অপচয় মানবতার অভিশাপ

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ০৬ ২০২০, ১২:৩৬

মুফতী গোলাম রাজ্জাক কাসেমী;

ধন-সম্পদের সঠিক ব্যবহার এবং এর যথাযথ আদান-প্রদানের মাধ্যমে সমাজের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং দেশ ও সমাজের সমৃদ্ধি বাস্তবায়িত হয় ৷ ধন-সম্পদ আল্লাহর দান তাকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ না করে নষ্ট করার অধিকার কারো নাই ৷ কারণ এ সম্পদ একদিকে যেমন আল্লাহর নিয়ামত, আবার তা আমাদের হাতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমানতও। তাই এর যথাযথ ব্যবহার না করলে, অযথা-অপ্রয়োজনে তা নষ্ট করলে, অপচয় করে বেড়ালে এ আমানতের খেয়ানতকারী হিসেবে জবাবদিহিতার মুখেও পড়তে হবে৷ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের জন্যে তিনটি বিষয়কে অপছন্দ করেন- (১) অপ্রয়োজনীয় প্রসঙ্গে আলোচনা করা/না জেনে আন্দাজে কথা বলা, (২) সম্পদ নষ্ট করা, (৩) অধিক প্রশ্ন করা।’ (বুখারি : ১৪৭৭) বোঝা গেল, সম্পদ নষ্ট করা আল্লাহ তাআলার নিকট একটি ঘৃণ্য বিষয় ৷ তাইতো আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন , ‘হে বনী-আদম! তোমরা প্রত্যেক নামাজের সময় সাজসজ্জা পরিধান করে নাও এবং খাও ও পান কর ৷ কিন্তু অপচয় করো না। তিনি অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না।’ (সুরা আরাফ : ৩১)

অপর আয়াতে ইরশাদ করেন, তোমাদের যা দান করেছি, তা থেকে ভালো ও হালাল বস্তু আহার করো এবং এ বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করো না। করলে তোমাদের ওপর আমার ক্রোধ অবধারিত এবং যার ওপর আমার ক্রোধ অবধারিত, সে তো ধ্বংস হয়ে যায়।’ (সুরা ত্বহা : ৮১)

আজ খাদ্য সংকট মানবতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি ৷ বিশ্বে উৎপাদিত খাবারের মধ্যে আনুমানিক প্রায় এক তৃতীয়াংশই হারিয়ে যায় বা নষ্ট বা অপচয় হয়। খাদ্যের অপচয় শুধু খাবারের অপচয় নয়, এর মানে হচ্ছে অর্থের অপচয়, পানির অপচয়, জ্বালানির অপচয়, ভূমির অপচয় এবং পরিবহণের অপচয়। এমনকি আপনার ফেলে দেয়া খাবার জলবায়ু পরিবর্তনেও নেতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। ফেলে দেয়া খাবারের স্থান হয় ভাগাড়ে যেখানে এগুলো পচে মিথেন গ্যাস তৈরি করে। উল্লেখ্য যে, খাবারের বেঁচে যাওয়া অংশ ফেলে দেওয়া ইদানিং তথাকথিত সুশীল সমাজের ভদ্রতা (?) হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ খাবারের উচ্ছিষ্ট নষ্ট করা যেন ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে ৷ অথচ অতিরিক্ত সম্পদ বা খাদ্যটুকু অপচয় না করে গরিবের শূন্য হাঁড়িতে ঢেলে দিলে একদিকে যেমন অপব্যয়ের গুনাহ থেকে বাঁচা যায়, অন্যদিকে শূন্য হাঁড়িগুলো প্রাণ ফিরে পায়।

পবিত্র কোরআনে অপচয়কারীদের শয়তানের ভাই হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আত্মীয়-স্বজনকে তার হক দিয়ে দাও এবং অভাবগ্রস্ত ও মুসাফিরকেও। আর কিছুতেই অপব্যয় কোরো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ২৬-২৭)

