স্বপ্নের পাকিস্তান, দুঃস্বপ্নের পাকিস্তান 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ২০ ২০২৩, ১৮:০২

ইয়ামিন আহমদ: উসমানী সম্রাজ্যের পতনের পর মুসলিম উম্মাহর খিলাফার যে স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়।সে স্বপ্ন পাকিস্তান গঠনের সময় পুনরায় জাগ্রত হয়।যাদের কলাকৌশলে উসমানী সম্রাজ্যের পতন হয়। তাদের লিডার ব্রিটেনকে দুমড়েমুচড়ে পাকিস্তান গঠন হয়।

পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে।উপমহাদেশের মুসলমানরা চায়নি ভিন্নজাতির সাথে একসাথে বসবাস করতে।কারণ মুসলমানরা তখন অন্যজাতির চেয়ে সংখ্যায় কম ছিলেন। সম্ভবনা ছিল হয়তো সংখ্যাগরিষ্টারা একসময় সংখ্যালগুদের উপর চড়াও হতে পারে।যেমনটা আমরা আজকাল ভারতে দেখছি। যার জন্য উপমহাদেশের সমস্ত মুসলিম মনিষী মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের পক্ষে জোর সমর্থন জানাচ্ছিলেন। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে ফলে গঠন হয় পাকিস্তান। যার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের রক্ষা।ইসলামি হুকুমতের পুর্ণ বাস্তবায়ন।

তখন দুইটা প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ট ছিলেন।সিন্ধু উপাত্যাকায় পাকিস্তান। পদ্মা-যমুনার তীরে পুর্ববঙ্গ।তথা আজকের বাংলাদেশ। সুতরাং নিয়ম অনুসারে যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ট সেটা হবে মুসলমানদের। সেই হিসেবে পাকিস্তানের নাম করণ হয় পশ্চিম পাকিস্তান।  পুর্ববঙ্গ হয় পুর্ব পাকিস্তান।

কিন্তু আফসোসের কথা হল। পাকিস্তান যখন গঠন হল।তার পুরো ক্ষমতা চলে গেল এমনসব লোকের হাতে।যারা মোটেই ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না।বরং কিছু লোক ইসলাম বিদ্বেষীও ছিলেন।যা হবার তাই হল।স্বপ্নের পাকিস্তানে এক সেকেন্ডের জন্যও ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্টা হয়নি। এখন পর্যন্তও না। এমনকি তাদেরকে যখন চাপ দেওয়া হয়েছিল ইসলামি হুকুমত বাস্তবায়নের জন্য। তখন তারা বলছিল “এটাতো রাজনৈতিক অঙ্গিকার।এটা বাস্তবায়নের কোন প্রয়োজন দেখছি না।

অনেককিছুর পরও যখন ইসলামি হুকুমত বাস্তবায়ন হলনা। তখন সবাই এর আশা ছেড়েও দিলেন।কারণ অনেকদিন যাবত বৃটিশ শাসনে থাকার দরুন অনেকেই ইসলামি হুকুমত বাস্তবায়নের জন্য বেশি প্রয়োজনবোধ করছিলেন না।যার ফলস্বরুপ ইসলামি হুকুমতের স্বপ্ন ধুলিস্যাত হল।

যেহেতু দুইটা অঞ্চল একত্রিত হয়ে একটা দেশ গঠন হয়েছিল।তখন উচিত ছিল ক্ষমতার সুষম বণ্টন। কিন্তু সম্পুর্ণ ক্ষমতা ছিল স্বজনপ্রীতিতে ডুবে থাকা,বর্ণবাদে বিশ্বাসী পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে।অথচ জনসংখ্যার দিক থেকে পুর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের সমান ছিল।

ক্ষমতা যেহেতু তাদের হাতে ছিল।অন্যদিকে ওরা ছিল প্রবল বর্ণবাদী। শুরু হল পুর্ব পাকিস্তানি তথা বাঙালীদের উপর অকথ্যা নির্যাতন। পাকিস্তান গঠনের পাঁচ বছর না পেরুতেই জারি হল নতুন নিয়ম। উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্টভাষা।ভাবা যায় একটা জাতির মাতৃভাষার উপর এটাক। বৃটিশরা ১৯৭ বছর শাসন করেও কখনই আমাদের মাতৃভাষার উপর আক্রমণ করেনি।যেখানে পাঁচ বছরেই কতবড় এটাক।এটা যে অনেকটা অসম্ভব। সেটা তারা জানত। সুতরাং বাস্তবায়ন করতে কি দরকার? সোজা কথায় অকথ্যা,অসহনীয় নির্যাতন।সুতরাং যারা এর প্রতিবাদ করবে।তাদের উপর লেলিয়ে দেওয়া হবে সরকারের পোষা কুকুরবাহিনী।পৃথিবীর যে কেউ এটা মানতে অক্ষম যে, তার মাতৃভাষা তার রাষ্টীয় ভাষা হবে না।শুরু হল আন্দোলন। ভাবতেই অবাক লাগে যে,ছাত্র-জনতার সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে গুলিবর্ষণ করা হয়।(পৃথিবীতে বাঙালিরাই প্রথম যারা নিজেদের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে) পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভাবছিল এতে হয়তো আন্দোলন শান্ত হবে।হলো উল্টো।ওরা জানত না।বাংলার বারো ভুঁইয়ার শারিরীক মৃত্য হলেও।তাঁদের শৌর্য-বীর্য এখন বাকি আছে।বিদ্রোহের লেলিহান শিখা বাঙালির অন্তরে জ্বলে উঠল।অবস্থা বুঝে পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলা ভাষাকেও পাকিস্তানের রাষ্টীয় ভাষা ঘোষণা দিতে বাধ্য হল। ভাষা আন্দোলনই ছিল আমাদের পাকিস্তান মুক্তির সোপান। আমাদের স্বাধীনতার প্রেরণা।

বসে নেই পাকিস্তানিরা। থেমে নেই নির্যাতন।অপরদিকে বাঙালিও চুপ নেই।নির্যাতন হচ্ছে।প্রতিবাদ হচ্ছে।তবে বাঙালিরা সবসময় শান্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ায় এগুচ্ছিল।

পাকিস্তানিরা কি পরিমাণ বর্ণবিদ্বেষী ছিল।পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালির অংশগ্রহণ দেখলে বুঝা যায়। ১৯৬৫সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আগে বাঙালিদের জন্য পাক আর্মিতে নিয়োগ পাওয়া রীতিমতো হাতে চাঁদ পাওয়ার মত ছিল।কিন্তু কার্গিল যুদ্বে বাঙালির বিরত্ব দেখে তাদের কিছুটা টনক নড়ে।যারফলে পরবর্তীতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নামে একটা রেজিমেন্ট খুলে বাঙালিদের জন্য সেনানিয়োগে বাধা কমায়।

সেসময় পুর্ণ পাকিস্তানের অর্থনীতিতে পূর্ববঙ্গের অবদান ছিল ৫৬%।অথচ বাংলায় সবসময় দুর্ভিক্ষ চলত।না খেয়ে মানুষ মারা যেত।বাঙালির উৎপাদিত সবকিছুই চলে যেত পাকিস্তানে।আর সেগুলো বিক্রি করে ভারতকে ভয় দেখানোর জন্য অস্ত্রের ভান্ডার মজবুত করত।

বাঙালিরা সেই আদীমকাল থেকেই কাপড় বুননে অতুলনীয় ছিল।পাকিস্তান গঠনের পর টেকনোলজির সাথে পাল্লা দেওয়ার জন্য দরকার ছিল একটা জুট মিলের।অনেক চেষ্টার পর যখন জুটমিল জুটল। নাম হলতখন ইয়াহইয়া খান বলল এটা আমার পক্ষ থেকে তোমাদের জন্য উপহার।যেন জুটমিলটা ইয়াহইয়া খানের মৌরুসি সম্পদ।

থেমে নেই ক্ষমতার অপব্যবহার।বসে নেই বাঙালিরা।বিদ্রোহের আগুন অন্তরে জ্বলজ্বল করছে।এবার আমরা চাইলাম আমাদে অধিকার। রাষ্ট্রের ক্ষমতা আমাদের হাতে দেওয়া হক।আমরা ভিন্নজাতীর ক্ষমতায় থাকতে চাই না।শুরু হল রাজনৈতিক শোষন।বাঙালি সব নেতারা জেলে।কিন্তু আন্দোলন থামার নাম নাই।বাধ্য হয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা।নির্বাচনে এমন গো হারা হারল যে পাকিস্তানি সব নেতারা বিহ্বল হয়ে গেল।

জাতীয় পরিষদে যখন ক্ষমতা গ্রহণের জন্য বাঙালিরা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল।তখনই ইয়াহইয়া খান জাতীয় পরিষদ বন্ধের ঘোষণা দিল।এবার আগুনে ঘি পড়ল।ক্ষমতা হস্তান্তরের আন্দোলন ধীরে ধীরে রুপ নিল স্বাধীনতা আন্দোলনে।

তৎকালীন পাকিস্তানি নেতারা কি পরিমাণ বর্বর ছিল সেটা মুক্তিযুদ্ধে আমরা দেখতে পেয়েছি।এমনকি এরা বাঙালিকে নেতৃত্বশুন্য করার জন্য আমাদের সব বুদ্ধিজীবীদেরকে একই সাথে হত্যা করেছিল।বাংলাদেশের বিপক্ষে যুদ্ধকে জায়েজ বানানোরও পায়তারা করছিল।এমনকি তারা বাঙালীকে একটা ইসলামি দেশের বিরোধিতার জন্য মুরতাদ বানিয়ে তাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করাকে জিহাদ বানানোর চেষ্টাও করছিল।মানে সুযোগ পেয়ে ইসলামকে ব্যবহার করছিল।

অথচ পাকিস্তান গঠনের পর এক সেকেন্ডের জন্যও সেখানে ইসলামি হুকুমত বাস্তবায়ন হয় নি।আরো আশ্চর্যের কথা হচ্ছে তারা যুদ্ধে আমাদের দুলক্ষ মা-বোনের ইজ্জত লুটেছিল।অথচ ইসলামের নামে এগুলো বৈধ চালিয়ে দেওয়ার অসৎ চেষ্টায় লিপ্ত ছিল।যেখান ইসলাম বলে” যুদ্ধে নারীদের উপর আক্রমণ করা যাবে না।

আজকের দিনে আমরা যারা স্বাধীন বাংলাদেশী,বাঙালী।তারা হয়তো বর্তমান পাকিস্তান দেখে অনেককিছু ভাবছি।আমাদের প্রতি পাকিস্তানীদের ছলনাময়ী প্রেম ভিন্নকিছু ভাবায়।আসলে সেগুলো সব বানোয়াট। ওরা আমাদের প্রতি যা করছে। পৃথিবীতে থাকা কোন মুসলিম জাতি তো দুর, অন্যকোন জাতি নিজ জাতীর উপর এতটা অত্যাচার করে নি।পৃথিবীর ইতিহাসে কোন জাতি কারো মাতৃভাষায় আঘাত করে নি।পাকিস্তানিরা সেটা করে দেখিয়েছে। এমনকি আমাদের আন্দোলনরত ভাইদেরকে হত্যা করতেও দ্বিধা করেনি।

একবার ভাবি,আজ যদি আমরা পাকিস্তানের সাথে সম্পৃক্ত থাকতাম। তাহলে কি হত? আমরা ঠিকমত খেতেই পারতাম না।বাংলাদেশ হত আরেক কাশ্মির কিংবা বেলুচিস্তান।একবার ভাবি পাকিস্তানের অর্থনীতি বর্তমানে কত খারাপ।দ্রব্যমুল্যের দাম আকাশচুম্বী। মানুষ খেতে পারছে না ঠিকমত।নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য টাকা দিয়েও কেনা যাচ্ছে না।কারণ ডলারের রিজার্ভ কমে যাওয়ায় এসব আমদানি করা যাচ্ছে না।এইসব পরিস্থিতিতে পাকিস্তান কি করত?সোজা কথায় ওরা আমাদেরকে ক্ষুধার্ত রেখে আমাদের উৎপাদিত সবগুলোই পাকিস্তানে সাপ্লাই করে দিত। এটা যাস্ট সম্ভাবনা নয়।নিশ্চিত।

বর্তমানে যারা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে মাসুম ভাবেন। তাদেরকে বলে দিতে চাই।একটু পাকিস্তানের বেলুচিস্তানের খবর নিন।দেখেন সেখারকার সেনাবাহিনীর পরিস্থিতি। এখন হয়তো বলবেন যে বেলুচিস্তানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অত্যাচার করে। পাকিস্তানিরা বা তাদের জাতীয় নেতারা নয়।তো বলে রাখি সেই সেনাবাহিনী উঠে আসে সাধারণ জনগন থেকে।আর পাকিস্তানের নেতৃত্ব দেয় পাকআর্মি।আর পাকআর্মি চলে আমেরিকার কথায়।যেটা সবাই জানে।একটা উদাহরণ দেই। ইমরান খানকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্ষমতায় বসিয়েছিল।যতদিন সেনাবাহিনীকে তিনি তোষামোদ করে যাচ্ছিলেন। ততদিন তিনি গদিতে ছিলেন।একটু এদিকসেদিক হওয়া মাত্রই টেনেহিঁচড়ে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছে।এমনকি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে দিচ্ছে না। সেইম বাংলাদেশের মত।যেটা ইমরান খানও ক্লিয়ার করে বলছিলেন

আজ পর্যন্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী একথার উপর কোন আফসোস নেই যে ,তারা বাংলাদেশের উপর নির্যাতন করেছে।অথচ তারা প্রায় ৩০লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল।কত বর্বর হলে এত নিষ্ঠুর মন হয়।এখানে যদি আপনি আমেরিকা আর আফগানিস্তানের বিষয় টেনে আনেন।তবে সেটা ভুল হবে।কারণ আমেরিকা যাদেরকে হত্যা করেছে। তারা কেউ আমেরিকান ছিল না।বরং ভিন্ন ধর্মীয় ছিল।কিন্তু পাকিস্তানীরা যাদের হত্যা করেছে তারা ৯০% মুসলমান ছিল।পাকিস্তান মুসলমান হয়ে একটা মুসলিম দেশের উপর হামলা করেছে।দোষ ছিল ঐ দেশটা তার অধিকার দাবী করছিল।

আজ আমরা স্বাধীন। আজ আমাদের নিজস্ব পতাকা আছে।আজ আমাদের আমরাই বহির্বিশ্বে নিজস্ব পরিচয় আছে।আমরা বাংলাদেশী। আমরা বাঙালি।