শবে বরাত: করণীয় ও বর্জনীয়

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ০৭ ২০২৩, ১৪:০২

মুহিউদ্দীন কাসেমি: শবে বরাত সম্পর্কে কোনো সহিহ হাদিস নেই? অজ্ঞ, নির্বোধ কিংবা জ্ঞানপাপী কিছু লোক বলে বেড়ায়, শবে বরাত সম্পর্কে কোনো সহিহ হাদিস নেই। দুর্বল ও জাল হাদিস দ্বারা শবে বরাত প্রমাণিত। এ কথা ঠিক যে, শবে বরাত সম্পর্কে বর্ণিত সব হাদিসই সমমানের সহিহ নয়। কিছু দুর্বল হাদিসও রয়েছে। এমনকি কিছু জাল হাদিসও আছে। অনেক বিষয়েই এমন দুর্বল ও জাল হাদিস থাকতে পারে; যদিও ওই বিষয়টি স্বতঃসিদ্ধ ও প্রমাণিত। মনে করুন, জামাতে নামায আদায় করার ফজিলত ও গুরুত্ব অপরিসীম। বিভিন্ন হাদিসে এর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য বিধৃত হয়েছে। এখন জামাতের ফজিলতের বিষয়ে কিছু দুর্বল এমনকি জাল হাদিস থাকার দ্বারা কি জামাতের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্যকেই অস্বীকার করা যাবে? এমন আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে যে, বিষয়টি সুপ্রমাণিত হওয়া সত্তে¡ও ওই বিষয়ে কিছু জঈফ বা জাল হাদিস রয়েছে। এর দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না।

তা ছাড়া দুর্বল বা জঈফ হাদিস কি সর্বত্র পরিত্যাজ্য? আহলে হাদিসের কথা শুনলে বোঝা যায়, জঈফ হাদিস মানেই পরিহারযোগ্য ও বাতিল। জঈফ হাদিসের সাথে তারা জাল হাদিসের আচরণ করে থাকে। এটি একটি মারাত্মক ভ্রান্তি। অথচ জঈফ হাদিস সবখানে পরিত্যাজ্য হয় না। একটি জঈফ হাদিস বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হলে এবং অনেক কিতাবে উল্লেখ থাকলে তা সহিহ হাদিসের পর্যায়ে চলে যায়। উসুলুল হাদিসের কিতাবে জঈফ হাদিসের সংজ্ঞার সাথে এর হুকুমও বিধৃত হয়েছে। বিস্তারিত সেখানে দেখা যেতে পারে।

আমরা শুধু বলতে চাচ্ছি, শবে বরাতের ফজিলত ও গুরুত্ব সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। উম্মাহর ইজমাও এর বড় দলিল। হ্যাঁ, এ সম্পর্কে জঈফ এমনকি মওজু হাদিসও রয়েছে। মওজু হাদিসগুলো অবশ্যই বাতিলযোগ্য। জঈফ হাদিসের ব্যাপারে বিস্তারিত কথা রয়েছে। সে অনুপাতে আমল করা হবে।

এটা ঠিক যে, শবে বরাতকে কেন্দ্র করে অনেক বিদআত ও কুসংস্কার মুসলিমসমাজে পালিত হচ্ছে। সেগুলো অবশ্যই পরিহার করতে হবে।

সে কারণেই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত সর্বদা শবে বরাতের ফজিলত ও মাহাত্ম্যের কথা বিশ্বাস করে আসছে। আল্লামা ইবনুল হাজ মালেকি রহ. শবে বরাত সম্পর্কে পূর্বসূরিদের মতামত উল্লেখ করতে গিয়ে লিখেন:—

অর্থ: কোনো সন্দেহ নেই যে, এ রাত অত্যন্ত বরকতপূর্ণ এবং আল্লাহর কাছে মর্যাদাময়। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘এ রাতে সকল হিকমতপূর্ণ কাজের মীমাংসা হয়’ (সুরা দুখান-৪) এই আয়াতে বর্ণিত রাত দ্বারা শবে বরাত উদ্দেশ্য, না-কি শবে কদর? এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম থেকে দুটি অভিমতই বিধৃত হয়েছে।

তবে প্রসিদ্ধ কথা হচ্ছে, এর দ্বারা শবে কদর উদ্দেশ্য। এ আয়াতে শবে কদর উদ্দেশ্য না হলেও শবে কদরের বিরাট ফজিলত ও অশেষ কল্যাণ রয়েছে। আমাদের পূর্বসূরিগণ এ রাতের বিরাট সম্মান করতেন এবং এ রাত আসার পূর্বেই প্রস্তুতি নিতেন। যখন শবে বরাত এসে যেত, তখন এ রাতের সাক্ষাতে তার সম্মান ও মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হতেন। কেননা, একথা জানা যে, সাহাবারা আল্লাহর নিদর্শনাবলির বহু ইজ্জত করতেন। যেমনটি ইতোপূর্বে উল্লেখ হয়েছে। (আল-মাদখাল- ১/২৯২)

