রাজনীতির বাজারে আমি সিয়াসত খুঁজিয়া ফিরি

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ০৪ ২০১৮, ২০:০৫

রশীদ জামীল : ‘বক্তব্য পরে শুনব। আগে বলুন আপনার পরনে নতুন জামা দু’টি এল কোত্থেকে? রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে আমরা পেলাম একটি করে, আপনি দু’টি নিলেন কোন অধিকারে?’

জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন খলিফাতুল মুসলিমীন উমর ইবনুল খাত্তাব। দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ জানালো সাধারণ একলোক। জবাব দিন। জবাব দিতে না পারলে আপনার খুতবা শুনব না।

খলিফা জবাব দেবার আগেই দাঁড়িয়ে গেলেন খলিফাপুত্র আব্দুল্লাহ। ‘আমার বাবা আপনাদের মত একটি জামা-ই নিয়েছেন। আজ জুমার নামায পড়ানোর জন্য আমি আমার অংশে পাওয়া নতুন জামাটি আমার বাবাকে পরতে দিয়েছি। তাকিয়ে দেখুন আমার পরনে সেই পুরনো জামা-ই আছে এখনো।
লোকটি বসে পড়ল। এবার খুতবা দিন।

উমরের মত জাদরেল একজন শাসক, যার সামনে বনের বাঘও দাঁড়াবার সাহস পেত না, সেই উমরের সামনে অভিযোগের আঙুল উচিয়ে দাঁড়িয়ে যাবার অধিকার পেত গ্রামের সাধারণ মানুষও। এটা ছিল তাদের ইসলাম। আর এ যুগে যদি বড় কোনো আলেমের কথা বা কাজের মুয়াদ্দবানা সমালোচনাও করা হয়, সেটা হয়ে যায় বেয়াদবি! হয়ে যায় গোস্তাখি! বলাহয় ‘দেখো কতবড় নাদান! হযরতের কথার জবাবে কথা বলে’!
কেনো?
এটা কোন ইসলাম?
এটা কোন গ্রহের ইসলাম?

দুই
রাস্তায় দৌড়াচ্ছিল পিচ্চি এক ছেলে। ইমামে আযম আবুহানিফা সে দিকেই যাচ্ছিলেন। বললেন, ‘বাবারে, সতর্কতার সাথে চল। পা ফসকে পড়ে যেতে পার। দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে’!
ছেলেটি বলল, ‘ইমাম সাহেব, আমারচে’ বরং আপনাকেই বেশি সতর্কতার সাথে পা ফেলা উচিত। আমার পা ফসকালে তো আমি একা ধ্বংস হব আর আপনার পা ফসকালে পুরো জাতি ধ্বংস হবে’।

উলামায়ে কেরাম আমাদের মাথার তাজ। তাদেরকে আমরা বিচ্যূত মনে করি না। তারমানে এই না যে, আমরা তাদেরকে ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে ভাবি। সমসাময়িক যে কোনো ব্যাপারে তাঁরা যখন মতামত দেবেন, সেটা তাদের ইজতিহাদি মতামত হবে। সঙ্গতকারণেই ভিন্নমত আসতে পারে। আর ভিন্নমত মানেই যে বিরোধিতা নয়- এটাও যারা বুঝেন না, তাদের উচিত আমাজনে চলে যাওয়া।

আরেকটি ব্যাপারেও আমাদেরকে বিব্রত হতে হয়। সেটাহল সবকিছুতে চোখবন্ধ একাত্বতা! একটা আল্লাহর আ’দত, একটা হল কুদরত। পৃথিবী চলে আল্লাহর আ’দতি নেযামে, কুদরতে নয়। সবকিছুতে কুদরতানা কথাবার্তা বলার কোনো কারণ ছিল না। এটুকুই বললাম। যারা বোঝার, এটুকুতেই বুঝে ফেলবেন। আর কেউ না বুঝলে তাঁর আর বোঝার দরকার নাই। জরুরি কিছু না।

