সমাজে অপরাধ প্রবণতা বাড়ার কারণ ও তার প্রতিকার

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ২৯ ২০২০, ২০:০৮

একটি দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে কিছু আইন প্রণয়ন করা হয়, আর সেই আইন ভঙ্গ করে কেউ যখন কোন কর্ম সম্পন্ন করে তখন তাকে অপরাধ বলে। সাধারণত দেশের আইনবিরুদ্ধ কাজই অপরাধ।

বর্তমানে করোনার কারণে মানুষ যখন দিশেহারা তখন একশ্রেণীর মানুষ হীন উদ্দেশ্যে তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুণ মাত্রায় । হত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধে যেন নতুন মাত্রা পেয়েছে বাংলাদেশে যা সত্যিই খুব হতাশাজনক ও আতঙ্কের বিষয় । বর্তমানে নিরাপত্তা বাহিনী যখন করোনা থেকে সবাইকে রক্ষার্থে ব্যস্ত, এমনকি নিজেরাও এতে আক্রান্ত হচ্ছে ও তা থেকে নিজেকে রক্ষায় সংগ্রাম করে চলেছে যেখানে ইতিমধ্যে অনেকেই মারা গেছেন ঠিক সেই সময়ের সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি করে দিয়েছে কয়েকগুণ মাত্রায়।

একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার, প্রতিনিয়তই সমাজে নতুন নতুন অপরাধীর সৃষ্টি হচ্ছে, যার কারণে আক্রান্তদের অনেকেই কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের সর্বনাশা অপরাধ কর্মকাণ্ডের শিকার হচ্ছে, যেমন অনেক জায়গায় ত্রাণ বা সাহায্যের কথা বলে শিশু ও মহিলা ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে । পাবনাতে একটি অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার পরিবারের ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে, যাদের মরদেহ পুলিশ গত ৫ই জুন তাদের বাসা থেকে উদ্ধার করে । অভিযোগ উঠেছে, দীর্ঘদিন যাবত সন্তানের ভালোবাসায় স্থান দেওয়া এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে, যাকে পরের দিন ৬ই জুন পুলিশ গ্রেফতার করে, যার সংবাদ ৭ই জুন দৈনিক ইত্তেফাক ও প্রথম আলো পত্রিকায় আমরা দেখতে পাই । একটি দেশে মানুষের প্রধান চাওয়া থাকে স্বাভাবিক চলাফেরা ও কর্মকান্ডে নিরাপত্তা । নিরাপত্তা থাকলেই সাধারণ ও উন্নয়নমূলক সমস্ত কর্মকান্ড পরিচালনা করা সম্ভব, অন্যথায় সমাজ ও দেশ ধ্বংস হতে বাধ্য । অথচ প্রতিনিয়তই নারী ও শিশু ধর্ষণের পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, ঘটে চলেছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ হত্যাকাণ্ডও।

সমাজে কেন এই অপরাধ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে তার সঠিক কারণ অনুসন্ধান এবং সেই সাথে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিকার করতে না পারলে এই অপরাধ কখনই থামানো সম্ভব নয়।

সমাজে অপরাধ প্রবণতা কেন বাড়ছে তার প্রধান কয়েকটি কারণ উল্লেখযোগ্য-

১) অপরাধীর উপযুক্ত বিচার না হওয়া,

২) সৃষ্টিকর্তাভীতি তথা তাকওয়া শুন্যতায় নৈতিক চরিত্রের অধঃপতন,

৩) রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা,

৩) অপরাধীর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা,

৪) দারিদ্র্যতা,

৫) উপযুক্ত নৈতিক শিক্ষা ও পরিবেশের অভাব।

প্রতিনিয়ত যারা বিভিন্ন ধরণের অপরাধ করে চলেছে তাদেরকে যদি আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হতো তাহলে সমাজ থেকে অপরাধ বহুলাংশে কমে যেত, নতুন করে কেউ অপরাধ করার সাহস করতো না, কিন্ত আদৌ কি তা হচ্ছে ? সাধারণ জনগণের মাঝে সঠিক বিচার পাওয়া নিয়ে রয়েছে যথেষ্ট শঙ্কা।

