মুক্তির যত উদ্যোগ, কোন পথে মুক্তি (৩য় পর্ব)

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুন ০৮ ২০২৩, ২৩:৪৭

নোমান বিন আরমান:: আমেরিকা একদিন মুসলিম রাষ্ট্র হবে? এই স্বপ্ন কি আপনি কখনো দেখেছেন? এখন দেখবেন? না। এমন স্বপ্নের কথা কেউ বললে, তাকে নির্ঘাত পাগল ঠাওরাবেন। কিন্তু এমন স্বপ্নই দেখতেন ড. আফিয়া সিদ্দিকী। তাও এখন থেকে দুই দশক আগে। যখন দুনিয়ার কোনো কোণায় আমেরিকাকে ঠেক্কা দেয়, এমন কেউ ছিলো না।

শুধু স্বপ্ন দেখা না, এর জন্য আফিয়া নিরন্তর ও নিয়মতান্ত্রিক দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। আফিয়ার অপরাধ কী, যারা জানতে চান, তাদের জন্য আফিয়ার এই মনোবাসনাই যথেষ্ট। বলা চলে, এই স্বপ্নই আমেরিকার নিরা-পত্তার জন্য তাকে হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।

আফিয়া কেন এমন স্বপ্ন দেখতেন? আফিয়া বলতেন, আমেরিকা আমাকে জাগতিক জ্ঞানে ঋদ্ধ করেছে, আমি আমেরিকাকে কুরআনের আলোয় উদ্ভাসিত করতে চাই। এভাবেই তিনি আমেরিকার ‘ইহসানের’ প্রতিদান দিতে চেয়েছিলেন। কারণ, তিনি নিজেকে কুরআনে বর্ণিত ‘মুহসিনিন’ চরিত্রের অধিকারী বিবেচনা করতেন।

কুরআনকে আফিয়া এতোই ভালোবাসতেন, নিজের উদ্যোগেই তাফসির, তারজামাসহ কুরআন হিফজ করেছিলেন। কুরআন বিতরণকে দাওয়াতি কার্যক্রমের বুনিয়াদ বানিয়েছিলেন। আমেরিকায় তাঁর ভার্সিটিতে টেবিল নিয়ে বসে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কুরআন বিতরণ করতেন। মার্কিন কারা-গারে বন্দি মুসলিম কয়েদিদের খুঁজে খুঁজে কুরআন দিয়ে আসতেন। তিনি চাইতেন, কুরআনের কাছে মানুষ প্রত্যাবর্তন করুক।

তাঁর বড় বোন ফৌজিয়া বলেছেন, আফিয়াকে একবার বললেন, তুমি ভার্সিটিতে শুধু কুরআন বিতরণ না করে, ইসলামি বিভিন্ন সাহিত্যের বইও বিতরণ করো না কেনো। তাহলে তো মানুষ আরও বেশি আকৃষ্ট হবে। আফিয়া বললেন, ‘এটা নববি দাওয়াতের পদ্ধতি নয়। আল্লাহর কালামের চেয়ে চিত্তাকর্ষক আর কিছু হতে পারে না।’

কুরআনপ্রেমী সেই আফিয়াকে মার্কিন ক্যাঙ্গারো কোর্ট ৮৬ বছরের সাজা দিয়েছে। সাজার মেয়াদ শেষ হবে ১৬ অক্টোবর ২০৮৩ সালে! আরও ৬০ বছর তাকে বন্দিজীবন কাটাতে হবে। তখন তাঁর বয়েস হবে ১১১ বছর। বর্তমান বয়েস ৫১ বছর। ২০০৩ এ অপহরণের সময় তাঁর বয়েস ছিলো ৩১ বছর। ২০ বছর থেকে তিনি বন্দি আছেন।

