সুস্থ চিন্তা-ধারার মানুষ গড়তে সঠিক দিক-নির্দেশনা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ২০ ২০২০, ২৩:১৭

আমরা কতটা সুস্থ চিন্তাধারায় গড়ে উঠছি আর নতুন প্রজন্মকে কতটা সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে পারছি তা সত্যিই আজ মোটা দাগে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে । সাধারণত সচেতন পরিবারগুলোর প্রতিটি অভিভাবকদেরই একটাই স্বপ্ন- তাদের পরিবারের সন্তানরা ক্রমাগত সবচেয়ে ভালো রেজাল্টের সহিত উচ্চ শিক্ষিত হয়ে উচ্চ ক্যারিয়ারধারী হবে, আর সে লক্ষ্যেই সন্তানদেরকে তারা নানা দিক-নির্দেশনা ও তদারকি দ্বারা গড়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যায় । একটি দেশের উন্নয়নের জন্য মেধা সম্পন্ন নাগরিক গড়ে তোলা যেমন অপরিহার্য, আর দেশের সেই উন্নয়ন বাস্তবায়ন করতে ক্যারিয়ারধারী সুস্থ ধারার সৎ মানুষের বিকল্প নেই । কেউ উচ্চ ক্যারিয়ারধারী কিন্তু সৎ মানুষ নন, তাহলে তার কাছ থেকে দেশ ও জাতি কতটা আশা করতে পারে ? আজকাল বালিশকান্ডসহ নানা দুর্নীতি কিন্তু অশিক্ষিত কারো দ্বারা হচ্ছে না, বড় বড় সব দুর্নীতিগুলো অবলীলায় ঘটে যাচ্ছে উচ্চ ক্যারিয়ারধারীদের দ্বারাই, আর এ দুর্নীতি যেন স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের পিছু ছাড়ছেই না, যার কারণে ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের উন্নয়ন কাঙ্খিত মাত্রায় হচ্ছে না, মুখ থুবরে পড়তে হচ্ছে বারবার, আর এ ঘানি টানতে হচ্ছে সর্ব সাধারণকেই । তাই শুধু উচ্চ ক্যারিয়ারধারী হলেই হবে না, সুস্থ চিন্তাধারার ভালো মানুষ হতে হবে ।

আমাদের অনেকেই নিজের অজ্ঞতা বশত উঠতি বয়সী কিশোর-কিশোরীদের বিষয়ে একটা কথা বলে দেন যে, ওদেরকে ছেড়ে দেওয়া হোক, ওরা ওদের চিন্তা মোতাবেক চলতে থাকুক, ভালো মন্দ নিজেরাই বুঝে চলুক, কোন কিছু যেন ওদের উপর চাপিয়ে দেওয়া না হয় ! প্রকৃতপক্ষে সঠিক দিকনির্দেশনা ব্যতিত এমন চিন্তা ধারা শুধু ভুলই নই, আত্মঘাতীও বটে । এতে তাদের চিন্তাশক্তির বিকাশটা ভুল পথে বেড়ে উঠতে পারে, তাদের চলার পথটাও হতে পারে কন্টকাকীর্ণ । শিশু কিশোররা প্রতি ক্ষেত্রেই অত্যধিক কৌতুহলপ্রিয় হয়, এটার একটাই কারণ, তারা জানতে চায়, বুঝতে চায় । কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ সেটা তারা শুরুতেই বুঝতে পারে না, তাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হয় সঠিক দিক-নির্দেশনার মাধ্যমে, তাদের চলার পথকে সহজ করে দিতে হয় । আর তাদেরকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে ব্যর্থ হওয়া মানে তাদের উপর জুলুম করা, তাদের জীবনকে কঠিন করে দেওয়া, আলো-আধারের দোদল্যতায় ফেলে দেওয়া, তাদের ভালো-মন্দে নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা তখন ফিফটি ফিফটি হয়ে যাওয়াই নয়, বরং ভুল চিন্তা বা মন্দ পথের দিকেই ঝুঁকে পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে ।