দুঃখজনক হলো, কিছু মানুষ ‘রহমানের বান্দা’ হওয়ার চেয়ে শয়তানের ভাই হওয়াটাকেই বেছে নিচ্ছে। অপচয় এখন আমাদের সমাজের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষের এখনো নিয়মিত তিন বেলা খাবার জোটে না, অন্যদিকে পৃথিবীর মোট উৎপাদিত খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশই অপচয় হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, বিশ্বে বছরে প্রায় একশ’ ত্রিশ কোটি টন খাদ্য অপচয় হয়, যা মোট উৎপাদিত খাদ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। অপচয় হওয়া বিপুল পরিমাণ এই খাবারের এক-চতুর্থাংশ বাঁচানো গেলে ৮৭ কোটি মানুষের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। খাদ্য অপচয়ের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় পঁচাত্তর হাজার কোটি ডলার। বিশ্বে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটায় কোটি কোটি মানুষ। কিন্তু থেমে নেই উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে খাদ্য অপচয়। উন্নত দেশগুলোতে বছরে মাথাপিছু খাবারের উৎপাদনের হার ৯০০ কেজি। এর মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে পশ্চিমা দেশে মাথাপিছু অপচয়ের হার ৯৫ থেকে ১১৫ কেজি। বিপণন পর্যায়ে পণ্যের মান বিবেচনা করতে নিয়েও নষ্ট হয় প্রচুর খাদ্য। বছরে শিল্পোন্নত দেশে ৬৮ হাজার কোটি, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে খাবার অপচয়ের বাজার মূল্য ৩১ হাজার কোটি ডলার। উন্নয়নশীল দেশে জমি থেকে ফসল সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত পর্যায়ে ৪০ শতাংশ খাদ্য নষ্ট হয়। আর শিল্পোন্নত দেশে ৪০ শতাংশ খাদ্য নষ্ট হয় বিপণন ও ভোক্তা পর্যায়ে। ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পর্যায়ে নষ্ট হওয়া খাবার কৃষকের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ায় এবং সবশেষে ভোক্তা পর্যায়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। এফএওর মহাপরিচালক হোসে গ্রাসিয়ানো ডি সিলভা জানান, অপচয় হওয়া খাদ্যের পরিণাম ব্যাপকভাবে বিস্তৃত। ভোক্তারা প্রতিদিন, বিশেষ করে ধনী দেশগুলোতে যে বিপুল পরিমাণে খাদ্য নষ্ট করেন তা পুরো আফ্রিকার সাবসাহারা অঞ্চলে উৎপাদিত খাদ্যের সমান। খাদ্য নিরাপত্তা এবং বিশ্বকে টেকসই করার ক্ষেত্রে এর নেতিবাচক প্রভাব ব্যাপক। তিনি বলেন, এই খাদ্য অপচয় যদি কমানো সম্ভব হয় তাহলে খাদ্যের সরবরাহ বাড়বে, উৎপাদন বাড়াতে হবে না এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর চাপ কমবে। বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর খাদ্য অপচয়ের যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সেই প্রবণতাকে অবশ্যই বিপরীতমুখী করতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ডি সিলভা বলেন, বিশ্বের মোট খাদ্যের এক-তৃতীয়াংশই নষ্ট বা অপচয় হয় কারণ আমাদের এমন সব আচরণ যা যথাযথ নয়। অথচ ওই একই সময়ে বিশ্বে দৈনিক সতেরো কোটি লোক ক্ষুধার্ত অবস্থায় দিন কাটান। তিনি জানান, বিশ্বে যে পরিমাণে খাদ্য অপচয় হয় তা সুইজারল্যান্ডের সারা বছরের মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির সমান। বিশ্বে যেসব মাছ ও সামুদ্রিক খাদ্য নষ্ট হয় এবং অপচয় হওয়া খাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য ব্যয় এই হিসাবে অন্তর্ভুক্ত নয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক সংস্থার কর্মকর্তা রবার্ট ভ্যান অথারিভজক বলেন, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, মানুষের অভ্যাস ও বিভিন্ন কারণে মানুষের খাদ্যের অপচয় হয়। আর খাদ্যের অপচয় হলে তার উৎপাদনে ব্যবহৃত পানি, জমির শক্তি ও অর্থের অপচয় ঘটে। কৃষকসহ বেসরকারি পর্যায়ে সচেতন হলে প্রচুর পরিমাণ খাদ্য অপচয় রোধ করা সম্ভব। ফুড ওয়েস্টেজ ফুটপ্রিন্ট : ইমপ্যাক্টস অন ন্যাচারাল রিসোর্সেস শীর্ষক এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদনের পর তা না খেয়ে নষ্ট করা হয় তা পচে যাওয়ার পর তা থেকে যে পরিমাণ তরল পর্দাথ তৈরি হতে পারে তা ভলগা নদীর পানিপ্রবাহের সমান।

বর্তমানে নতুন নতুন প্রযুক্তির আবিষ্কার মানুষের জীবনযাত্রাকে অনেক সহজ করে দিয়েছে। ইসলাম নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরোধী নয়। কিন্তু অল্প কিছু দিন পরপরই ঘরের নতুন আসবাবপত্র ও গাড়ী পাল্টে সর্বশেষ মডেলের আসবাবপত্র ও গাড়ী কেনা কোনো ভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ এক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় লোক দেখানোর মানসিকতাই প্রাধান্য পায়। মনে রাখতে হবে কোনো সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার না করাও অপচয়। ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাংলাভাষী একজন কবি এ সম্পর্কে চমৎকার বলেছেন, “যে জন দিবসে মনের হরষে জ্বালায় মোমের বাতি, আশু গৃহে তার দখিবে না আর নিশীথে প্রদীপ ভাতি ৷” অর্থাৎ আজ যে অপচয়কারী ও বিলাসী, কাল সে ভিখারী ও পরমুখাপেক্ষী। এটা ব্যক্তি জীবনের মতো রাষ্ট্রীয় জীবনেও সত্য।