দেখুন! আল্লামা ইবনুল হাজ মালেকির এ বর্ণনা সাধারণ ব্যাপার নয়। কেননা, বিশেষভাবে বিদআতের প্রত্যাখ্যান সম্পর্কে রচিত কিতাবে তিনি পূর্বসূরিদের এ বিশ্বাস ও নীতি উল্লেখ করেছেন যে, তারা সবাই শবে বরাতের সম্মান করতেন। শবে বরাত পালনের মানসিকভাবে পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। সুতরাং বিদআতের প্রত্যাখ্যানে রচিত কিতাবে বিদআতের প্রশ্রয় দেবেন, এটা কল্পনা করা যায় না।

শবে বরাতের ব্যাপারে সহিহ হাদিস রয়েছে, এ বিষয়ে দুজন বিখ্যাত আহলে হাদিস আলেমের বক্তব্য উদ্ধৃত করছি। তিরমিযি শরিফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ তুহফাতুল আহওয়াযির লেখক আল্লামা আবদুর রহমান মুবারকপুরি রহ. বলেন:

اعلم أنه قد ورد في فضيلة ليلة النصف من شعبان عدة أحاديث مجموعها يدل على أن لها أصلا فمنها حديث الباب.

এ কথা বলার পর তিনি এ বিষয়ে পাঁচ-ছয়টি হাদিস উদ্ধৃত করার পর বলেন :

فهذه الأحاديث بمجموعها حجة على من زعم أنه لم يثبت في فضيلة ليلة النصف من شعبان شيء والله تعالى أعلم

অর্থ: এ সকল হাদিসের সমষ্টি তাদের বিরুদ্ধে দলিল, যারা বলে বেড়ায় যে, শবে বরাতের ফজিলতের বিষয়টি প্রমাণিত নয়। (খ. ৩, পৃ. ৩৬৫-৩৬৭)

শায়েখ নাসির উদ্দিন আলবানি রহ. এর মতামত এক্ষেত্রে সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। কারণ, অনেক আহলে হাদিস ভাই তাঁর অনুসরণের দাবি করেন। তিনি বলেন:

و جملة القول أن الحديث بمجموع هذه الطرق صحيح بلا ريب و الصحة تثبت بأقل منها عددا ما دامت سالمة من الضعف الشديد كما هو الشأن في هذا الحديث ، فما نقله الشيخ القاسمي رحمه الله تعالى في ” إصلاح المساجد ” ( ص ১০৭ ) عن أهل التعديل و التجريح أنه ليس في فضل ليلة النصف من شعبان حديث صحيح ، فليس مما ينبغي الاعتماد عليه ، و لئن كان أحد منهم أطلق مثل هذا القول فإنما أوتي من قبل التسرع و عدم وسع الجهد لتتبع الطرق على هذا النحو الذي بين يديك . و الله تعالى هو الموفق .

একই কিতাবে তিনি আরও বলেন :

يطلع الله تبارك و تعالى إلى خلقه ليلة النصف من شعبان ، فيغفر لجميع خلقه إلا لمشرك أو مشاحن ” .

قال الألباني: حديث صحيح ، روي عن جماعة من الصحابة من طرق مختلفة يشد بعضها بعضا و هم معاذ ابن جبل و أبو ثعلبة الخشني و عبد الله بن عمرو و أبي موسى الأشعري و أبي هريرة و أبي بكر الصديق و عوف ابن مالك و عائشة .

(সিলসিলাতুস সহিহা: খ. ৩, পৃ. ২১৮)

তাই সকল প্রকার বিভ্রান্তি ও অপপ্রচার হতে বিরত থাকা আবশ্যক। শবে বরাতের ফজিলত শক্তিশালী দলিল দ্বারা প্রমাণিত এবং যুগ যুগ ধরে চলে আসা একটি সুন্নাহ।

শবে বরাত কি ভাগ্যরজনী?

ওপরের হাদিস দ্বারা আমরা জানতে পারলাম শবে বরাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদিত হয়। যেমন এ বছর কারা জন্ম নেবে তাদের নাম লেখা হয়। যারা মৃত্যুবরণ করবে তাদের তালিকা প্রস্তুত হয়। এ রাতে বান্দাদের আমল ওঠানো হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলার দরবারে পেশ করা হয়। কুল মাখলুকের এক বছরের রিজিক লেখা হয়, ইত্যাদি। এ হিসাবে বোঝা যায় শবে বরাত ভাগ্যরজনী।

একটি সন্দেহের নিরসন

স্বভাবতই এখানে এই সন্দেহ উঁকি দিতে পারে, রিজিক, হায়াত-মউত ইত্যাদি বিষয়াদি তো পৃথিবী সৃষ্টির হাজারো বছর পূর্বে লওহে মাহফুজে লেখা হয়েছে। তারপর শবে বরাতে লেখার কী অর্থ?

