মেঘালয়ের পথ ধরে । খালিদ মাহমুদ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ৩০ ২০২৩, ২২:২৫

খালিদ মাহমুদ: আমি জুড়ে নিরানন্দদের জয়জয়কার। খানিক পর পর কেমন যেন জ্বালা করছে হৃদয়গত ক্ষত। ভালো না লাগাদের অবর্ণনীয় অভিযোগ আমার ঘাড়ে। ভ্রমণ প্রিয় সেই মনোভাব জানিনা কালের কোন চক্রে হারিয়ে গেল নাকি এখনো কোন রকম টেনেটুনে বেঁচে আছে। দিন রাত শুধু ঘুরে দেখার চেতনা আমাকে ভবঘুরে হতে চাবুক মারে এখানে ওখানে। লোকজনের অনিয়ন্ত্রিত চলনে পথঘাটে বিপদকে দেখি অহর্নিশ। মনে হয় যেন সফরটাও বুঝি খানিকটা অসঙ্গত। তবুও আমি আনন্দের মোহনায় পাহাড়, নদী আর মেঘ দেখতে বের হওয়ার বন্দোবস্ত করি সন্তর্পণে।

ঈদুল আজহার আনন্দ ভাগাভাগি চলছে এখনো। ছুটি ফুরাতে আরো কয়েক দিন বাকি। কয়েক জন মিলে মেঘালয় রাজ্যের আশপাশ ঘুরে দেখব।

প্রখর রৌদ্রময়দুপুর বিকেলে গড়াতে শুরু করবে একটু পর। বিস্তীর্ণ আকাশে উড়াউড়ি করছে খন্ড খন্ড সাদা মেঘ। মোটর বাইক চেপে বসে আছি। পিচঢালা সড়ক অতিবাহিত করছে চোখের পলকে যেন। কিছুপথ এগুতেই শুরু হল কাঙ্ক্ষিত জায়গা ঘুরে দেখার মানচিত্র। সারি সারি গাছ রাস্তার দু’ধারে। সড়কের এপারে ওপারে খোলা আকাশের নীচে বিস্তৃত জায়গা জুড়ে আছে কৃষিখেত। তারপরই উঁচু উঁচু পাহাড় যেন আকাশ ছোঁয়ার প্রয়াসে আছে।

প্রকৃতি ঘেরা এই এলাকার নাম লাউড়েরগড়। এখানের সুন্দর ব্যাতিক্রম, কতো বৈচিত্র্য। শহরের কোলাহলময় হিজিবিজি ছেড়ে এখানে খানিক বিচরণ অপার্থিব ভালোলাগারা জানান দেয়।

আকাশ তখনও পরিষ্কার । যাদুকাটা নদীর পাড়ে হেঁটে হেঁটে খানিকক্ষণ থামি, দু’চোখ ভরে পান করতে থাকি পাহাড়ের চলে আসা নদীর রূপমাধুরী। ছবি দেখে উন্মত্তবৎ হয়ে তাকে চাক্ষুষ করতে আসার আকাঙ্ক্ষা প্রতি মুহূর্তে সার্থক হয়, সার্থক হয় এই সাময়িক হাঁটাচলা। অপূর্ব সুন্দর নদী পার হয়ে সবুজ ঢেউ খেলানো এক টিলার পরে একসময় পৌঁছাই । উপরে উঠি, অপেক্ষায় থাকি আরও কত সুন্দর হয়ে, আরও কত শোভা বিস্তার করে এই স্বর্গীয় পথ আমাদের জীবনকে কৃতার্থ করবে। প্রচণ্ড হাঁপ ধরে। বারবার থামতে হয়। তারই মাঝে ছেড়ে দিতে হয় পথ। শুধুই হাঁটা, উপরে ওঠা, বিশ্রাম নেওয়া, জল খাওয়া – এসবের মাঝে দুদণ্ড অবকাশ মেলে না। যে প্রবল ভালোলাগায় হৃদয় মথিত হয়ে চলেছে, যে প্রবল আবেগে মস্তিষ্ক আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে, তাকে চলতে চলতেই উপভোগ করতে হয়। সবুজ টিলাগুলো মনমোহিনী হয়ে বিভিন্ন বাঁকে দৃশ্যমান হয়। যেন অপূর্ব সুন্দর হাতছানি দিয়ে নীচে ডাকে, উপরে উঠতে বাধা দেয়। তবু উঠি, তার অপরূপ বিভঙ্গকে আরও মধুর রূপে চাক্ষুষ করার জন্য তার হাতছানি উপেক্ষা করতেই হয়। অবশেষে পৌঁছে যাই একটি গির্জার পাসে। অনিন্দ্যসুন্দর এই জায়গার নাম বারেকটিলা। এখানের আঁকাবাঁকা রাস্তা গুলো দেখেই কেমন যেন প্রাচীন কিছুর জানান দিতে লাগল। এখানে দাড়ালে খুব কাছ থেকে মেঘ দেখা যায়।দেখাযায় ধীরে ধীরে বাতাসের নিয়ন্ত্রণে ভাঙা মেঘের টুকরো গুলো এদিক হতে চলে যাচ্ছে ওদিকে।একটু হাত বাড়ালে বুঝি ছুঁয়ে দেখাযেত মেঘখণ্ড। সীমান্তের অতন্ত্রপ্রহরীদের অনবরত বকবকানিতে তা আর ফুরসত হয়ে ওঠেনি। পিছনে এক আকাশ মেঘছুঁয়ার আক্ষেপ নিয়ে নামতে শুরু করি টিলা থেকে। উঁকি দিতেই নাম না জানা পাহাড়ি প্রজাতিদের এক গোষ্ঠী চোখে পারে। তারপর পাহাড়ি নীরব রাস্তাধরে দ্রুতপায়ে চলতে শুরু করি মেঘালয় রাজ্যের সিমান্তে।

তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছিল। আকাশও চলে যাচ্ছিল মেঘেদের দখলে। শীতল বাতাস বইতে শুরু করল।

পৌঁছেগেলাম লাউড়েরগড় সিমান্তে, তারকাঠার একদম কাছাকাছি। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিলাম খানিক্ষন। সীমান্তের ওপাশে দেখা যাচ্ছে ভারতীয় উপজাতিদের আনাগোনা। আমার দেশ থেকেই সীমান্তের ওপারের একজনের ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করে নিলাম উর্দুতে। ততক্ষণে ইন্ডিয়ান বি এস এফ হাজির। কাধে রাইফেল ঝুলিয়ে একজন জিজ্ঞেস করতে লাগল ‘কিস লিয়ে আয়া? আমি কেবল বড় বড় চোখে তাকিয়ে তাদের দেখছি। কি বলব কি না এসব ভাবতে ভাবতে ওপরজন বলে উঠল ‘আব পেহলে বার আয়া এ্য জাগা ম্যে?

মিনমিন করে কোনরকম জবাব দিলাম। ততক্ষণে সীমান্তের বাতি গুলো জ্বলে ওঠেছে। সাথের মানুষজন আলোকচিত্র গ্রহনে ব্যাস্ত। কুয়ী পিক নেহী চল যাও ইদর ছে’ ইন্ডিয়ান প্রহরীর কর্কশ কন্ঠে এই নির্দেশ শুনে আর দাড়িয়ে থাকার সাহস বাকি থাকে নি।

ফিরতি পথ ধরলাম গোধূলির আলো বাতাস গায়ে মেখে। আনন্দে, উচ্ছ্বাসে এলাকার সঙ্গে কেমন যেন অদ্ভুত আত্মিক টান অনুভূত হয়। প্রকৃতিপ্রেম আরও বৃদ্ধি হয় এই আনন্দঘন পরিবেশে।

ওখানে গেলে পাই ধুলোমাখা পথ। চোখ মেললে দেখা যায় দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়ছে ক্রমশ। বর্ষার আকাশ অথবা দুপুরের হাওয়া বর্নণাতীত অনুভূতির জোগান দেয়। আমার বোকা শৈশবের বস্তু আর হঠাৎ হঠাৎ দেখা হওয়া ছোট কালের কোন চিরচেনা মুখ তীব্র করে ভাবনার মূলমন্ত্র। মাদ্রাসা হতে যখন বাড়ি ফেরা হয় ওদিকে ঘুরাঘুরির আকাশসম ভাবনা মাথায় জমাট বাঁধে। তারপর আর কোথাও যাওয়া হয়না। ছুটির দিন ফুরিয়ে এলে যাওয়ার প্রাক্কালে যাপিত দিনের স্মৃতি নীরবে নিভৃতে আহত করতে থাকে। তারপর যাওয়া হয়ে গেল ভালো লাগার জায়গায়। আকাসের ধূসর ফিতায় ঝুলে টুপটাপ ঝরে যাচ্ছে এই সব স্মৃতি। ভাবলেই বিষাদেরা উঁকি দেয় হৃদয়ে। একদিন একটু একটু করে স্মৃতিরা মুছে যায়। অদ্ভুত সন্ধ্যার দিকে তখন কুয়াশা জমে ওঠে। মনের আকাশে মেঘ জমে। এভাবেই হুট করে একদিন চলে যাওয়া হয় পৃথিবীর পরিচিত অলিগলি হতে আর ফেরার আশাদের চিরতরে দাফন করে।