আমরা কি কখনো এটা ভাবি যে, আমাদের চিন্তা-ধারা যা পরিবারের অনুজদের দিক-নির্দেশনায় ব্যবহৃত হচ্ছে তা ধর্মীয় আলোকে কতটা ঠিক আছে ? অনুজরা বাহিরে কাদের সাথে মিশছে বা কাদেরকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করছে তা কি কখনো খোঁজ নিয়ে দেখেছি ? বন্ধু-বান্ধব যদি বিপথগামী হয় বা সুস্থ চিন্তা-ধারার না হয় তাহলে খুব সহজেই তারা সেই বন্ধু-বান্ধব দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তাদের মত অসুস্থ চিন্তা-ধারার হয়ে যেতে পারে, এমনকি অপরাধ কর্মকাণ্ডেও লিপ্ত হতে পারে । আমাদের হুঁশ হয় তখন, যখন বিপদ ঘাড়ে এসে পড়ে ।

পরিবারের অনুজদের সুস্থ চিন্তা-ধারায় বেড়ে উঠতে দরকার ইহকাল-পরকাল কেন্দ্রিক সুচিন্তিত সঠিক দিক-নির্দেশনা, নৈতিক শিক্ষা দান, ভালো পরিবেশ ও সঠিক তদারকি । তাই প্রতিটি পরিবারের অভিভাবকদের উচিত সুস্থ ধারায় নিজে বিকশিত হওয়া এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সে আলোকে গড়ে তোলা অথবা পরিবারে বেড়ে উঠা শিক্ষিত কাউকে সে দায়িত্ব পালন করা । শিক্ষিত মানে শুধু লেখাপড়া করে উচ্চ ডিগ্রিধারী হওয়াই নয়, প্রকৃত শিক্ষিত তারাই যারা সমস্ত অন্ধকার থেকে নিজেদেরকে আলোকিত রেখে সঠিক পথে চলে বা চলার সর্বাত্মক চেষ্টা করে, মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটায় এবং অন্যদেরকেও সেই শিক্ষাই দেয়, নিছক আবেগের বশে মনুষ্যত্বকে ভুলণ্ঠিত করে না কিংবা দলান্ধ হয়ে সর্বদা দোষ ঢাকার চেষ্টা করে না, পরিবারের কাউকে দলান্ধ করে সঠিক জানা থেকে বঞ্চিত করে না ।

অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন প্রিয় স্কুল আহমেদপুর এম. এইচ. উচ্চ বিদ্যালয়ের (বড়াইগ্রাম, নাটোর) প্রিয় এক শিক্ষক আইয়ুব স্যারের একটি উক্তি এখনো মনে পড়ে-

“আজ আমি যদি তোদের ভুল শেখাই, তাহলে হয়তো তোরা ধরতে পারবি না, কিন্তু যখন তোরা উচ্চ শিক্ষিত হবি, মাস্টার্স পাশ করবি তখন আমার এ ভুল শেখানোটা তোরা সহজেই ধরতে পারবি, বুঝতে পারবি, যেটা আমার জন্য লজ্জার, হয়তো আমাকে গালিও দিবি, তাই ভুল শেখাতে নেই, আর এটা আমি কখনই করবো না ” স্যারের এ কথা হৃদয়ে আজও স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে । খুব ঘনিষ্ঠ, জ্ঞানদীপ্ত সাব্বির ভাই একটি কথা বলেছিলেন- “কেউ আগুনে পড়তে যাচ্ছে এমন লোককে কিছুটা আঘাত দিয়ে হলেও সে আগুন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করুন ।” কথাগুলোর মধ্যে রয়েছে যথেষ্ট শিক্ষা । আর ভালো শিক্ষাই পারে প্রকৃত মানুষ হিসাবে গড়ে তুলতে ।

