লোকাল বাসে একদিন

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ০৫ ২০২০, ২২:৫৭

।। মাহবুবুর রহমান ।।

ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে সাজগোজ করছে ফারহীন। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। এমন সময় তার মা এসে হাজির।
: কি খবর! আজ এত সকাল সকাল উঠে গেছো বুঝলাম নাতো! সূর্য কি পশ্চিম দিকে উঠলো নাকি? এমনিতে তো বেলা দশটায়ও উঠার নাম নেওনা।
: আম্মু! তুমি কি যে বলো না, শোনো! আজ আমার বান্ধবী তুবার গায়ে হলুদ। আমি না গেলে কিছুতেই চলে না। ওর মাও আমাকে খুব করে বলেছে, তুমি না এলে ওকে সাজাবে কে? তাই আজ একটু তাড়াতাড়ি উঠলাম।
: হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না। টেবিলে নাস্তা দেয়া আছে, খেয়ে নিস!
ফারহিন রেডি হয়ে নাস্তা করতে ডাইনিংয়ে বসতেই ওর আব্বু এসে হাজির।
: বাহবা! আমার সোনামনি আজ এত সকাল সকাল নাস্তা করছে, তাও আবার সেজেগুজে!
: ও আব্বু তোমাকে তো বলা হয়নি আমার বান্ধবী তুবার গায়ে হলুদ।আমার যেতে হবে, তাই রেডি হয়ে নাস্তা সেরে নিলাম।
: আচ্ছা ঠিক আছে, জলদি ফিরবে কিন্তু মামনি! আল্লাহ হাফেজ।

ফারহিন খুব তাড়াহুড়া করে তুবাদের বাড়িতে পৌছলো। ওদের বাড়ি পুরান ঢাকার পাকিস্তান মাঠ এলাকায়। ফারহিনকে দেখে তুবার মা ও অন্যান্য বান্ধবীরা আনন্দে আটখানা, কিন্তু গাল ফুলিয়ে বসে আছে তুবা।কারণ ফারহিন হল তুবার ছোটবেলার বান্ধবী, সেই ক্লাস ওয়ান থেকে যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে একসাথে লেখাপড়া করে আসছে। সবে মাত্র এইচএসসি শেষ করেছে দুজন। ওদের মাঝে সখ্যতা অনেক, তার মধ্যে তুবা একটু জেদি। তার কথা একটাই ফারহিন ছাড়া অন্য কারও হাতে আমি প্রথম হলুদ শাড়ি পড়বো না। ফারহীন তার সাথে প্রমিস করল আর এমন হবে না। চল! কাজ শুরু করি। তুবা যেন তবুও নড়তে চায় না। ফারহিনকে বলছে, সাতসকালে তোমার সাইনবোর্ড থেকে আসতে এত সময় লাগে?!
ফারহিন বুঝতে পারে সে তাকে কতটা আপন করে দেখে, তাই ওর এই অভিমান। কথাবার্তা শেষ করে ওরা কাজে লেগে গেল। যার যার মতো সবাই হলুদের আয়োজনে ব্যস্ত সময় পার করছে। কখন যে বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেল তা কেউ ঠাওর করতে পারলো না। হঠাৎ ফারহীনের ফোন বেজে উঠল!
: এই তোরা একটু থাম! আব্বু ফোন করেছে, কথা বলে নেই।
: জ্বি আব্বু! কেমন আছো? ভালো মা! বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে, তোমার এখনো ফেরার নাম নেই, কখন ফিরবে তুমি?
: কি বলছো আব্বু! আমরা তো এখনো দুপুরের খাবারই খেলাম না, বিকেল হল কখন? চিন্তা করো না, তোমার দোয়ায় তোমার মেয়ের কিছু হবে না। আমি তাড়াতাড়ি ফিরব, ওকে রাখি।
ফোন রেখে দিতে ওদের সকলের চোখ ছানাবড়া! সত্যিই তো, বিকাল চারটা বাজে। তাড়াহুড়া করে সবাই দুপুরের খাবার সারতেই ছেলে পক্ষের লোক হলুদের ডালা নিয়ে হাজির। বিয়েবাড়িতে লোকজনের হৈ হুল্লোড়ে কিভাবে সময় গড়িয়ে যায় তা আন্দাজ করা যায় না। ছেলে পক্ষের লোক যখন বিদায় হলো তখন বাজে রাত সাড়ে আটটা। চিন্তায় ফারহীনের গলা শুকিয়ে এল। ও তাড়াতাড়ি সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরে একটি রিকশা পেলো গুলিস্তান যাওয়ার। রিকশা এগুচ্ছে গুলিস্তান শিশু পার্কের দিকে। এর মধ্যেই চার পাঁচটা ছেলে হেঁটে যাচ্ছে গুলিস্তানের দিকে। ওদের কারো হাতে টিফিন বাটি আর ছোট ব্যাগ। দেখে মনে হয় নবাবপুরের কোন দোকান বা অফিসে চাকরি করে। সকালে বাসা থেকে খাবার নিয়ে আসে রাতে বাসায় ফিরে। ওদের সামনে দিয়ে রিকশাটা যেতেই ওরা লক্ষ করল একটা সুন্দরী মেয়ে হলুদ শাড়ি পড়ে কোথাও যাচ্ছে। চোখে পড়তেই শুরু করল বাজে বাজে কমেন্ট, দিতে লাগলো শিস। ফারহীন জড়োসড়ো হয়ে চুপ করে বসে রইলো। ভাবতে ভাবতে রিকশা থামলো শিশু পার্কের সামনে। ওমনি বখাটে ছেলেগুলো এখানে এসে হাজির। ভাগ্যিস! এখানে লোকজন থাকায় ওরা তেমন কোন আওয়াজ করছে না। সবাই বাসের অপেক্ষা করছে। এরমধ্যে একটা বাস এসে থামল, কিন্তু লোকজনের ভিড় ঠেলে বাসে ওঠা ফারহীনের পক্ষে সম্ভব হলো না। ওকে না উঠতে দেখে মনে হয় দুষ্টু ছেলেগুলোও এই বাসটাতে উঠলো না। এরপর দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করছে সবাই। কোন গাড়ি আসছে না। প্রায় দশটা বেজে গেছে। এদিকে বাসায় আব্বু-আম্মু টেনশন করছে। অন্যদিকে রাত হয়েছে, গাড়ি পাওয়া যাচ্ছে না, তার উপর দুষ্টু ছেলেদের বদনজর, সবমিলিয়ে ঘেমে ভিজে উঠেছে ফারহীন।

