মুরসী ও মিশর প্রসঙ্গে

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ১৯ ২০১৯, ১২:৫৯

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

কারাগারে মোহাম্মদ মুরসীর মৃত্যু বিভিন্ন রকমের রাজনীতি সচেতন মুসলিম চেতনার বাহকদের মধ্যে এক গভীর আবেগ ও সংকল্পের স্রোত বইয়ে দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বের মাগরিব থেকে শুরু করে মাশরিক পর্যন্ত এই যুগপত শোকার্ত বেদনা ও অগ্নিময় অঙ্গীকারের ফল্গুধারা হৃদয় থেকে হৃদয়ে প্রবহমান। মিশরের নব্য ফেরাউন সিসির কারাগারে বন্দী মুরসীর এইভাবে নির্যাতনে নিষ্পেষণে মৃত্যু অনেকের কাছে তাঁকে শহীদের মর্যাদা দিচ্ছে। জীবিত মুরসীর চাইতে মৃত মুরসী আরো অনেক বেশি শক্তিমান হয়ে উঠবেন বলে মনে হচ্ছে।

মুসলিম বিশ্বে এই উত্তর ঔপনিবেশিক ও উত্তর আধুনিক কালে নানা রকমের ইসলামী আন্দোলন চলছে। এর ভেতরেও রয়েছে মতাদর্শ ও কার্যপ্রণালী নিয়ে ব্যাপক পার্থক্য ও বৈচিত্র্য। মিশরের ইখওয়ানুল মুসলীমীন এই বিভিন্ন ধরণের মুসলিম রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলোর মধ্যে একটি প্রধান ধারা। হাসান আলা বান্না ও সাইয়্যিদ কুতুবের সম্মিলিত নেতৃত্বে সূচিত এই আন্দোলনে মোহাম্মদ মুরসি সাম্প্রতিক কালে নেতৃত্ব দিয়ে ইতিহাসে নিজের জন্য একটি আসন করে নিতে সক্ষম হলেন। এ আন্দোলনের শহীদী কাফেলায় শামিল হলেন।

এই আন্দোলনের মূল বৈশিষ্ট্য হল এই যে এটি পশ্চিমা গণতন্ত্রের আদলে যে উপনিবেশোত্তর উত্তরাধুনিক নির্বাচনভিত্তিক সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া রয়েছে সেখানে পুরোদমে অংশগ্রহণ করাকে সঠিক কাজ বলে মনে করেছে। এবং সবচাইতে বড় কথা এই নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিজয় অর্জন করে ক্ষমতাসীনও হতে পেরেছে। আলবৎ তাদের ক্ষমতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বিভিন্ন দেশি বিদেশি শক্তির মিলিত প্রতিঘাতে অল্পকালের মধ্যেই ক্ষমতাচ্যুত হয়ে নির্মম নির্যাতন ও দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়েছে। এক্ষেত্রে মিশর ও পাশ্চাত্যের সেক্যুলার লিবারেল ডেমোক্রাটিক এজেন্সিগুলি এক হয়ে কাজ করেছে। একটি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে ব্রুটাল মিলিটারি ডিক্টেটরশীপ দিয়ে নস্যাত করে দিতে কুন্ঠিত হয়নি।

এই ক্ষমতার লড়াইয়ে মিশরীয় সেনাবাহিনী, সেক্যুলার পাশ্চাত্যমুগ্ধ সমাজ, কট্টর সালাফী-ওয়াহাবী সৌদী-আমিরাতী রাজতন্ত্র, জায়নবাদী ইসরাইল ইত্যাদি সবাই এককাট্টা হয়েছিল। পশ্চিমা গণতন্ত্রের অন্তঃসারশূন্যতা এই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একটি ভন্ডামি আকারে প্রমাণিত হয়েছে। তাহরির স্কয়ারের আরব বসন্তের মধ্যে যে গণতন্ত্রের সুবাতাস রয়েছে বলে পাশ্চাত্য আবেগে আপ্লুত হয়েছিল সেই পাশ্চাত্যই গণতন্ত্রের ফলাফল নস্যাত করতে অবলীলায় চরম অগণতান্ত্রিক পদ্ধতি অবলম্বন করেছে।

আসলে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের এই ভন্ডামি ও ডাবল স্ট্যান্ডার্ড প্রকাশিত হয়ে আসছিল অনেক আগে থেকেই। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় গত শতকের নব্বই দশকের প্রথম দিকে আলজেরিয়ার অভিজ্ঞতাকে। সেখানেও গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইসলামপন্থী শক্তিকে সামরিক শাসন দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। তাহলে দেখা যাচ্ছে পশ্চিমা শক্তিগুলি মুখে গণতন্ত্রের কথা বলে। কিন্তু তারা গণতন্ত্রের কাঠামোতে একধরণের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চায়। সেখানে তাদের নিজস্ব প্যারাডাইমের বাইরের কোন প্যারাডাইমের প্রবেশাধিকার দিতে চায় না।

বাংলাদেশ মিশর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত দক্ষিণ এশীয় একটি মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। মিশরের এই অভিজ্ঞতা ও বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় বেশ কিছু সাদৃশ্য আছে বটে। ভিন্নতাও আছে। তবে মিশর ও মুরসীর অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।