সিয়াম সাধনার মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

এপ্রিল ২৫ ২০২০, ২০:২০

।। এহসান বিন মুজাহির ।।

বাংলাদেশের পশ্চিমাকাশে এক ফালি রুপালি বাঁকা চাঁদের উদয়ের মধ্যে দিয়ে শুরু হলো মাসব্যাপী সিয়াম-উৎসব। কঠোর আত্মসংযম, বাক সংযম, রিপুর দমন, সীমালঙ্ঘন থেকে ফিরে আসার এলো অবারিত সুযোগ। ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে পুণ্যসিক্ত, আল্লাহর নৈকট্য ও অনুগ্রহধন্য হবার দুয়ার আজ থেকে উন্মুক্ত।
রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে শুরু হওয়া পবিত্র রমজানুল মোবারকের রহমতের প্রথম দশকের প্রথম দিন আজ। আত্মশুদ্ধি, নৈতিক প্রশিক্ষণ ও আত্মগঠনের মাস পবিত্র রমজান। বছরের এক মাসব্যাপী রোজা পালনের উদ্দেশ্য নিছক উপবাস থাকা নয়, এর মূল উদ্দেশ্য তাকওয়া অর্জন। মানুষের মধ্যে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জনের লক্ষ্যে মাহে রমজানের পূর্ণাঙ্গ একটি মাস রোজা রাখা ফরজ করা হয়েছে। এ মাসে পরিশুদ্ধ হওয়ার ও আখেরাতের জন্য কামাই করার অবারিত সুযোগ।

মুমিনের জন্য নেকি অর্জনের ভরা মওসুম হলো রমজান। ব্যবসায়ীদের জন্য যেমন একটি বিশেষ মৌসুম থাকে তখন তাদের ব্যবসা হয় খুব লাভজনক এবং জমজমাট। ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটি কাজে লাগানোর জন্য দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করে এবং এর জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি গ্রহণ করে, তেমনি রমজান মাস হলো আখেরাতের ব্যবসায়ীদের জন্য, আল্লাহ বিশ্বাসীদের জন্য নেকি কামাই করার মওসুম। রোজা ফরজের মহৎ উদ্দেশ্যের অন্যতম বিষয় হলো, বান্দা যেন আল্লাহর ভয়ে ভীত থাকে সর্বদা।

আর এই ভয়টাকে বলে আরবিতে ‘তাকওয়া’ বা খোদাভীতি। সব ফরজ, ওয়াজিব পালন করে হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার নাম ‘তাকওয়া’। হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রা.) বলেছেন, তাকওয়ার অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করা, তাঁর নাফরমানি না করা ও তাঁর কুফরি না করা।রএসম্পর্কে পবিত্র কুরআনুল কারীমের সূরায়ে বাকারার ১৮৩ নাম্বার আয়াতে আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেন-‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমনিভাবে তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও ফরজ করা হয়েছিল। যাতে তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো’। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি অধিক মর্যাদা সম্পন্ন, যে অধিক মুত্তাকি’। (সূরা হুজরাত : ১৩)

এব্যাপারে কেুরআন কারীমে আরও এরশাদ হয়েছে- আল্লাহ অবশ্যই মুত্তাকিদের আমল কবুল করেন। (সুরা মায়েদ : ৫৭)। অন্য আয়াতে বলা হচ্ছে- যারা তাকওয়া অর্জন করে ও নিজের আচার-আচরণকে সংশোধন করে, তাদের কোনো ভয়-ভীতি ও পেরেশানি নেই’। (সুরা আরাফ:৩৫)।
তাকওয়াধারী মূলত আল্লাহররকাছে সর্বাধিক প্রিয়, সম্মানিত। তিনি বলেন-তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত যে অধিকতর তাকওয়া অনুসারী’। ( সুরা হুজুরাত :১৩)

রোজা মুত্তাকির জন্য এক অফুরন্ত নেয়ামতস্বরূপ। কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মুত্তাকি ক্ষুধা, পিপাসা, কাম, ক্রোধ, লোভ-লালসা পরিত্যাগ করে রোজা পালনে বব্রতী হন। এপ্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন-‘যে ব্যক্তি মাহে রমজানের রোজা পালন করতে গিয়ে রোজার সীমারেখা বুঝে নেবে এবং যে কর্তব্য রোজার ভেতর পালন করা বাঞ্ছনীয়, তা সুচাররুভাবে পালন করে চলবে, তার এরূপ রোজা তার বিগত গুনাহের ক্ষমার কাফফারা হয়ে যাবে’। (বায়হাকি : ১৩৬১)

রমজান মাসটি অন্য মাসের মতো নয়। রোজার মাধ্যমে অন্তরে আল্লাহভীতি ও ঈমানি লজ্জত সৃষ্টি হয়। রোজাদার ক্রমে গুনাহ থেকে দূরে সরতে থাকে। রোজা তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে রক্ষাকারী ঢাল স্বরুপ হয়ে যায়। তবে এর জন্য শর্ত হলো গিবত-শেকায়েত ও মিথ্যা কথা ও প্রতারণাসহ সকল পাপাচার থেকে বেঁচে থাকতে হবে। তাকওয়ার মাধ্যমেই বান্দা ইহকাল ও পরকালে তার মর্যাদাকে বৃদ্ধি করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে পরম সম্মানিত হয়। যত প্রকার ইবাদত ও বিধি বিধান আছে, সব কিছুর মূলে হলো তাকওয়া। তাকওয়া হাসিল হওয়ার পর মানুষের হৃদয় আল্লাহর দিকে গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। তেমনিভাবে রমজান মাসে রোজাদার তাকওয়া ভিত্তিক চরিত্র গঠনের নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।