সৃষ্টিকর্তা মানুষকে সঠিক দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন কিভাবে তার জীবনকে পরিচালিত করতে হবে। বান্দার ভালো কাজের ফলস্বরূপ যেমন তিনি পরকালে মহা পুরষ্কার দানের ঘোষণা দিয়েছেন, তেমনি খারাপ কাজের ফলস্বরূপ রেখেছেন তার জন্য উপযুক্ত শাস্তি। কোন ব্যক্তির মনে যখন পরকালের ভয় থাকবে এবং শয়তানের ধোঁকা থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারবে তখন ঐ ব্যক্তির পক্ষে জেনেশুনে সুস্থ-মস্তিষ্কে অপরাধ করা সম্ভব নয় । এক্ষেত্রে অনেকেই বলতে পারেন যে তাহলে ধার্মিক ব্যক্তি কর্তৃকও কেন অপরাধ সংঘটিত হয় ? ধার্মিক ব্যক্তিরাই যদি সমাজে অপরাধ করে তাহলে অন্যরা কি করবে ? মানুষ আর তাহলে কাকে বিশ্বাস করবে ? এক্ষেত্রে একটু গভীরভাবে উপলব্ধির বিষয় রয়েছে যে সমাজের অধিকাংশ খারাপ কাজগুলো কিন্তু ধার্মিক ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে না, সেগুলো হচ্ছে অন্যদের দ্বারা যারা ধর্মের ধারও ধারে না কিংবা সাধারণ মানুষ । অথচ কোন ধার্মিক ব্যক্তি কর্তৃক সমাজে হঠাৎ কোন অপরাধ সংঘটিত হয়ে গেলে এটা এমনভাবে প্রচার হয় যেন সমাজের সমস্ত অপরাধগুলোই এই ধার্মিক ব্যক্তিগণ করে থাকেন এবং সমস্ত হুজুরদেরকে তখন দোষারপ করে বলা হয় এরা লেবাসধারী, এদের বিশ্বাস করা যায় না । ভাবটা এমন যেন ধার্মিক নামান্তেই ফেরেশতার মত হতে হবে, তারা কোন ভুল বা পাপ করতে পারে না । আসলেই কি তাই ? শয়তান মানুষকে প্রতি পদে পদে ধোঁকা দিয়ে আলাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে জাহান্নামী করতে চায় । এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ পাক বলেন-

“সে (শয়তান) বলল, ‘সে দিন পর্যন্ত আমাকে অবকাশ দিন, যেদিন তাদের (আদম সন্তানকে) পুনরুজ্জীবিত করা হবে। তিনি (আল্লাহ) বললেন, ‘নিশ্চয় তুমি অবকাশপ্রাপ্তদের অন্তর্ভূক্ত। সে (শয়তান) বলল, যেহেতু আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, সে কারণে অবশ্যই আমি তাদের জন্য আপনার সোজা পথে বসে থাকব । তারপর অবশ্যই আমি তাদের কাছে তাদের সামনে থেকে, তাদের পেছন থেকে, তাদের ডান দিক থেকে, তাদের বাম দিক থেকে উপস্থিত হব । আর আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না।” (সুরা আরাফ : আয়াত ১৪-১৭)

আমরা জানি মানুষ মাত্রই ভুল বা পাপ করবে এটাই স্বাভাবিক, আর মুমিনগণ ভুল করার পরপরই তাওবা করেন যেটা আল্লাহ পছন্দ করেন । শয়তান যদি কোন ভালো মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তার দ্বারা কোন খারাপ কর্ম সাধন করাতে পারে তাহলে এর প্রভাব অনেক বেশি হয়, বিশেষ করে কোন ধার্মিক ব্যক্তি কর্তৃক সমাজে কোন অপরাধ সংঘটিত হলে তার জন্য ধর্মও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঐ ব্যক্তি কর্তৃক ভবিষ্যতে সমাজে ধর্মীয় কোন কাজ করা কঠিন হয়ে যায় । তাই শয়তান এক্ষেত্রে বেশি লাভবান হয় যতটা না অন্য সাধারণ ব্যক্তি কর্তৃক অপরাধ সংঘটিত হলে সম্ভব হয় । তাই বুঝতে হবে শয়তান সর্বদা চেষ্টা করে ভালো কিংবা ধর্মীয় কোন ব্যক্তিকে পথচ্যুত করতে, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শয়তান ব্যর্থ হয় শুধু দু-একটি কদাচিৎ ঘটনা ব্যতিত । শয়তান যখন কাউকে ধোকা দিয়েই ফেলে তখন ঐ ব্যক্তির অন্তর তাকওয়া শূন্য থাকে, যার কারণে সে ভুল করে । যারা মুমিন তারা পরক্ষনেই আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে তাওবা করে ক্ষমা চেয়ে নেয়, আল্লাহও তাদেরকে ক্ষমা করে দেন । এজন্য উচিত সর্বদা সৃষ্টিকর্তার দেখানো পথে থাকা, তাহলে পাপ সংঘটনের সম্ভাবনাও কম থাকবে এবং সমাজে অপরাধও সংঘটিত হবে না।