অপচয় সম্পর্কে ইসলামের কঠোর মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদিসে। যাতে অজু করার সময়ও পানির অপচয় না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে তাগিদ দেওয়া হয়েছে ৷ একদা রাসুল (সা.) সাদ (রা.)-কে অজুর মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি ব্যয় করতে দেখে বলেন, ‘হে সাদ! অপচয় করছ কেন? সাদ (রা.) বলেন, ওজুতে কি অপচয় হয়? নবীজি (সা.) বলেন, ‘হ্যাঁ। প্রবহমান নদীতে বসেও যদি তুমি অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করো, তা অপচয়।’ (ইবনে মাজাহ : ৪২৫)

ইসলামে অপচয়-অপব্যয়ের পাশাপাশি কৃপণতারও বিরোধিতা করা হয়েছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে ইসলামে সবক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ি ত্যাগ করে ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যমপন্থা অবলম্বনের শিক্ষা দিয়েছে ইসলাম। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “তুমি একেবারে ব্যয়-কুষ্ঠ হয়োনা এবং একেবারে মুক্ত হস্তও হয়ো না। তাহলে তুমি তিরস্কৃতি, নিঃস্ব হয়ে বসে থাকবে।” (সুরা আল-ইসরা : ২৯)

অপব্যয় ও অপচয় না করে আত্মীয়দের হক আদায় ও দান-সদকার পাশাপাশি সন্তানদের জন্য কিছু সঞ্চয় করাও নবীজির শিক্ষা। সন্তানদের কারো মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়া নবীজি (সা.) কখনো পছন্দ করেননি। হজরত সাদ ইবনু আবি ওয়াক্কাস (রা.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, বিদায় হাজ্বে একটি কঠিন রোগে আমি আক্রান্ত হলে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার খোঁজ খবর নেয়ার জন্য আসতেন। একদা আমি তাঁর কাছে নিবেদন করলাম, আমার রোগ চরমে পৌঁছেছে আর আমি সম্পদশালী। একমাত্র কন্যা ছাড়া কেউ আমার উত্তরাধিকারী নেই। তবে আমি কি আমার সম্পদের দু’ তৃতীয়াংশ সদকাহ করতে পারি? তিনি বললেন, না। আমি আবার নিবেদন করলাম, তাহলে অর্ধেক। তিনি বললেন, না। অতঃপর রাসুল (সা.) বললেন, ‘এক তৃতীয়াংশ, আর এক তৃতীয়াংশও বিরাট পরিমাণ অথবা অধিক। তুমি তোমার উত্তরাধিকারীদের মানুষের করুণার মুখাপেক্ষী রেখে যাওয়ার চেয়ে তাদের স্বচ্ছল রেখে যাওয়া উত্তম। আর আল্লাহ্‌র সন্তুষ্টি লাভের জন্য তুমি যে কোন ব্যয় করো না কেন, তোমাকে তার বিনিময় প্রদান করা হবে। এমনকি যা তুমি তোমার স্ত্রীর মুখে তুলে দিবে (তারও প্রতিদান পাবে)।’ (বুখারি: ১২৯৫)

অপচয় মানবতার অভিশাপ৷ এতে ধনাঢ্যদের বিলাসিতা ছাড়া কোনো প্রাপ্তি নেই । অথচ প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ না খেয়ে মারা যায় ৷ মানুষের জীবন ধারণের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। এসব ছাড়া মানুষ জীবনধারণ করতে পারে না, তাই এগুলোকে মানুষের মৌলিক চাহিদা বলা হয়। ধনী-দরিদ্র,নারী-পুরুষ, সাদা-কালো, ছোট-বড় সকলেরই এসব প্রয়োজন। কিন্তু সামাজিক ও আর্থিক ভিন্নতার কারণে সকল মানুষ সমভাবে এসব প্রয়োজন মেটাতে পারে না। কেউ জৌলুস প্রদর্শনে কিংবা অপ্রয়োজনীয় বিনোদনে খরচ করছে লাখ লাখ টাকা। আর তার পাশের একজন গরিব মানুষ হয়তো টাকার অভাবে ওষুধও কিনতে পারছে না। কাজেই আমরা যদি অপচয় ও অপব্যয় পরিহার করে সেই অর্থ ঐসব মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে ব্যয় করি,তাহলে সমাজ যেমন সুন্দর ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে তেমনি আমরাও মানষিক প্রশান্তি পাব। এছাড়া পরকালে এর পুরস্কারতো রয়েছেই। তাই আসুন আজ   পর্যন্ত    যতধরণের    অপচয়-অপব্যয় করেছি তা থেকে তাওবা করে ভবিষ্যতে আর কখনও কোন ধরণের অপচয় না করার প্রতিজ্ঞা করি।

বিভাগীয় প্রধান আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, মদিনাতুল উলুম মাহমুদিয়া, বন্দর, নারায়ণগঞ্জ ৷