এর উত্তর হলো, তাকদির বা ভাগ্যলিপি অবশ্যই লওহে মাহফুজে লেখা রয়েছে; যা শুধু আল্লাহ তাআলাই জানেন। সেই লওহে মাহফুজ থেকে এক বছরের তালিকা শবে বরাতে সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের হাতে দেয়া হয় মাত্র।

একটি আপত্তি ও তার উত্তর

কিছু লোক এই আপত্তি উত্থাপন করে যে, শবে বরাতে উপর্যুক্ত কাজসমূহ আঞ্জাম পায়, এ-কথা ঠিক নয়। কেননা, প্রথমত তা কুরআনের আয়াত: فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ

(এ রাতে হিকমতপূর্ণ কাজের মীমাংসা হয়। সুরা দুখান-৪) এর পরিপন্থী। কারণ, তাফসিরবিদগণের মতে এ আয়াতে যে রাতের কথা বলা হয়েছে তা শবে বরাত নয় বরং শবে কদর।

দ্বিতীয়ত সহিহ হাদিস দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, হায়াত, মওত, রিজিক ইত্যাদি কাজসমূহ শবে কদরে সম্পাদিত হয়। সুতরাং শবে কদরে সম্পাদিত হলে আবার শবে বরাতে সম্পাদিত হয় কীভাবে?

এই আপত্তির কারণে কিছু লোক শবে বরাত সম্পর্কীয় হাদিসমূহকে অস্বীকার করে বসেছে। মুহাদ্দিসিন ও মুফাসসিরিনে কেরাম এই আপত্তির অনেক উত্তর দিয়েছেন। আমরা সংক্ষিপ্তভাবে কয়েকটি উত্তর উল্লেখ করব।

বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মোল্লা আলি কারি রহ. বলেন:—

অর্থ: এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, উপর্যুক্ত কার্যাদি শবে বরাতে সম্পাদিত হয়। যেমনটি হযরত আয়েশা রা. এর হাদিসে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে এতে সন্দেহ রয়েছে যে, এই আয়াত দ্বারা শবে বরাত উদ্দেশ্য না-কি শবে কদর। সঠিক কথা হলো, শবে বরাত উদ্দেশ্য নয়। আর আয়াত ও হাদিসের মাঝে সামঞ্জস্য এই যে, হয় তো উভয় রাতের ফজিলতের কারণে উভয় রাতেই উপর্যুক্ত কার্যাদি সম্পাদিত হয়।

১. অথবা শবে বরাতে উপর্যুক্ত বিষয়াদির ফয়সালা হয় আর শবে কদরে তা সম্পাদিত হয়।

২. এটাও হতে পারে যে, উক্ত কার্যাদি এক রাতে সংক্ষিপ্তাকারে অপর রাতে বিস্তারিতভাবে সম্পাদিত হয়।

৩. তাছাড়া এটাও সম্ভব যে, শবে বরাত ও শবে কদর উভয় রাতের মধ্যে এক রাতে দুনিয়াবি কার্য সম্পাদিত হয়; অপর রাতে পরকালীন কার্যাদি। এগুলো ছাড়া আরও সম্ভাবনা থাকতে পারে। (মেরকাত শরহে মেশকাত- ৩/১৯৫; প্রসিদ্ধ আহলে হাদিস আলেম আল্লামা আবদুর রহমান ইবনে আবদুর রহিম মুবারকপুরি রহ. তিরমিযি শরিফের বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’তেও উল্লেখ করেছেন; দেখুন : ৩/৩৬৭)

আল্লামা কুরতুবি মালেকি রহ. বলেন:

وقيل يبدأ في استنساخ ذلك من اللوح المحفوظ في ليلة البراءة ويقع الفراغ في ليلة القدر .

“শবে বরাতে লওহে মাহফুজ থেকে উপর্যুক্ত বিষয়াদি নকল করা শুরু হয়। আর শবে কদরে গিয়ে সমাপ্ত হয়।” (আহকামুল কুরআন-১৬/১২৮)

আল্লামা আলুসি হানাফি বলেন:

وروي عن ابن عباس رضي الله تعالى عنهما تقتضي الأقضي كله اليلة النصفة من شعبان وتسلم إلى أربابها ليلة السابع والعشرين من شهر رمضان.

“হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেছেন, সমস্ত কাজের ফয়সালা তো শবে বরাতে হয়। আর সংশ্লিষ্ট ফেরেশতাদের কাছে এই তালিকা রমজানের সাতাশ তারিখ অর্থাৎ শবে কদরে হস্তান্তর করা হয়।” (তাফসিরে রুহুল মাআনি-২৫/১১৩)

উপর্যুক্ত সুস্পষ্ট যৌক্তিক সমাধানের পর শবে বরাত ও শবে কদর সম্পর্কে আর কোনো ধরনের প্রশ্ন কিংবা সন্দেহ থাকার কথা নয়।

শবে বরাতের মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত লোকেরা

শবে বরাতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সাধারণ নীতি পরিহার করে সূর্যাস্তের পর থেকে সুবহে সাদিক পর্যন্ত দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং স্বীয় মাখলুকের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকিয়ে অগণিত মানুষকে ক্ষমা করে দেন। তবে কিছু লোক রয়েছে যারা সে রাতেও আল্লাহর রহমত, দয়া এবং মাগফিরাত থেকে বঞ্চিত হয়।

১. আল্লাহ তাআলার সাথে অংশীদারত্ব স্থাপনকারী।

২. হিংসুক।

৩. কোনো মানুষকে অন্যায়ভাবে হত্যাকারী।

৪. ব্যভিচারিণী মহিলা।

৫. আত্মীয়তা ছিন্নকারী।

৬. লুঙ্গি, প্যান্ট বা পায়জামা ইত্যাদি পোশাক টাখনুর নিচে পরিধানকারী।

৭. পিতা-মাতার অবাধ্য সন্তান।

৮. শরাবে অভ্যস্ত ব্যক্তি ইত্যাদি।

এ সমস্ত লোকদের উচিত নিজেদের অপকর্ম ও পাপাচার থেকে দ্রæত তাওবা করা এবং আল্লাহ তাআলাকে রাজি-খুশি করা। কেননা, কে জানে কার মৃত্যুর ডাক কখন আসে।

هو رهى هے عمر مثل برف كم رفته رفته چپكے چپكے دم بدم

خدا كى ياد جوانى ميں غافلو كر لو ورنه وقت فضيلت تمام هو تا هے

হে বন্ধু! তোমার জীবন বরফের ন্যায় গলে যাচ্ছে

আস্তে ধীরে নিঃশ্বাসের গতি বেগে।

ওহে গাফেল! খোদাকে স্মরণ করো যৌবনে

ফজিলতপূর্ণ সময় আসছে যে ফুরিয়ে।

.

শবে বরাতের আমল

১. রাতে ইবাদত করা

২. কবর জিয়ারত করা

৩. শবে বরাতের পরের দিন রোযা রাখা

শবে বরাতের আমলগুলোর একটি হলো রাতজেগে ইবাদত করা এবং সম্ভব হলে কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করা। এ বিষয়ে একটি হাদিস দেখি:

“হযরত আয়েশা রা. বলেন, একদা রাতের বেলায় হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘরে আগমন করলেন। শরীর মুবারক থেকে কাপড় খুলে রাখলেন এবং অল্পক্ষণের মধ্যেই দাঁড়িয়ে আবার কাপড় পরে নিলেন। এতে আমার মর্যাদায় খানিকটা আঘাত পেলাম। কেননা আমি ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো অন্য কোনো বিবির ঘরে যাচ্ছেন। তাই আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পিছু-পিছু চুপিসারে এগুতে লাগলাম। গিয়ে দেখি তিনি মদিনার গোরস্থান ‘জান্নাতুল বাকি’তে মুমিন নর-নারী ও শহিদদের মাগফিরাতের জন্য দুআয় মগ্ন। (আমার ধারণায় লজ্জিত হয়ে মনে মনে বলে উঠলাম) হে নবি, আপনি স্বীয় প্রভুর কাজে ব্যস্ত আর আমি দুনিয়ার চিন্তায় লিপ্ত! আমি জলদি হেঁটে আমার ঘরে চলে আসলাম। ফলে আমার শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রæত ওঠানামা করছিল। পরক্ষণেই তিনি ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার আয়েশা! তোমার শ্বাস দ্রæত ওঠানামা করছে কেন? আয়েশা রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি আমার ঘরে এসে কাপড় খোলার পরপর আবার কাপড় গায়ে দিয়ে বাইরে চলে গেলেন। তাই এই ভেবে আমার মর্যাদার হানি হলো যে, আপনি অন্য কোনো বিবির ঘরে চলে গেছেন। তাই আমি আপনার পিছু নিলাম। গিয়ে দেখি আপনি জান্নাতুল বাকিতে দুআ করছেন। একথা শুনে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি ভয় পাচ্ছ যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল তোমার ওপর জুলুম করবেন? আসল কথা হলো, হযরত জিবরাইল আ. আমার কাছে এসেছিলেন এবং বললেন, এটা শাবানের পনেরোতম রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা এত বিপুল সংখ্যক জাহান্নামিকে মুক্তি দেন, যাদের সংখ্যা বনু কালবের বকরির পালের পশমের চেয়েও বেশি। তবে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ রাতে মুশরিক, হিংসুক, আত্মীয়তা ছিন্নকারী, টাখনুর নিচে কাপড় পরিধানকারী, মদখোর এবং পিতা-মাতার অবাধ্যের প্রতি রহমতের দৃষ্টিতে তাকান না।

তারপর হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাপড় খুলে রাখলেন। এবং আমাকে বললেন, হে আয়েশা! তুমি কি আমাকে অনুমতি দিচ্ছ যে, এ রাত জেগে আমি ইবাদত করব? আমি বললাম, অবশ্যই। আপনার ওপর মা-বাপ কুরবান হোক! অতঃপর তিনি নামাযে দাঁড়ালেন, সেজদায় গেলেন। এত দীর্ঘ সেজদা করলেন যে, আমি ভাবলাম হয়তো তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আমি হুজুর সা.-কে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছায় তাঁর পায়ের তলায় হাত রাখলাম। দেখি, দিব্যি জীবন্ত মানুষ; নড়াচড়া হচ্ছে। আমি হাত গুটিয়ে নিলাম আর শুনতে পেলাম, সেজদায় কাতরস্বরে এই দুআ করছেন :

أَعُوذُ بِعَفْوِكَ مِنْ عِقَابِكَ، وَأَعُوذُ بِرِضَاكَ مِنْ سَخَطِكَ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْكَ، جَلَّ وَجْهُكَ، لَا أُحْصِي ثَنَاءً عَلَيْكَ أَنْتَ كَمَا أَثْنَيْتَ عَلَى نَفْسِكَ

অর্থ : হে আল্লাহ! তোমার মার্জনা দ্বারা তোমার আজাব থেকে, তোমার সন্তুষ্টি দ্বারা অসন্তুষ্টি থেকে আর তোমার করুণা দ্বারা তোমার ক্রোধ থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি। প্রভু হে! তুমি মহিমান্বিত। আমরা সেভাবে তোমার গুণকীর্তন করতে পারব না, যেভাবে তুমি নিজে গুণ গেয়েছ। (শুআবুল ঈমান- ৩/৩৮৪, হাদিস নং- ৩৮৩৭)

আরেক হাদিসে এসেছে :

“হযরত আলি ইবনে আবি তালেব রা. বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাত আসবে, সে রাতে তোমরা নামায পড়ো আর পরের দিন রোযা রাখো। কেননা, ওই রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথে আল্লাহ তাআলা নিকটতম আকাশে অবতরণ করেন এবং বলতে থাকেন, কোনো ক্ষমাপ্রার্থনাকারী আছে কি; আমি ক্ষমা করে দেব। কোনো রিজিকপ্রার্থী আছে কি; যাকে আমি রিজিক দেব, এবং আছে কোনো বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি; যার বিপদ দূর করে দেব। এভাবে আরও অনেক ব্যক্তিকে ডাকেন সুবহে সাদিক উদিত হওয়া পর্যন্ত।” (ইবনে মাজা- ১০, হাদিস নং- ১৩৮৮; মেশকাত-১১৫; তারগিব- ২/২৪২; ফাজায়িলুল আওকাত লিল বাইহাকি- ১২২; কানযুল উম্মাল- ১২/২১৪)

শবে বরাতে রাত জাগার পদ্ধতি

হযরত হাসান ইবনে আম্মার ইবনে শুরুম্বুলালি হানাফি রহ. (মৃত ১০৬৯ হি.) স্বীয় বিখ্যাত গ্রন্থে লিখেন-

معنى القيام أن يكون مشتغلا معظم الليل بطاعة وقيل بساعة منه يقرأ أو يسمع القرآن أو الحديث أو يسبح أو يصلي على النبي صلى الله عليه وسلم.

“রাত জাগার অর্থ হলো, সে রাতের বেশি সময় কিংবা কিছু সময় কুরআন হাদিস পড়বে বা শুনবে। তাসবিহ পাঠ করবে। অথবা রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এর ওপর দুরুদ প্রেরণে লিপ্ত থাকবে।” (মারাকিল ফালাহ আলাত-তাহতাবির টীকাসহ- ৩২৬)

এ থেকে বোঝা গেল, শবে বরাতে রাত জাগার জন্য বিশেষ কোনো পদ্ধতি কিংবা নির্দিষ্ট কোনো ইবাদত নেই। নিজের স্বাস্থ্য ও মানসিক প্রফুল্লতার সাথে যে-কোনোভাবে আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করতে পারে। চাই কুরআন-হাদিস তেলাওয়াত করুক বা অন্য কারও থেকে শুনুক। ইচ্ছা করলে তাসবিহ-তাহলিল পড়তে থাকুক। কিংবা দুরুদ শরিফ পাঠ করুক অথবা নফল নামাযে মশগুল থাকুক। এ রাতে অনেক বুযুর্গানে দীন সালাতুত তাসবিহ পড়তেন। যদি কারও সম্ভব হয়, সালাতুত তাসবিহ পড়তে পারে। হাদিসে এ নামাযের অনেক ফজিলত বর্ণিত হয়েছে।

শবে বরাতে কি পুরো রাত জাগা জরুরি?

শবে বারতের ফজিলত পাওয়ার জন্য পুরো রাত জাগা জরুরি, না কিছু অংশ জাগলেই চলবে? যদি তাই হয় তবে রাতের কোন ভাগে জাগা উত্তম?

এ ব্যাপারে হযরত মাও. আশরাফ আলি থানবি রহ. বলেন: এখন চিন্তার বিষয় হলো শবে বরাতের কোন অংশে জাগা উত্তম? এর সমাধান কুরআন ও হাদিসেও রয়েছে। পবিত্র কুরআন দ্বারা জানা যায়, শেষ রাতে জাগা উত্তম। কেননা, এ সময় জাগতে কষ্ট হয় বেশি। আল-কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে:

إِنَّ نَاشِئَةَ اللَّيْلِ هِيَ أَشَدُّ وَطْئًا وَأَقْوَمُ قِيلًا

“নিশ্চয় ইবাতদের জন্য রাতে ওঠা প্রবৃত্তি দলনে সহায়ক।” (সুরা মুযযাম্মিল- ৬)

আয়াতের মধ্যে نَاشِئَةَ اللَّيْلِ ‘রাতে ওঠা’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো রাতে নিদ্রার পর গাত্রোত্থান করা।

আয়াতের এ অংশের ব্যাখ্যায় তাফসিরে জালালাইনে এসেছেÑ

القيام بعد الليل অর্থ : “ঘুমের পর জাগ্রত হওয়া।”

যেহেতু রাতে ঘুমানোর পর জাগ্রত হওয়া কঠিন ও কষ্টসাধ্য, তাই শেষ রাতে জাগা উত্তম হবে। সুরার শেষ অংশ দ্বারাও তাই বুঝে আসে। ইরশাদ হচ্ছে,

عَلِمَ أَنْ لَنْ تُحْصُوهُ

“তিনি জানেন তোমরা এর পূর্ণ হিসাব রাখতে পারবে না।” (সুরা মুযযাম্মিল- ২০)

এটা তো কুরআন দ্বারা প্রতিভাত হলো। আর হাদিস দ্বারাও বুঝে আসে যে, শেষ রাতে জাগ্রত থাকাটাই উত্তম। এ সম্পর্কে বহু হাদিস বর্ণিত হয়েছে। যুক্তির আলোকেও তাই বুঝে আসে। কেননা, রাতের শেষভাগ গভীর ঘুমের সময়। আর ঘুম ছেড়ে দেয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। একটি হাদিসে কুদসিতে এসেছেÑ ‘যে ব্যক্তি রাতে উঠে আমার কাছে দুআ করে, আমি তার প্রতি খুশি হই। কেননা, সে আমার জন্য স্বীয় স্ত্রী ও আরামের শয্যা ত্যাগ করেছে।’ এর দ্বারাও বোঝা যায়, শেষ রাতে জাগরণ করা উত্তম। হ্যাঁ, যদি কেউ শেষ রাতে জাগতে না পারে, সে রাতের শুরুভাগেই ইবাদত করে নেবে। অন্যান্য সাধারণ রাতে আল্লাহ তাআলা শেষ রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন। আর শবে বরাতে সূর্যাস্তের পূর্বেই এসে যান। এ জন্য রাতের শুরুভাগে ইবাদত করলেও শবে বরাতের ফজিলত পাওয়া যাবে। (হাকিকতে ইবাদতÑ ৪৬৬)

রাত জাগার জন্য মসজিতে একত্রিত হওয়া

শবে বরাতে রাত জেগে ইবাদত করা শুধু একটি মুস্তাহাব আমল। এজন্য উত্তম হলো একাকী আমল করা। কখনো মসজিদে একত্রিত হবে না। কারণ, তখন অজ্ঞতার দরুন বিদআতে লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

বিখ্যাত ফকিহ আল্লামা ইবনে নুজাইম মিসরি রহ. বলেন:

وَيُكْرَهُ الِاجْتِمَاعُ عَلَى إحْيَاءِ لَيْلَةٍ مِنْ هَذِهِ اللَّيَالِي فِي الْمَسَاجِدِ.

ফজিলতের রাতসমূহে মসজিদে একত্রিত হওয়া মাকরুহ। (বাহরুর রায়েক-২/৫২)

আল্লামা হাসান ইবনে আম্মার আলি শুরুম্বুলালি হানাফি রহ. লিখেন:

“ফজিলতের রাতসমূহে মসজিদে বা অন্য কোথাও একত্রিত হওয়া মাকরুহ। কেননা, এভাবে একত্রিত হয়ে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অথবা সাহাবাগণ কখনো আমল করেননি। যে কারণে হিজাজের অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম যেমনÑ আতা ইবনে সুলাইমান, মদিনার ফকিহগণ, ইমাম মালেকের ছাত্রবৃন্দ ও অন্যান্য ওলামায়ে কেরাম শবে বরাতে একত্রিত হওয়াকে অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন এটা বিদআত।” (হাশিয়া তাহতাবি শরহে নুরুল ইজাহ-৩২৬)

আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলি রহ. সিরিয়ার ওলামায়ে কেরাম থেকে সম্মিলিতভাবে মসজিদে রাতজাগা সম্পর্কে দুটি উক্তি বর্ণনা করেছেন, মুস্তাহাব ও মাকরুহ। তবে তিনি মাকরুহ হওয়াকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তিনি বলেন :

“দ্বিতীয় উক্তিটি হলো, এই রাতসমূহে মসজিদে নামায পড়া, ওয়াজ-নসিহত শোনা কিংবা দুআ করার জন্য একত্রিত হওয়া মাকরুহ। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি মসজিদে একাকী নিজের নামায পড়ে তাহলে তা মাকরুহ হবে না। এটা ইমাম আওযায়ির অভিমত। যিনি সিরিয়ার বড় ফকিহ ও আলেম। আর এ অভিমতটিই অধিকতর সঠিকÑ ইনশাআল্লাহ।” (লাতায়িফুল মাআরিফ- ১৪৪)

আজকাল এ ধরনের সম্মিলিতভাবে ইবাদতের ক্ষেত্রে অনেক বিদআত ও খারাপ কাজ হয়ে থাকে। মানুষ মসজিদে খামোখা গল্পগুজব, হই-হুল্লোড় ও ক্রীড়া-কৌতুকে লিপ্ত থাকে। ফলে মসজিদের ইজ্জত, সম্মান ও আদব-কায়দা ভূলুণ্ঠিত হয়। হয় উপেক্ষিত ও পদদলিত। মানুষ সওয়াবের পরিবর্তে গুনাহ অর্জন করে। তাই এথেকে বেঁচে থাকা চাই। আফসোসের বিষয় হলো, অনেক শিক্ষিত মানুষ যারা নিজেদেরকে হকপন্থী বলে দাবি করেন; তারাও আমজনতার স্রোতে ভেসে পবিত্র রজনীগুলোতে মসজিদে একত্রিত হয়।

কবর জিয়ারত মুস্তাহাব

শবে বরাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরস্থানে তাশরিফ নিয়ে গেছেন, এবং মুর্দাদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করেছেন। এজন্যে শবে বরাতে কবরস্থানে যাওয়া এবং মুর্দাদের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা মুস্তাহাব।

ফাতাওয়া আলমগিরিতে দেখুন:

কবর যিয়ারতের উত্তম দিন চারটি : সোমবার, বৃহস্পতিবার, জুমুআর দিন ও শনিবার। জুমুআর দিন নামাযের পর যিয়ারত করা উত্তম। শনিবারে সূর্য উদিত হওয়ার আগে আর বৃহস্পতিবারে দিনের শুরুভাগে কিংবা শেষভাগে; তদ্রƒপ বরকতময় রজনীগুলোতে কবর যিয়ারত করা উত্তম। বিশেষত শবে বরাতে। (ফাতাওয়া আলমগিরি- ৫/৩৫)

হযরত থানবি রহ. লিখেন:

শাবানের পনেরোতম রাতে গোরস্থানে গিয়ে মুর্দাদের জন্য দুআ করা ও ইস্তিগফার পড়া মুস্তাহাব এবং তা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। (যাওয়ালুস সিনাতি আন আমালিস সুন্নাহ-১৭)

কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরস্থানে একা গিয়েছিলেন। এজন্য আমাদেরও একা যাওয়া দরকার। দলবল নিয়ে জামাতের সাথে যাবে না। আর গিয়ে ফাতেহা ও অন্যান্য দুআ পড়ে ফিরে আসবে। তাও শুধু পুরুষরা যাবে। মহিলারা যাবে না। তাদের কবরস্থানে গমন করা উচিত নয়। পুরুষদের যাওয়া বৈধ আছে। তবে এটাকে জরুরি ও ওয়াজিব মনে করবে না।

শাবানের পনেরো তারিখে রোযা রাখা মুস্তাহাব

শাবানের চৌদ্দতম দিন দিবাগত রাত শবে বরাত হয়, এর পরের দিন অর্থাৎ পনেরোতম দিনে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাই সেদিন রোযা রাখা মুস্তাহাব।

উত্তম হল শাবানের ১৩,১৪,১৫ তারিখে রোযা রাখা। এর দ্বারা আইয়ামে বীযের রোজাও আদায় হবে এবং শবে বরাতের রোযাও আদায় হবে। তিনটি রাখতে না পারলে অন্তত ১৫ তারিখে রোযা রাখবে। এটা সুন্নত ও মুস্তাহাব আমল।

শবে বরাতের বিদআতসমূহ

শবে বরাত উপলক্ষে সমাজে অনেক ধরনের বিদআত ও কুসংস্কার পালিত হয়। আমরা এখানে কিছু বিদআত ও রুসমের কথা আলোচনা করব, যা লোকেরা খুব গুরুত্ব ও পাবন্দির সাথে পালন করে থাকে।

