স্বাধীনতা ও আজকের বাস্তবতা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মার্চ ২৭ ২০১৮, ২২:৩১

ফুজায়েল আহমাদ নাজমুল:
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ ছিলো তার একটি অংশ। আমাদের অংশকে বলা হতো পূর্ব পাকিস্তান। পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্ব পাকিস্তান মিলে ছিলো পাকিস্তানের পুরো রাষ্ট্র। দীর্ঘ তেইশ বছর পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালায়। শাসনের নামে শোষণ করে। ইতিহাস থেকে আরো জানা যায়, পাকিস্তানের শাসকরা পশ্চিম পাকিস্তানকে বেশি গুরুত্ব দিতো। পূর্ব পাকিস্তানকে তারা সমান চোখে দেখতো না। সমান মর্যাদা দিতো না। সমান অধিকারও দিতো না। এককথায়, পূর্ব পাকিস্তান তার প্রাপ্য মর্যাদা থেকে ছিলো বঞ্চিত। সে জন্য পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মনে ছিলো অনেক কষ্ট। অনেক দুঃখ। ক্ষোভ ছিলো অনেক। জুলুম অন্যায় আর কতো সহ্য করা যায়? একসময় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে জেগে ওঠে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করতে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে রাস্তায় নেমে আসে।
একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করতে চারিদিকে তীব্রবেগে আওয়াজ ওঠে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো – বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ স্বাধিকার আদায়ে গোটা বাঙালি জাতি এই শ্লোগানে তখন জেগে উঠেছিলো এক নতুন স্বপ্ন নিয়ে। সর্বস্তরের জনতার মাঝে এক তীব্র উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিলো। পাকিস্তানি শাসকরা তা মেনে নিতে পারে নি। ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অপারেশন সার্চলাইটের নামে তারা শিক্ষক, ছাত্র, লেখক, পুলিশ, আনসার, ডাক্তার, সাংবাদিক, মসজিদের ইমাম, আলেম ওলামা, প্রকৌশলী, রাজনীতিবিদ, সেনাবাহিনীর জোয়ানসহ অগণিত নিরীহ সাধারণ মানুষের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাঙালিদের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। তাদের হিংস্র আক্রমণে ঢাকা মৃতের শহরে পরিণত হয়। হাজার হাজার মানুষ শহর ছেড়ে গ্রামে পালিয়ে যায়। তাদের এই পৈশাচিক হত্যা আর ধ্বংসলীলা দেখে সমগ্র বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলো। এরই প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে পরের দিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়। এরপর থেকে দেশের প্রতিটি প্রান্তরে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস এ যুদ্ধ চলে। এ সময়ে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে প্রাণ যায় লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতাকামী বাঙালির।

পাকিস্তানি শাসকরা শুধু গণহত্যা করেই ক্ষান্ত হয় নি। তারা চেয়েছিলো জাতি হিসেবে বাঙালিরা যেন কখনও মাথা তুলে দাড়াতে না পারে। কিন্তু পাকিস্তানিদের মনের বাসনা পূরণ হয় নি। ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধের একপর্যায়ে তারা কোণঠাসা হয়ে পড়লো। কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, সরকারী-বেসরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবি এবং সশস্ত্র বাহিনীর জোয়ানসহ দেশের অকুতোভয় সূর্যসন্তানরা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয় মহান স্বাধীনতা। সাথে উপহার দেয় একটি লাল সবুজের পতাকাও। স্বাধিকার আদায়ের এ লড়াইয়ে লক্ষ লক্ষ বাঙালির খুন শুধু ঝরে নি। পাকবাহিনীর হায়েনাদের হাতে লক্ষাধিক মা-বোনের ইজ্জত হয় লুণ্ঠিত। গৃহহীন হয় দেশের অধিকাংশ মানুষ। জন্মভূমির আত্মমর্যাদা রক্ষা ও স্বাধিকার আদায়ে যারা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশের নাম লিখিয়েছে তাদের ত্যাগ ও কুরবানী ইতিহাসের পাতায় সোনালী হরফে লেখা থাকবে।

দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে গেলেও মানুষের আশা আকাংখার প্রতিফলন ঘটেনি আজও। মানুষ আজও হাহাকার করছে স্বাধীনতার সুখ পাওয়ার জন্য। কিন্তু তা পাচ্ছে না। কেউ কারাগারের অন্ধকার থেকে, কেউ গৃহবন্দিত্ব থেকে, কেউ রাজপথ থেকে, কেউ বক্তৃতার মঞ্চ থেকে, কেউ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে, কেউ সংবাদপত্রের অফিস থেকে, কেউ লেখার টেবিল থেকে, কেউ প্রবাস থেকে, কেউ সীমান্তের কিনারা থেকে চিৎকার করে পরমপ্রিয় স্বাধীনতাকে ডাকছে। স্বাধীনতা তুমি কোথায়? তুমি কোথায়? কিন্তু স্বাধীনতা এসবের ধারেকাছেও নেই। যারা ক্ষমতাসীন তাদের হাতে আজ স্বাধীনতা বন্দি। তারা যেমন চান তেমন করে সাজতে পারেন। নাচতে পারেন। লিখতে পারেন। বলতে পারেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ তাদের কপাল খুলে দিয়েছে বলেই তারা স্বাধীনভাবে এগুলো পারছেন। এগুলো করছেন। আগামীতেও এ পথ অনুসরণ করে যারা ক্ষমতায় যাবেন তারাও পারবেন। তারাও করবেন। আর এটাই বাস্তবতা।

বহু ত্যাগের বিনিময়ে বাইরের পক্ষের শত্রুদের থেকে আমরা মুক্ত হতে পেরেছি। স্বাধীন হয়ে আমরা ঘরে ফিরেছি। কিন্তু ঘরের ভেতরে একটি সুন্দর ও সুখী সংসার গড়ে তুলতে আমরা ব্যার্থ হয়েছি রিতিমতো। হ্যা, সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ব্যক্তি জীবনে আমাদের অনেকের প্রাচুর্য এসেছে। আর্থিকভাবে আমরা অনেকেই লাভবান হয়েছি। কিন্তু সামষ্টিক জাতি হিসেবে আমাদের স্বচ্ছলতা অনেক পিছিয়ে। ধনীরা শুধু ধনী হচ্ছে, আর গরীব শুধু গরীবই হচ্ছে। দেশের জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এখনও দরিদ্রতার শেষ সীমার নীচে অবস্থান করছে। তাদের দারিদ্রতা বিমোচনে রাষ্ট্রের ভূমিকা সন্তোষজনক বলা যায় না।

স্বাধীনতার পরথেকে বারবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। কেউ জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতার মসনদে বসেছেন আবার কেউ স্বৈরাচারী কায়দায় বসেছেন। যে যেভাবেই বসুন না কেন, দেশ ও জাতির অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তন তারা করতে পারেন নি। পরিবর্তন করেছেন তারা তাদের নিজেদের। পরিবর্তন করেছেন তাদের পরিবার পরিজনদের।

আজকের সমাজের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, নীতিনৈতিকতা বলতে কিছুই নেই। নীতি, আদর্শ, নিষ্ঠা সব যেন আমরা ভূলতে বসেছি। সমাজের প্রতিটি স্থরে নীতিনৈতিকতার অবক্ষয় ঘটেছে চরমভাবে। অন্যায়, দুর্নীতি সমাজের আজ চরম ব্যাধি। সমাজের উপর থেকে একেবারে নীচ পর্যন্ত এ ব্যাধিতে আক্রান্ত। গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর শিক্ষা ভবনের পরিদর্শন ও নিরীক্ষণ অধিদপ্তরে ডিজিটাল মনিটরিং ব্যবস্থার উপর এক প্রশিক্ষণের সমাপনী অনুষ্ঠানে আমাদের শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছেন ‘শুধু যে অফিসাররা চোর তাই না, মন্ত্রীরাও চোর, আমিও চোর, এই জগতে এরকমই চলে আসতেছে।’ বক্তব্যের আরো একটি অংশে শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সহনীয় মাত্রায় ঘুষ নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এই হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তির মুখের কথা। মানুষ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলো, রক্ত দিয়েছিলো, প্রাণ দিয়েছিলো সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, ঘুষ ও দুর্নীতিমুক্ত একটি দেশ গড়তে। অসুস্থ রাজনীতি থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে। একটি সুন্দর, সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে। কিন্ত এগুলো কই? একজন মন্ত্রীর বক্তব্য থেকে আমরা কি বুঝতে পারি? “এসো দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ি” এসব আজ শুধু শ্লোগান আর বক্তৃতায় সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। বাস্তবে রূপ পাচ্ছে না।

আজকের বাংলাদেশে মানবাধিকার বলতে কিছুই নেই। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই। মিডিয়া কর্মীর স্বাধীনতা নেই। নিরাপত্তা নেই। মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা নেই। একজন লেখকের লেখার স্বাধীনতা নেই। অন্যায়, অবিচারের বিরুদ্ধে সভা-সমাবেশ করার অধিকার নেই। নারীদের ইজ্জত আব্রুর নিরাপত্তা নেই। প্রতিদিন নারীরা নির্যাতন হচ্ছে। ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে। গুম হচ্ছে। অপহরণ হচ্ছে। ঘর থেকে নিরাপরাধ মানুষদের মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরাধীরা বিনা সাজায় জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছে। আইন, আদালত, প্রশাসনসহ সবকিছু দলীয়করন করা হচ্ছে। সীমান্তে ভারতীয় বি এস এফ কর্তৃক দেশের মানুষ প্রায়ই হত্যার শিকার হচ্ছে। দেশের অকুতোভয় সূর্যসন্তানরা এসব পাওয়ার জন্য কি যুদ্ধ করেছিলো?

জাতি আজ হতাশ। চারিদিকে আতংক। সময়ের চাকা যতোই ঘুরছে মানুষের মনে ততোই দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা বেড়েই চলেছে। কিভাবে এ দেশ শান্তি হবে। কারা এ বর্বর সমাজ পরিবর্তনের উদ্যোগ নিবে। কবে মানুষ তার মৌলিক অধিকার ভোগ করতে পারবে। কখন জানমাল ইজ্জতের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। আর কতো বছর অপেক্ষা করতে হবে বৈষম্যহীন ইনসাফপূর্ণ সুন্দর একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার। এ সব কথা আজ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মুখে মুখে।

গোটা জাতির ভাগ্যের পরিবর্তনে দল-মত নির্বিশেষে সকলকে একযোগে কাজ করে যেতে হবে। উন্নত রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তা নিরসনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। নিজেদের কল্যাণে নয়, দেশ ও জাতির কল্যাণে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। ঐকমত্যে পৌছতে হবে। অতীতের সমস্ত ভেদাভেদ ও অন্তর্দন্দ্ব ভুলে জাতীয় কল্যাণের অনির্বাণ চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে সকলকে একযোগে কাজ করে যাওয়ার বিকল্প নেই।
-ফুজায়েল আহমাদ নাজমুল