কোন দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে তখন সেখানে আইনের অপব্যবহার বাড়ে কিংবা আইনের সঠিক প্রয়োগ কঠিন হয়ে পড়ে, আর সেই সুযোগে অপরাধীরাও তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড অবলীলায় করে যায় । বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থেকে অপরাধ করা কিংবা অপরাধ করে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে সেটা থেকে মুক্তি পাওয়া নতুন নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই এমনটা যেন রাজনৈতিক কালচারে পরিণত হয়েছে যা একটা সমাজ ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট । অনেক রাজনৈতিক নেতাকেই দেখা যায় সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে চলতে। সন্ত্রাসীদের সাথে নিয়ে চলার মধ্যে কোন সম্মান নেই, বরং সামাজিকভাবে সে সবার কাছে অগ্রহণযোগ্য ও মর্যাদাহীন হয়ে পড়ে, হয়তো ভয়-ভীতির জন্য বাহ্যিক সম্মান তাকে দেখানো হয়, অন্তর থেকে আসে ঘৃণা । তবে আশার কথা যে কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই জাতীয় অপরাধ থেকে তার এলাকাকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করছেন । প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ যদি সমাজে অপরাধীদের বিরুদ্ধে সৌচ্চার হন এবং অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন, তাহলে সমাজের অপরাধ অনেকাংশেই কমে যেতে বাধ্য।

অপরাধীকে শুধু শাস্তি দিলেই সমাজ থেকে অপরাধ কমবে না । কারণ সে যে কারণে অপরাধ করছে তার কারণ অনুসন্ধান করে সেটার বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ ও তা বাস্তবায়ন করতে না পারলে পুনরায় তা একই কারণে অন্যজন কতৃকও অপরাধ সংগঠিত হবে । মানুষ যখন বেকার বা কর্মহীন থাকে কিংবা চরম দারিদ্র্যতায় থাকে তখন তার দ্বারা অপরাধ সংঘটনেরও সম্ভাবনা থাকে । মাদকের ব্যবসার শিকারে পরিণত হয়ে যায় এই কর্মহীন বা দারিদ্র্যতায় থাকা ব্যক্তিবর্গই, তাদেরকে মাদক কারবারীরা খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারে । তাই যারা কর্মহীন রয়েছে বা চরম দারিদ্র্যতায় রয়েছে তাদেরকে উপযুক্ত কর্মের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

একটি প্রবাদ রয়েছে- “সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে”। একজন ভালো ব্যক্তিও খারাপ কিংবা অপরাধী হয়ে যেতে পারে যদি তার সঙ্গ ভালো না হয়, তার পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভালো না হয়। তাই প্রতিটি মানুষেরই উচিত ভালো সঙ্গ নির্বাচন করে চলা, অন্যদের ভালোর দিকে আহ্বান করা ।

বন্ধু নির্বাচনে বিভিন্ন মনীষীগণও দিকনির্দেশনা দিয়েছেন । ইমাম গাজ্জালি (রহ.) কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে হলে তিনটি গুণের দিকে লক্ষ রাখতে বলেছেন—

১. নেককার ও পুণ্যবান,

২. চরিত্রবান,

৩. জ্ঞানী ও বিচক্ষণ।

আবূ হুরাইরা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত; নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ “মানুষ তার বন্ধুর রীতি-নীতির অনুসারী হয়। কাজেই তোমাদের প্রত্যেকের খেয়াল রাখা উচিত সে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে।” (সুনান আবু দাউদ: ৪৯৩৩, আত-তিরমিযী: ২৩৭৮, সনদ হাসান)

পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ বলেন-

“আর মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারী তারা একে অপরের বন্ধু, তারা ভালো কাজের আদেশ দেয় ও অন্যায় কাজ হতে নিষেধ করে, আর তারা সালাত প্রতিষ্ঠা করে আর যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তাদের উপর আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। (আত্-তাওবাহ, ৯/৭১)

পরিশেষে বলা যায়, সমাজ থেকে অপরাধ দূর করতে হলে প্রতিটি নাগরিককেই উপযুক্ত শিক্ষাদান তথা প্রয়োজনীয় সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি নৈতিক শিক্ষা দান করতে হবে এবং সৃষ্টিকর্তার দেখানো পথে পরিচালিত করে তাকওয়ামুখী (আল্লাহ ভীতি) সভ্য পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে আর কেউ অপরাধ করলে প্রকৃত অপরাধীকে উপযুক্ত শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে, সেইসাথে সবার জন্য সঠিক কর্মের ব্যবস্থাও করতে হবে । বাংলাদেশ হোক সভ্য ও উন্নয়নের রোল মডেল ।

লেখক: 

মোঃ আমির হামজা

ফার্স্ট এক্সেকিউটিভ অফিসার

বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক লিমিটেড।