যিনি মুত্তাকী বা পরহেজগার হবেন, তিনি যাবতীয় খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকবেন এবং ভালো কাজের অনুশীলন করবেন। এই মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি ও তাকওয়া অর্জন করা করা সম্ভব। তবে আত্মশুদ্ধির পূর্বে ন্যায়ের আদেশ, অন্যায় কাজ থেকে দূরে থাকতে হবে। হারাম বর্জন করে হালাল রিজিক খেতে হবে। পারিবারিক হকসমূহ যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। ইসলামী শরীয়তের যাবতীয় কাজ কর্ম সঠিকভাবে পালন, সুদ ও ঘুষ থেকে দূরে থাকতে হবে। গরিব দুঃখী, অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বিশেষ করে করোনা দুর্যোগে পড়া ঘরবন্দি কর্মহীনএবং অসহায় অসচ্ছল মানুষের সাহয্যে এগিয়ে আসতে হবে। সমাজের আনাচে-কানাচে ঘটমান অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। তবেই সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া বা আত্মশুদ্ধির গুণ অর্জন করা সম্ভব হবে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে তাকওয়া অর্জন করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে। ব্যক্তির মাঝে তাকওয়া না থাকলে, ব্যক্তি বিবেকহীন হয়ে পড়বে। ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা হারাবে। সুতরাং রহমতের মাসে রোজা পালন করে তাকওয়া অর্জন, বরকতের মাসে বেশি বেশি দান-খয়রাত করার অভ্যাস তৈরি করে দানবীর এবং মাগফেরাতের মাসে জীবনের যাবতীয় গুনাহ আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিজেকে মুত্তাকী বান্দাহ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। তবেই মাহে রমজানের তাকওয়া অর্জন করা সম্ভব হবে।

রমজান কোনো উৎসব-অনুষ্ঠানের নাম নয়। বরং তা হচ্ছে পানাহার, স্ত্রী সম্ভোগের বাহ্যিক চাহিদাগুলো পরিত্যাগ করার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ যাবতীয় ত্রুটিবিচ্যুতি দূর করে অন্তরকে পরিশুদ্ধ করণের নাম। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি রোজা রেখেও মিথ্যা কথা ও প্রতারণার কাজ পরিত্যাগ করে না, তার পানাহার বর্জনে আল্লাহ তায়ালার কোনো প্রয়োজন নেই’। (তিরমিজি : ২৭৩১)। আল্লাহর রাসূল সা. তাই বার বার বেহুদা ও বাজে কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ প্রদান করেছেন। এপ্রসঙ্গে রাুসুলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন- পানাহার বর্জনের নাম রোজা নয়। রোজা হলো অনর্থক ও অশ্লীল কথা-কাজ বর্জন করার নাম। কে তোমাকে গালি দিলে বা তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলে তুমি তার সঙ্গে তেমনটি না করে কেবল এটুকুই বলো আমি রোজা রেখেছি, আমি রোজা রেখেছি’। (বুখারি :১৫৩৪)। বাহ্যিক সব নিয়মকানুন মেনে রোজা রাখি বটে কিন্তু বাজে কথা ছাড়তে পারি না, এর দোষ ওকে বলি, সামান্য বিষয় নিয়ে কলহে নেমে পড়ি, লাভের লোভে মিথ্যে কথাও বলে ফেলি; এর ফলে বাহ্যিক বিধিগতভাবে রোযা ভেঙে গেছে বলা যদি না-ও যায়, তবু এতে সন্দেহ নেই যে, উদ্দেশ্যগতভাবে এ রোযা নিষ্ফল, নিরর্থক, নিষ্প্রাণ।

চারিত্রিক শুদ্ধি অর্জনে সচেষ্ট না হলে, যাচ্ছেতাই বকবক করার পুরনো অভ্যেস বহাল রাখলে, কষ্ট করে ক্ষুধা-তৃষ্ণা সহ্য করে এবং রাত জেগে দীর্ঘ নামায আদায় করে কোনো লাভ নেই। কেননা রাসূল সা. বলেছেন-অনেক রোযাদার এমন, যারা রোযা রেখে কেবল ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কষ্ট পাওয়া ছাড়া আর কিছুই পায় না; আর যারা রাত জেগে নামায আদায় করে তাদের মধ্যেও এমন বহু লোক আছে, নামাযে দাঁড়িয়ে রাত জেগে কষ্ট করা ছাড়া যাদের আর কোনো লাভ হয় না। (ইবনে মাজহ : ১৬৯০)। রোজা যেনো অন্ত:সারশূন্য আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত না হয় এবং তা যেন একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যেই পালন করা হয়, সে জন্য মাহে রমজানে তাকওয়াভিত্তিক সমাজ গঠনের প্রতিও বিশেষ তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে রোজা যথাযথ হক আদায় করে রোজা পালনের তাওফিক দান করুন।


লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও অধ্যক্ষ, শ্রীমঙ্গল আইডিয়াল স্কুল, মৌলভীবাজার।