বিয়োগব্যথা ও শূণ্যতার আগে বিদ্যমানতার কদর অনুভব হয় না।হারানোর পর ঠিকই অনূভুত হয়, কী হারালাম।মর্মে মর্মে উপলব্ধি হয় হারানো রত্নের মাহাত্ম্য ও কীর্তি। অপূরণীয় শূণ্যতা ও অনুপস্থিতির প্রভাব ভোরের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে।যে উজ্জ্বল নক্ষত্র চারপাশ জোত্যির্ময় করে রাখতো,সে নক্ষত্র পতনের পর স্বাভাবিক নিয়মেই অন্ধকার নেমে আসে।তিনি ছিলেন আলেমসমাজ ও ইসলামি জনতার মাথার ছায়াদার ছাতা।ছায়া সরে গেলে রোদের তীব্রতা গায়ে লাগে।তাঁর বিয়োগে সিলেটের ইসলামি মহল অনেকটা ছাতাহীন রোদ্রের প্রখরতায় আছেন।তিনি চলে যাওয়ার এক বছর হলো।এখনই আমরা দেখতে পাচ্ছি সিলেটে অপসংস্কৃতি চর্চার লোকেরা পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে চায়।প্রিন্সিপাল আল্লামা হাবীবুর রহমান রাহিমাহুল্লাহ’র কথা বলছি।

গতবছরের ১৯ অক্টোবর ক্ষণজন্মা এ মনীষী আমাদের ছেড়ে পাড়ি জমান অনন্তকালের পরলোকে।এই মহান বটবৃক্ষের ছায়া যতদিন ছিলো সিলেটে বুকভরা সাহস ও গৌরব নিয়ে চলাফেরা করতাম।রাজনৈতিক অনেক প্রোগ্রামের জন্য প্রশাসনকে অবহিতপত্র দেয়ার প্রয়োজন পড়তো,তাঁর নাম বলে সহজেই পত্র জমা দিয়ে চলে আসতাম।প্রশাসনের লোকেরা এ নামের ব্যক্তিত্বকে সমীহ করতো, আমাদের প্রতি ও সম্মান দেখাতো।প্রোগ্রামের জন্য হল বুকিং করতে গেলেও এ নামের উসিলায় বুকিং কাজ সহজেই সমাপ্ত হতো। সিলেট শহরে অনেক জায়গায় হলভাড়া ও কম রাখতো।ইসলামি আন্দোলন সংগ্রামের কিংবদন্তী প্রিন্সাপাল হাবীবুর রহমানের ‘আন্দোলনের যৌবনকাল’আমি পাইনি তবে শৈশব পেরিয়ে কৈশরের দুরন্ত সময়ে এ নামের স্বরূপ ও সুখ্যাতির সাথে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাই।তাঁর বলিষ্ট নেতৃত্বের সিলেট শহরের আন্দোলনের টেউ সারাদেশে আছড়ে পড়তো,এমনকি ভাটি বাংলার আমার গ্রামেও।আমার বড় ভাইয়েরা তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে উজ্জীবীত ও কাজিরবাজার মাদ্রাসায় পড়ালেখার সুবাধে প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমানের আপসহীন নেতৃত্ব সম্পর্কে ছোটবেলা থেকেই আমার জানাশোনা। সে কারণেই তাঁর সাথে আদর্শিক ও আত্মিক ভালবাসার যোগসূত্র তৈরি হয়।পড়াশোনার জন্য সিলেট শহরে আসার পর তাঁর গৌরবগাঁথা নেতৃত্ব ও বিপ্লবী প্রেরণার গল্প শুনে মুগ্ধতার মাত্রা বেড়ে যায়।পরবর্তীতে ২০০৫ ইংরেজীর পর কাছ থেকে তাঁর নেতৃত্বে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম দেখেছি, অংশগ্রহণ করেছি।তাঁর ‘আন্দোলনের যৌবন’ বলতে আশি ও নব্বই দশকের আন্দোলন ও কর্মসূচীকে চিহ্নিত করেছি।আশি ও নব্বই দশকে সিলেটে আলেমসমাজের আধিপত্য ও ইসলামি শক্তির অভূতপূর্ব জাগরণ দেখেছে সিলেটের জনগণ।ওপেনভাবে নাচ,গান ও অশ্লীলতার আসর করার দুঃসাহস দেখাতে পারতো না কেউ।সমকালের বরেণ্য বুজুর্গ মাওলানা আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া ও শায়খুল হাদীস নূর উদ্দিন গহরপুরী প্রমুখ বুজুর্গানে দ্বীনের দোয়া, পরাশর্ম ও প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান ইসলামবিরোধী অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আন্দোলনের দাবানল গড়ে তুলতেন।তাঁর নেতৃত্বে সর্বশ্রেণীর ইসলামপ্রিয় জনগণ ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদের অপ্রতিরোধ্য শক্তি ও জাগরণের জানান দিতেন।’সাহাবা সৈনিক পরিষদ’ সংগঠনের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে ধর্মপ্রাণ মানুষকে নিয়ে ইসলামবিরোধী শক্তিকে কঠোরহস্তে প্রতিহত করতেন।ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র, অপসংস্কৃতির মোকাবেলা মূলোৎপাটনে তিনি বারবার ঈমানদীপ্ত সফল আন্দোলন করে ফসল ঘরে তুলেছেন।

১৯৭৭ সালে সিলেট স্টেডিয়ামে জোয়া, হাউজি ও অশ্লীল নৃত্য প্রদশর্নীর উদ্যোগ নেয়া হয়।প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান বজ্রহুংকারে বলে ওঠেন- ‘শাহজালালের পূণ্যভূমিতে ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ চলতে দেয়া হবে না।’এই ঘৃন্য অপর্কম বন্ধের জন্য হাজার হাজার ইসলামপ্রেমিককে সাথে নিয়ে বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশ গুলি করতে উদ্যত হলে গুলির সামনে বুকটান করে দাঁড়িয়ে গেলেন প্রিন্সিপাল। অবশেষে জেলা প্রশাসক সে আসর বন্ধ করতে বাধ্য হন।এভাবে অসীম সাহস ও দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে পর্বতসম দৃঢ়তা প্রিন্সিপালকে সফলতার সর্বোচ্চ আসনে সমাসীন করে।ইসলামের পক্ষে অসামান্য সাহসী অবদান রাখায় তিনি ‘বাংলার সিংহপুরুষ’ উপাধীতে ভূষিত হন।

১৯৮১সালে সিলেট এমসি কলেজের অধ্যাপক সরদার আলাউদ্দীন কর্তৃক কুরআন অবমাননা বিরোধী গণআন্দোলন,সাহাবাবিদ্বেষীদের অপতৎপরতা বন্ধ ও মুখোশ উন্মোচনের লক্ষ্যে ১৯৯২সালের ১৬ডিসেম্বর ঐতিহাসিক শানেসাহাবা মহাসম্মেলন করে দেশের শীর্ষ ওলামায়ে কেরাম জনসচেতনতা সৃষ্টি করেন।

নব্বইয়ের দশকে কুখ্যাত মুরতাদ তাসলিমা নাসরিন ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদগার ও মুহাম্মদ স.কে কটুক্তি করে লেখালেখি শুরু করলে সর্বপ্রথম তার বিরোদ্ধে প্রিন্সিপাল হাবীব জিহাদ ঘোষণা করেন।১৯৯৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সিলেটের ঐতিহাসিক রেজিস্টারী মাঠের আন্দোলন বিদ্যুৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী, বিশ্বময়।বিতর্কিত এ লেখিকা এখনো নির্বাসিত অবহেলিত জীবন কাটাচ্ছে দেশের বাইরে।এভাবেই মসজিদের ইমাম থেকে কর্মজীবন শুরু করা একজন প্রিন্সিপাল জাতীয় নেতায় পরিণত হন।তৌহিদি জনতার ভালোবাসা ও আস্থার প্রতীকে আবির্ভূত হন।

গতদশকের সবকটি ইসলামী আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা ছিলো অসামান্য। নাস্তিক-মুরতাদ ও খোদাদ্রোহীদের কোনভাবেই তিনি সহ্য করতে পারতেন না।ইসলামের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করলে তাঁর গায়ে যেন আগুন লাগতো।জীবনের পড়ন্ত সময়ে কুখ্যাত নাস্তিক লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ও তিনি গর্জে উঠেছিলেন।দ্বীনি ইস্যু ও ইসলামের প্রশ্নে বিন্দুমাত্র ও ছাড় দিতেন না।এক্ষেত্রে আপোসকামীতার সব দরোজা বন্ধ ছিলো তাঁর।তিনি দেশ জাতি ও গণমানুষের রাজনীতি করতেন।ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ও সর্বদা সোচ্চার ছিলেন।বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের উদ্যোগে প্রিন্সিপালের নেতৃত্বে বরাক নদীতে ভারত বাধঁ নির্মাণ করতে চাইলে টিপাইমুখ অভিমুখে ঐতিহাসিক গণপদযাত্রার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন।রাজনীতিতে তিনি হাফেজ্জী হুজুর রহ. এর তাওবার রাজনীতি থেকে শুরু করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও সর্বশেষ বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীরের দায়িত্ব পালন করে মৃত্যুবরণ করেন।প্রিন্সিপাল হাবীবুর রহমান উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ও বাংলার আপসহীন নেতা শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক রহ.এর আস্থাভাজন ও সহযোদ্ধা ছিলেন।এদেশে শায়খুল হাদীসের নেতৃত্বে যতো আন্দোলন-সংগ্রাম হয়েছে,সবকটিতেই প্রিন্সিপাল রহ.এর অপরিসীম ভূমিকা ছিলো।কওমী সনদের স্বীকৃতি আন্দোলন,বাবরী মসজিদ ভাঙ্গার প্রতিবাদে ঐতিহাসিক লংমার্চ, ফতোয়াবিরুধী আন্দোলনসহ সকল আন্দোলনের মাঠে প্রিন্সিপাল হাবীব শায়খুল হাদীসের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজপথে সক্রিয় অবদান রাখেন।সিলেট অঞ্চলে শায়খুল হাদীসের জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক মিশন প্রিন্সিপালের হাত ধরেই সূচিত হয়েছে।

ইসলামি শিক্ষার বিস্তার ও প্রসারকল্পে আলীয়া মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে ও দেওবন্দের নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে তুলে সুবিশাল জামেয়া মাদানিয়া কাজিরবাজার।সুরমা নদীর তীরে ঐতিহাসিক এ মাদ্রাসাটি দ্বীন রক্ষার ঘাটি হিসাবে তিলে তিলে গড়ে তুলেন।অনেক ত্যাগ,ষড়যন্ত্র ও শত বাঁধার প্রচীর ডিঙিয়ে জামেয়া মাদানিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।শুরু থেকেই জামেয়ার গৌরবোজ্জ্বল পথচলা অবিরাম চলতে থাকে।হাজার হাজার সুযোগ্য আলেম এ জামেয়া থেকে শিক্ষার্জন করে দেশ-বিদেশে ও সমাজের বিভিন্ন অঙ্গনে প্রিন্সিপালের আদর্শ বুকে ধারণ করে নেতৃত্ব দিচ্ছেন,ইসলামকে সমুন্নত করার কাজে নিয়োজিত আছেন।

ব্যক্তি জীবনে তিনি শৌখিন, রুচীশীল,উন্নত আত্মমর্যাদাবোধ,সমকালে আলেমদের থেকে অগ্রসর চিন্তার আলোকিত ব্যক্তিত্ব ছিলেন।তাঁর এই উন্নত রুচিবোধ ও আত্মসম্মানের জন্য অনেকেই প্রিন্সিপালকে দূর থেকে ‘অহংকারী’মনে করতেন।কিন্তু তাঁর সাথে মিশলে, চলাফেরা করলেই তাঁদের ভুল ভাঙতো।