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন-

“আর তোমাদের মধ্যে এমন একটা দল থাকা উচিত যারা আহ্বান জানাবে সৎকর্মের প্রতি, নির্দেশ দিবে ভালো কাজের এবং বারণ করবে অন্যায় কাজ থেকে, আর তারাই হলো সফলকাম (সূরা আল ইমরান, আয়াত- ১০৪)

মহানবী (সা.) বলেন-

“সন্দেহ নেই, যিনি মানুষকে কল্যাণের শিক্ষা দেন, তার প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন। তাঁর ফেরেশতাকুল, আকাশসমূহ ও পৃথিবীর অধিবাসীরা, এমনকি গর্তের ভেতরে থাকা পিঁপড়াও, এবং মাছও এ ব্যক্তির জন্যে দুআ করে। (জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮৫) ।”

মহান আল্লাহ তাআলা সৃষ্টির শুরু থেকেই যুগে যুগে মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য অসংখ্য নবী রাসুল প্রেরণ করেছেন । আর সে উদ্দেশ্যেই মানবজাতির পথ প্রদর্শক শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে পৃথিবীতে রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছেন এবং সাথে তার উপর মহাগ্রন্থ আল কুরআনও নাযিল করেছেন । কেউ যদি কোন রকম দিক নির্দেশনা ব্যতিত সঠিক পথে নিশ্চিতভাবে ধাবিত হতেই পারতো তাহলে যুগে যুগে মানুষকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে আল্লাহ বিভিন্ন নবী রাসূলকে পৃথিবীতে পাঠাতেন না । মহানবী (সা.) সারাজীবন মানুষকে সঠিক পথের দিকে আহ্বান করেছেন, তাদেরকে বিপথগামীতা থেকে মুক্তি দিয়ে একটি সুন্দর ও কল্যাণকর সমাজ, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে গেছেন । তার আহ্বানে মানুষ অন্ধকার পথ ছেড়ে ভালোর দিকে অগ্রগামী হয়ে ইহকাল ও পরকালের সুখী-সমৃদ্ধ জীবন লাভ করেছে ।

মানুষকে গড়ে উঠতে হবে উত্তম পন্থায় উত্তম আদর্শে । কোন প্রতিবন্ধকতাই যেন সঠিকটা বিচার করতে তার মনকে প্রভাবিত করতে না পারে । বাংলাদেশে সাধারণত দেখা যায় যে অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা কিছু অন্ধ বিশ্বাস, ভালোবাসা নিয়ে বড় হয় যা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক বিচার বিশ্লেষণ করতে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় এবং দেখা যায় যে নিজের অজান্তেই অন্ধ আবেগে ভুল বিচার করে থাকেন । অন্ধ আবেগ মানুষকে তার চিন্তা-চেতনা ও বাস্তব পদক্ষেপে পথচ্যুত করবেই । একজন সুনাগরিক তৈরি করতে পারা মানে শুধু একটা নির্দিষ্ট সময়কালীন দেশ ও জনগণের জন্য যে কল্যাণকর তা নয়, তার দ্বারা গড়ে উঠবে আরো অসংখ্য সুনাগরিক, একটি সুন্দর পরিবেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র । পরকালহীন ইহকাল কেন্দ্রিক শিক্ষা কচু পাতার উপর ভেসে থাকা সেই চকচক করা পানির ফোটার মতই যার অস্তিত্ব খুব ক্ষণস্থায়ী, অল্প বাতাসের প্রবাহেই যা হারিয়ে যায়, যার সৌন্দর্য কিংবা অস্তিত্ব তেমন কোন কাজেই আসে না । তাই দেশ, সমাজ ও পরকালীন কল্যাণের জন্য মানুষ গড়ে উঠুক সুস্থ চিন্তা-ধারায় ।

লেখক: মোঃ আমীর হামজা

ফার্স্ট এক্সেকিউটিভ অফিসার

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড