শতকোটি টাকার সম্পত্তি নিয়ে দুই পীরজাদার দ্বন্দ্বে আটরশিতে ১৪৪ ধারা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

সেপ্টেম্বর ২৮ ২০১৯, ২৩:৩৫

আটরশি পীরের রেখে যাওয়া শত কোটি টাকার সম্পত্তিই কাল হয়ে দাঁড়ালো দুই ছেলে পীরজাদা আলহাজ্ব মাহফুজুল হক এবং পীরজাদা আলহাজ্ব মোস্তফা আমীর ফয়সালের জন্য। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তিই দুই ভাইয়ের সম্পর্কে চিড় ধরিয়েছে। মুখোমুখি দাড় করিয়েছে দুই ভাইকে।

ফরিদপুরের আটরশিতে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পীরের দুই ছেলের দ্বন্দ্ব প্রকট আকার ধারণ করেছে। গত কয়েক বছর ধরে ক্ষমতা ও জায়গা জমির মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দিলেও বর্তমানে তা মাথাচারা দিয়ে উঠেছে।

সর্বশেষ আটরশি বিশ্ব জাকের মঞ্জিল সংলগ্ন ফরিদপুর স্পিনিং মিল অভ্যন্তরে এক ভাই পৃথক হেলিপ্যাড নির্মাণ করতে গেলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। সার্বিক শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষায় ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন। শুক্রবার সকাল থেকে সেখানে পুলিশ মোতায়েন রাখা হয়েছে।

জানা গেছে, বিশ্বজাকের মঞ্জিল সংলগ্ন একটি হেলিপ্যাড সেই এরশাদ সরকারের আমল থেকে রয়েছে। এরপর এক ভাই মাত্র কয়েক’শ গজ দূরে ফরিদপুর স্পিনিং মিল অভ্যন্তরে আরও একটি হেলিপ্যাড তৈরির চেষ্টা করলে অন্য ভাইয়ের অনুসারীদের মাঝে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এতে বাধ্য হয়ে প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেছে।

সূত্র জানায়, আটরশী হুজুরের বড় সন্তান মাহফুজুল হক মুজাদ্দেদীর আম মোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) বলে জনৈক শহিদুল ইসলাম শাহিন বাদী হয়ে ফরিদপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় জেলা জাকের পার্টির সভাপতি মশিউর রহমান যাদু মিয়াসহ আরও কয়েকজনকে আসামি করা হয়। ওই মামলার আবেদনের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১টার পর থেকে ফরিদপুর স্পিনিং মিল এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

জানা গেছে, আটরশীর পীরের মেঝ সন্তান ও জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমীর ফয়সল মুজাদ্দেদীর অনুসারীরা গত সপ্তাহে ফরিদপুর স্পিনিং মিলে একটি হেলিপ্যাড তৈরি করতে যায়। এ সময় সেখানে আটরশী হুজুরের স্থলাভিষিক্ত মাহফুজুল হক মোজাদ্দেদীর অনুসারীরা বাধা দেন। এনিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়।

হুজুরের দুই সন্তানের মধ্যে মাহফুজুল হকের (মিয়া ভাইজান) অনুসারীরা বর্তমানে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের কর্মী গ্রুপ আর মেঝ সন্তান এবং জাকের পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা আমীর ফয়সল তার অনুসারীরা জাকের পার্টির ব্যানারে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছেন। কর্মী গ্রুপ ও জাকের পার্টি এখন একে অপরের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছেন আটরশীতে। গত কয়েকদিন যাবৎ এনিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক উত্তেজনা চলছে।

এরই মাঝে শুক্রবার মোস্তফা আমীর ফয়সলের আটরশীতে আসার কর্মসূচি জানানো হয়। আর মেঝ ভাইজানের এই সফরকে স্বাগত জানিয়ে কর্মী গ্রুপের পক্ষ হতে অভিনন্দনসূচক ব্যানার টাঙানো হয়। তবে তিনি যেন তার দলবল তথা বহর নিয়ে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে প্রবেশ না করেন সেজন্য তাকে অনুরোধ জানানো হয়।

ফরিদপুর স্পিনিং মিল গেট থেকে বিশ্বস্ত এক সূত্র জানায়, শুক্রবার সকাল সোয়া ১০টার দিকে মোস্তফা আমীর ফয়সলের স্ত্রী শাহিনা ফয়সল প্রায় ২০টি মাইক্রোবাস নিয়ে ফরিদপুর স্পিনিং মিলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছেন।

এর আগে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে মিয়া ভাইজান হিসেবে পরিচিত মাহফুজুল হক ঢাকা থেকে সড়ক পথে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে এসে পৌঁছান। প্রায় ৩০টি গাড়িরবহর ছিল তার সঙ্গে। তার অনুগামী কর্মী গ্রুপের প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি ভক্ত তার স্বপক্ষে জাকের মঞ্জিলে অবস্থান করছেন।

শুক্রবার সকাল থেকে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পশ্চিম দিকের মূল সড়কের আশপাশে কর্মী গ্রুপের লোকেরা সতর্ক অবস্থান নিয়েছেন। তাদের সঙ্গে সেখানে প্রচুর সংখ্যক পুলিশও মোতায়েন রয়েছে। জাকের মঞ্জিলে প্রবেশকালে সন্দেহজনক কোনো গাড়ি কিংবা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

সদরপুর থানার ওসি লুৎফর রহমান বলেন, এটি আসলে জনতার জন্য প্রয়োগকৃত কোনো ১৪৪ ধারা নয়। পারিবারিক সম্পত্তি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে সৃষ্ট উত্তেজনার কারণে সেখানে এই সিদ্ধান্ত জারি করা হয়েছে। উভয়পক্ষকে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য বলা হয়েছে। পরিস্থিতি বর্তমানে শান্ত রয়েছে।

সদরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পূরবী হালদার ১৪৪ ধারা জারির সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সেখানে উভয়পক্ষকেই শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য নোটিশ দেয়া হয়েছে।

ব্যাপক অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে আটরশি পীরের নাতি পীরজাদা মোস্তফা আমীর ফয়সালের পুত্র ড. সায়েম আমালী ফয়সালের ফেসবুক স্ট্যাটাস বিষয়টিকে আরো উস্কে দেয়। যদিও ড. সায়েম আমালী ফয়সাল সম্পত্তির বিষয়টি প্রকাশ্যে তুলে ধরেননি তবে আটরশির বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের কর্তৃত্ব নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য সবাইকে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

ফেসবুক নোটে তিনি উল্লেখ করেছেন, একটি কুচক্রী ও সন্ত্রাসী মহলের কাছে জিম্মি বিশ্ব জাকের মঞ্জিল। বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের সম্পদ কুক্ষিগত। আটরশির বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের বর্তমানে পুরোপুরি গদিনশীন পীর আলহাজ্ব পীরজাদা মাহফুজুল হক ফরিদপুরীর নিয়ন্ত্রণে। গদিনশীন পীর হিসেবেই তিনি আটরশিতে অবস্থান করেন।

তাছাড়া বিশ্ব জাকের মঞ্জিল ফাউন্ডেশনের অধীন বিশ্ব জাকের মঞ্জিল আলিয়া মাদ্রাসা, বিশ্ব জাকের মঞ্জিল হাসপাতাল, বিশ্ব জাকের মঞ্জিল স্পিনিং মিলসহ আটরশিতেই রয়েছে আরো বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান। আর এসব সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য শতকোটি টাকা। এছাড়াও শত শত বিঘা জমি রয়েছে গোটা সদরপুর জুড়ে। বর্তমান বাস্তবতা হচ্ছে গদীনশিন পীর হিসেবে এসব সম্পত্তি ভোগ করছেন পীরজাদা মাহফুজুল হক।

সূত্র জানায়, আটরশির পীর খাজাবাবা ফরিদপুরীর জীবদ্দশায় গদিনশীন পীরের দায়িত্ব পান পীরজাদা মাহফুজুল হক আর জাকের পার্টির দায়িত্ব পান পীরজাদা মোস্তফা আমীর ফয়সাল। খাজাবাবা ফরিদপুরী জীবিত থাকাবস্থায় সবকিছু ঠিকঠাক মতো চললেও অতি সম্প্রতি এ বিষয়গুলো নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। জাকের পার্টির বাইরে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের নিয়ন্ত্রণ পীরজাদা মোস্তফা আমীর ফয়সাল নেয়ার জন্য পরিকল্পনা করলে জাকেরদের সামনে বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

একাধিক জাকের নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, পীরের রেছালা থেকে তাঁরা দূরে সরে গেছেন। তারা ব্যক্তিগত ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত। মরহুম পীর কেবলাজানের তরিকা বাস্তবায়নেও তারা উদাসীন। বর্তমানে যে অবস্থা বিরাজ করছে তা চলতে থাকলে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের ধ্বংস অনিবার্য। জাকেররাও বিষয়টি ভাল চোখে দেখছেন না।

ক্ষুব্ধ জাকেররা জানান, ড. সায়েম আমালী ফয়সাল যেভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানি দিয়েছেন তা বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের তিলে-তিলে গড়ে ওঠা ঐতিহ্য ধুলিস্মাৎ হয়েছে। এ বিষয়ে তাকে প্রকাশ্যে তওবা করার আহ্বান জানান জাকেররা।

এদিকে, সিনিয়র বেশ কিছু জাকের বিষয়টির সুরাহা করার উদ্যোগ নিলেও তা শেষ পর্যন্ত নস্যাৎ হয়ে যায়। তারা জানান, এক পক্ষের একগুয়েমিতার কারণেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়েছে। তবে তারা সুরাহার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত দেখবেন বলে জানান। সূত্র: আমার বার্তা, যুগান্তর ও মানবজমিন