তিন
ওরাসাতুল আম্বিয়াদের মধ্যে নবীওয়ালা আখলাকের অনুপাত নিয়ে কথা বলবার অধিকার সকল মুসলমানের থাকা উচিত। ফহমিক স্বেচ্ছাচার, অহমিক নিমগ্নতা, আত্মকেন্দ্রিক অহমিকা, আত্মভোলা বুযুর্গি আর অতিন্দ্রীয় বিকেন্দ্রিকতা নিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কথা হয়। বিন্যাস্তাকারে কথা বলা দরকার। জাতিকে বিভ্রান্তি থেকে বাঁচানোই নয় শুধু, রক্ষার জন্যও।

উলামায়ে কেরাম যেহেতু নবী বা সাহাবি না, সে জন্যে তাদের কর্মকাণ্ড ভুলের উর্ধ্বে হওয়ার কোন কারণ নাই। আমরা যদি সবকিছুতে ‘জি হুজুর, জি হুজুর’ বলে যাই, তাহলে সামনে আরো কঠিন দুর্দিনের সামনা করতে হবে। সুতরাং, কারো ভাবা-ভাবি আর মনে করা-করির দিকে চেয়ে থেকে মুসলিহতের তসবিহ জপার মানে হয় না। আমরা আমাদের কথা বলব। অবশ্যই বলা দরকার। শুধু খেয়াল রাখব কথা যেনো আদবের সীমাটা না ডিঙায়, ব্যস।

চার
ইসলামের দু’টি পরিভাষা- ইলহাদ এবং বিদ’আত। ইলহাদ মানে মৌলিক মানদণ্ডে নিক্তির নিম্নগামিতা। বিদ’আত হল দ্বীনিয়াতে স্বেচ্ছা-সংযুক্তি তথা প্রান্তসীমা ডিঙানো। সহজ উদাহরণ দিই।

‘কবরের পাড়ে গিয়ে সালাম দিলেও নবীজি শুনেন না’, এটা ইলহাদ নামক বিচ্যূতি। ঘরে বসে সালাম দিলে নবীজি সেটাও শুনে ফেলেন, এটা বিদ’আত নামের বিভ্রান্তি। আর, কবরপাড়ে গিয়ে সালাম দিলে নবী সরাসরি শুনেন, দূরে থেকে দিলে পৌঁছে দেয়াহয়, এটা হল প্রকৃত অবস্থা। এই অবস্থার অন্য নাম সিরাতে মুস্তাক্বীম।

উলামায়ে কেরাম শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁদেরকে সম্মান করতে হবে। তবে তাঁদেরকে তাঁদের অবস্থানেই রাখতে হবে। সাধারণ মানুষের কাতারে নামিয়ে আনা যাবে না আবার নবীগণের কাতারেও নিয়ে যাওয়া যাবে না। নো ইলহাদ, নো বিদ’আত। দ্যাটস ইট।

পাঁচ
কেউ যেনো এসে ‘ইসলামি সিয়াসতও যে একটি ইবাদত’, এই জ্ঞান বিতরণ না করেন। আমরা সেটা জানি। বিশ্বাসও করি। তবে আরেকটি কথা হয়ত আপনারা জানেন না, আমরা সেটাও জানি। আর কথাটি হল হাকিম মুহাম্মাদ আখতার রাহমাতুল্লাহি আলাইহির। তিনি বলেছিলেন তাঁর খলিফা মাওলানা আসগর হোসাইন সাহেবকে। মাওলানা আসগর হোসাইন আমাকে। কথাটি হল,

‘মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি রাজনীতি করতেন, তাহাজ্জুদও পড়তেন। এখনকার উলামাও রাজনীতি করেন তাহাজ্জুদও পড়েন। কিন্তু মাওলানা মাদানির রাজনীতি ছিল তাহাজ্জুদের সমপর্যায়ের, আর এখনকার তাহাজ্জুদ চলেগেছে রাজনীতির পর্যায়ে। (চেতনার আস্তিন, পৃষ্ঠাঃ ৩৬-৩৭, প্রকাশকাল, ডিসেম্বর, ২০১৬)

এই জীবনে অনেক কিছুই জানা হল না। এই যেমন, ‘ইসলামী রাজনীতি’ আর ‘ইসলাম নিয়ে রাজনীতি’ যে একটি সমার্থক শব্দ, এই সহজ ব্যাপারটিও আমি জানতাম না। আর এ জন্যই কেউ যখন আমাকে বলে, বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির ভবিষ্যত কেমন, তখন আমি বলি, একটা বাতি নিয়ে আসুন, আগে বর্তমানটা দেখি।