২.
আদনান মাদ্রাসা পড়ুয়া এক সুদর্শন যুবক। নিজ প্রয়োজনে ঢাকায় এসেছিল, কাজ সেরে ফিরতে রাত হয়ে গেল। সে গুলিস্তান শিশুপার্কের সামনে বাসের অপেক্ষা করছিলো, এরমধ্যে একটি বাস এসে হাজির হল।

রাত দশটা: গুলিস্তানের চাররাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষায়। দোকানপাট গুছিয়ে সবাই বাড়ির পথে। অনেকক্ষণ পরে একটি কোমল বাস এসে যাত্রী উঠাবার ডায়লগ সিটিং সার্ভিস বলে বলে হাক দিচ্ছে। সিটিং বাস না জেনেও বাসে উঠে পরলো আদনান। এতো রাতে বাসটা মিস করলে আবার দাঁড়িয়েই থাকতে হবে, তাই।

মোবাইলে খুটিনাটি কি যেনো করছিল সে। হঠাৎ মেয়ে মানুষের আদেশ।
: এই যে, চাপেন। পাশের সিটে আমি বসবো। জি,মানে…!
এদিক ওদিক তাকিয়ে অন্যখানে বসার ইংগিত দিয়ে বললো-
: আমার পাশে? এখানে বসবেন?
: হ্যাঁ! এখানেই বসবো।

কি আর করার, উঠে পরলো লাজুক হুজুর। মেয়েটি সিটে বসলো। হুজুর দাঁড়িয়ে আছে, কারণ বাসের কোথাও সিট খালি নেই।

মেয়েটির আবার আদেশ।
: এই যে! দাঁড়িয়ে আছেন কেন?? আপনার সিটে আপনি বসুন।

এবার একটু দম নিয়ে হুজুর বললো: না। আমি মেয়েদের পাশে বসি না। বসতে পারি না।

এ কথা বলা মাত্রই পিছন থেকে তিন/চারটে ছেলে অট্রহাসিতে ফেটে পরলো। ফিসফিস করে একজন আরেকজনকে বলছে, দেখ! দেখ! হুজুর, কি অফারটাই না মিস করছে! আরেকজন বললো, আরে! এসব গাইয়্যা ক্ষ্যাত হুজুর এগুলোর কি বুঝবে? তবুও হুজুর বেচারা চুপ। সব শুনছে, কিন্তু কিছুই বলছে না।

মেয়েটি হুজুর ছেলেটিকে এবার খুব নরমসুরে বললো, বুঝেছেন? কেনো আপনার পাশে আমি বসলাম।ছেলেগুলা আমাকে সেই রাস্তা থেকে ফলো করছে। রাত অনেক হয়েছে, তাই! বাসটাও ছাড়তে চায়নি। এই বাসে উঠবো জেনে ওরা আগথেকেই বাসে বসেছিলো। কিন্তু বাসে উঠে দেখি আপনার পাশে সিট খালি। আর আপনি হুজুর মানুষ। তাই নিজেকে নিরাপদ রাখতেই তড়িঘড়ি করে আপনাকে চাপিয়ে আপনার অনিচ্ছা হলেও আপনার সাথে বসে পড়েছি।

এতো কথার পরও হুজুর কিছু বলছে না দেখে আবার মেয়েটিই বললো, কি করবো বলুন? বান্ধবীর গায়ে হলুদে গিয়েছিলাম। দেরি হয়ে গেছে অনেক। মা টেনশন করছে কখন বাড়ি ফিরবো! হুজুর শুধু শুনেই যাচ্ছে। কিছুই বলছে না।

ধীর গতিতে বাস চলছে। টিপ্পনী মশকরা তো ওদিকে আছেই, আদনানও খুবই ক্লান্ত। আবার গাড়িতে ঝুলে ঝুলে বাসায় ফিরা, এসব কিছুর পরও সে নিজেকে সামলে নিচ্ছিল।
থাক! আমার একটু সেক্রিফাইসে যদি একটি মেয়ে ইভটিজিংয়ের হাত থেকে রেহাই পায় তাহলে মন্দ কি?! ওদিকে আবার মেয়েটির বাবা-মা চিন্তা করছে। যদিও এই টেনশন নিজের যুবতি মেয়েকে বেপর্দা বিয়ের অনুষ্ঠানে পাঠানোর আগেই করা উচিৎ ছিলো। এটাই আমাদের অভিবাবকদের সবচেয়ে বড় অপরাধ। এটা তাদের চরম দায়িত্বহীনতা ও উদাসীনতা ছাড়া আর কি? ছেলে মেয়ের সর্বনাশের পর ভাবে, এর আগে ভাবে না। আফসোস! শত আফসোস! এমনি নানা বিষয় নিয়ে ভাবছে আদনান।

এরমধ্যেই মেয়েটির স্টেশন এসে গেলো। নেমে পড়বে।

ফারহীন: একটুপর আমার স্টেশন। আপনাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেললাম। মাফ করবেন আমাকে। আর আরেকটি রিকোয়েস্ট! আমি আপনার ফ্রেন্ড হতে চাই। জাস্ট ফ্রেন্ড। প্লীজ!

এবার নিরুপায় হয়ে হুজুরকে কথা বলতেই হলো। সালাম দিয়ে বললো,‌ দেখুন!

আজ এই পৃথিবীতে যত বোনের ইজ্জত নষ্ট হয়েছে এর প্রথম সূত্রপাত ছিলো, “জাস্ট ফ্রেন্ড হতে চাই” এই কথাটি দিয়ে।

আমি আপনি সবাই একে অপরের জন্য। আমরা সবাই এক কালেমার মুসলমান। তাই এতটুকু বলবো, আপনি যেমন অপরূপ সুন্দর করে নিজের বাহিরটা সাজিয়ে রেখেছেন তেমনি আজ থেকে ভেতরটাও সুন্দর করে উত্তম চরিত্র দিয়ে সুসজ্জিত করুন প্লিজ! তাহলে দেখবেন, এত রাতে আর কখনো অনুষ্ঠান থেকে ফেরা অবস্থায় অসহায় হয়ে বাসের যাত্রী হতে হবে না। সম্মুখীন হতে হবে না ইভটিজারদের। রাত জেগে কাঁদতে হবে না বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা-মায়ের। আর শুনুন! “তুমি সেই রানী” নামক বইটি উপহার দিয়ে বললো, এটা আপনাকে উপহার। পড়লে আমি খুশি হবো। আমি চাই, আপনিও সেই রানী হোন বইয়ে যেই রানীর কথা লিখা আছে।

ফারহীন: সত্যিই! আজ আমি নতুন এক অনুভূতি নিয়ে বাসায় ফিরছি। জীবনে প্রথম দেখলাম, একটি মেয়ে বন্ধু হতে চাইলো বাট! ছেলেটা হল না। দোয়া চাচ্ছি, আজকের অনুপ্রেরণা যেনো জাগ্রত থাকে আমাতে সবসময়।

আর শুনুন! আমিও আমার সন্তানকে আপনার মতো মাদ্রাসায় পড়াবো।

আদনান: আল্লাহ তায়ালা আপনার নেক আশা কবুল করুন। আমীন!