আতশবাজি

শবে মেরাজের মতোই শবে বরাতেও মুসলমানরা লাখ লাখ টাকার আতশবাজি পোড়ানোর মান্নত করে থাকে। আতশবাজিতে একদিকে নিজের মালের অপচয় হয়, যা শরিয়তে স্পষ্ট হারাম। অপরদিকে আতশবাজি করলে নিজের ও নিজের সন্তানদের এবং প্রতিবেশী মানুষের জীবন হারানোর প্রবল আশঙ্কা থাকে। প্রতিবছরই পত্রিকায় এ রাতের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপছে যে, অমুক স্থানে আতশবাজি করতে গিয়ে এতজন নিহত ও এতজন আহত হয়েছে। আফসোসের বিষয় হলো, মানুষ এ রাতে নিজের জান-মাল নষ্ট করে অনর্থক কাজে লিপ্ত থাকে। আমাদের উচিত নিজেরাও বিদআত ও রুসম থেকে বাঁচব, অন্যকেও বাঁচাব। তাদেরকে বোঝাব যে, এর দ্বারা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল অসন্তুষ্ট হন।

আলোকসজ্জা

শবে বরাতের সময় মানুষ নিয়ম বানিয়ে রেখেছে, মসজিদ ও ঘরবাড়িতে অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা লাগবে। মসজিদে বড় ও ছোট ছোট ইলেকট্রিক লাইট লাগায়, বাড়ির ছাদে মোমবাতি জ্বালায়।

মানুষের বোঝা উচিত, অতিরিক্ত আলোকসজ্জা করা কাফেরদের সাদৃশ্য এবং হিন্দুদের দিওয়ালি পূজার অবিকল নকল। যা একবারেই নাজায়েয ও হারাম। এই রুসমের সূচনা ‘বারামেকা’ থেকে হয়েছিল। যারা অগ্নিপূজারী ছিল। এ সম্পর্কে হযরত শাহ আবদুল হক মুহাদ্দিসে দেহলবি রহ. বলেন :

قال على بن ابراهيم و اول حدوث الوقيت من البرامكة و كانوا عبدة النار فلما اسلموا ادخلوا فى الاسلام.

আলি ইবনে ইবারাহিম রহ. বলেন, আলোকসজ্জার সূচনা বারামেকা থেকে হয়েছিল। এরা আগুনের উপাসক ছিল। যখন তারা ইসলাম গ্রহণ করল, তখন এ রুসমকে ইসলামে প্রবেশ করিয়ে দিল। (মা সাবাতা বিস সুন্নাহ- ৩৬৩)

হালুয়া-রুটি 

মুসলমানরা এ রুসমকে এতটাই জরুরি মনে করে যে, হালুয়া-রুটি ছাড়া শবে বরাতই হয় না। আমাদের মহিলারা এ রাতে ইবাদতের পরিবর্তে হালুয়া-রুটি বানানোতে ব্যস্ত থাকে। বিভিন্নভাবে তা বানিয়ে আত্মীয়স্বজনদের বাসায় পাঠায়। কেউ যদি এ রুসম থেকে বেঁচে থাকে তাকে অত্যন্ত খারাপ মনে করা হয়। অথচ এ ধরনের কোনো কাজ শরিয়তে প্রমাণিত নয়। এ জন্য আমাদের নারী-পুরুষ সবার উচিত এ রাতে অনর্থক কাজ ও অহেতুক বিষয়াদি পরিহার করে আসল কাজে লিপ্ত থাকা। ইবাদত, দান-খয়রাত ইত্যাদি আমলে ব্যস্ত থাকা।

ওপরের এই নাজায়েয ও বিদআত কাজগুলো অঞ্চলভেদে বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। কোথাও কম, কোথাও বেশি, আবার কোথাও একেবারেই নেই। ভারত-পাকিস্তানে আতশবাজি বেশি হয়ে থাকে। সে তুলনায় বাংলাদেশে আতশবাজি কম হয়। এ কাজগুলো ছাড়াও অন্যান্য কাজ যা শরিয়ত সমর্থন করে না, তা-ই বিদআত বলে গণ্য হবে। দেখুন, শবে বরাতের মুস্তাহাব পালন করতে গিয়ে যেন কোনো বিদআত বা নাজায়েয কাজে লিপ্ত হয়ে না পড়েন। কারণ, ফিকহের মূলনীতি রয়েছে :

دَرْءُ الْمَفَاسِدِ أَوْلَى مِنْ جَلْبِ الْمَصَالِحِ

অর্থ: কল্যাণ ও উপকারিতা অর্জনের চেয়ে ক্ষতি দূরীভ‚ত করা উত্তম। (আল-আশবাহ ওয়ান নাযায়ের লিইবনে নুজাইম- ১/৯০)