সত্যিকার অর্থেই তিনি নবীদের উত্তরসূরী ছিলেন।আলেমদের সত্যিকার অর্থে যে শান-মান হওয়ার কথা-এগুলোই তাঁর মধ্যে ছিলো।আত্মসম্মান বিলীন করে তিনি প্রভাবশালীদের প্রিয়ভাজন হতে চাইতেন না বলেই বিরাগভাজন হতেন।প্রভাবশালী ও ক্ষমতাবানরা তাঁর কার্যালয়ে আসতো,মাদ্রাসা ও ইসলামের জন্য তাঁর সাথে থেকে সহযোগীতার কথা বলতো কিন্তু ক্ষমতা ও রাজনীতির ক্ষেত্রে তারা অসহযোগিতা প্রদর্শন করতো।সিলেট এক প্রভাবশালী নেতা প্রিন্সিপালকে বললেন,আপনারা মাদ্রাসা-মসজিদ মাদ্রাসা নিয়ে থাকেন,অযথা কেন রাজনীতি আর নির্বাচন করবেন।তাঁর মুখের উপর প্রিন্সিপাল রহ.বলে দিয়েছেন, ‘তোমাদের মতো চুর-বাটপার আর দুর্নীতিবাজরা কী বারবার জনগণের সাথে প্রতারণা করতে থাকবে’ শুনেছি সেদিন থেকেই ঐ নেতা আর প্রিন্সিপালের সাথে সম্পর্ক রাখেননি।

খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে প্রিন্সিপাল রহ.এর প্রতিবাদপ্রবনতার সাহস।আমি তখন জামেয়া মাদানিয়ার ইফতা বিভাগের ছাত্র।২০১৩ সালের শুরুর দিকে ঘটনা।সে বছর জামেয়ার ছাত্র সংসদের উদ্যোগে মাদ্রাসা মাঠে নবীন বরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়।অতিথি ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা,জনপ্রতিনিধি।বক্তব্য তিনি কী একটা ভুল তথ্য উপস্থাপন করেন।সাথে সাথেই তাঁর হাত থেকে মাইক নিয়ে প্রিন্সিপাল রহ.শুধরে দেন। বলেন বিষয়টা এরকম নয়।

তাঁর সাহসী এই ভূমিকায় আমরা সেদিন আপ্লুত হয়েছিলাম।তিনি একাধারে একজন ইসলামিক স্কলার,চিন্তাবিদ,গবেষক আলেম,অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন।তাঁর ব্যক্তি সত্তায় বহুমুখী প্রতিভা ও যোগ্যতার সমন্বয় ঘটেছিলো।

সাহসের মিনার,চেতনার বাতিঘর এই মহীরুহের জীবনের নানা দিক আলোচনা করার যোগ্যতা আমার নেই।এটাই বাস্তবতা,কোন বিনয় প্রকাশ নয়।দেখতে দেখতে প্রিন্সিপাল রহ.এর ওফাতের এক বছর চলে গেলো। তাই সামান্য স্মৃতিচারণ করতে বিবেক বার বার তাগাদা দিচ্ছিলো। এরকম মনীষীরা শতাব্দীতে দু’চারজন আসেন।তাঁদের জীবনাদর্শ, রাজনৈতিক দর্শন, ইসলামের জন্য নির্ভিক ভূমিকা নতুন প্রজন্মদের কাছে তুলে ধরা তাঁর অনুসারী ও উত্তরসূরীদের দায়িত্ব।গুণীজনদের স্মরণীয়, বরণীয় করে রাখতে হয়।তাঁর আদর্শ, চিন্তা ও সকল দ্বীনি প্রতিষ্ঠান সুন্দরভাবে পরিচালনা করা সকলের দায়িত্ব।