আফিয়ার.বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ

আফিয়া সিদ্দিকীকে নিয়ে এফবি-আই অনবরত প্রোপাগাণ্ডা ছড়িয়েছে। সন্ত্রা-সবাদের অভিযোগ এনেছে। মোস-ওয়ান্ডেরে তালিকায় তাঁর নাম যুক্ত করেছে। এসবই হয়েছে, তাকে গু-ম করার পর। কিন্তু আদালতে এমন কোনো অভিযোগে তাঁর বিচার হয়নি! বিচার হয়েছে, তাঁকে গুম করার পাঁচ বছর পর আফগানিস্তানের গজনির পুলিশ স্টেশনে আটক অবস্থায় মার্কিন সেনাকে হ-ত্যাচেষ্টার অভিযোগে! যে অ-স্ত্র দিয়ে গু-লি করার অভিযোগ আনা হয়েছে সেটি কোড নিয়ন্ত্রিত। ব্যবহারকারী ছাড়া সেই কোড কারো জানার কথা না। কিন্তু এরপরও তাঁর বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ আনা হয়েছে এবং ‘বিচারে’ ৮৬ বছরের দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

ইরাকের কাছে মার-ণাস্ত্র থাকার স্বীকৃত মিথ্যে অভিযোগে দেশটি যারা জাহান্নাম বানিয়েছে, একই ধরণের অপ্রমাণিত অভিযোগে আফ-গানে পরাজিত যুদ্ধ করেছে, সেই তারাই অভিযোগের পাহাড় তৈরি করেছে ড. আফিয়ার বিরুদ্ধে। কিন্তু সেইসব অভিযোগ আদালতে তারা উত্থাপন করেনি।

মুক্তি কেবলই ইশতেহার

ড. আফিয়া সিদ্দিকীর মুক্তির আশ্বাস পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতাদের এক জনপ্রিয় ইশতেহার। প্রত্যেক বিরোধীদলই জনসমর্থনের আশায় নির্বাচনী বক্তব্য ও প্রতিশ্রুতিতে তাঁকে মুক্ত করার ব্যাপারে প্রত্যয় ব্যক্ত করে আসছে। মুশাররফ আমলে নওয়াজ শরিফ, নওয়াজ আমলে ইমরান খান একই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর, কেউই রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ নেননি। মসনদে বসে তারা আফিয়াকে বেমালুম ভুলে গিয়েছেন, ভুলে যেতে বলেছেন। ২০ বছরে একটিবারের জন্যও আফিয়ার মুক্তির বিষয়ে মার্কিন সরকারের সঙ্গে কোনো কথা বলেনি পাকিস্তান। উপরন্তু ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকে ইমরান খানকে যখন আফিয়ার ব্যাপারে প্রশ্ন করা হয়েছে, তিনি বিরক্ত ও বিব্রতবোধ করেছেন। প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন।

তবে রায় নির্ধারিত ‘বিচারকার্য’ চলাকালে পাকিস্তান সরকার আইনজীবীদের পেছনে ২ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। আফিয়ার পক্ষে নিয়োগ করা এই আইনজীবীরা মার্কিনপক্ষের স্বার্থেই কাজ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পুরো বিচারব্যবস্থার চরিত্র আফিয়া বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন। তাই সব অভিযোগ অস্বীকার করলেও, তাদের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়ার কোনো আশাই তিনি করেননি। তিনি জানতেন, তারা নির্ধারিত রায়ই দেবে। তাই সাজা ঘোষণারর পর যখন তাকে বলা হলো, তিনি এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন, তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, তিনি মার্কিন আদালতে আপিল করতে চান না। বলললেন, ‘আমি নিজেকে আল্লাহর আদালতে সমর্পণ করেছি, তিনি আমার আপিল শুনেন।’

পাশবিক সব নির্যাতনের পরও আল্লাহর প্রতি ড. আফিয়ার যে ভরসা ও বিশ্বাস, তা যে কাউকে চমকে দেবে। তাঁর ওপর বয়া চলা অমানবিকতা নিয়ে এক বিন্দু অভিযোগ বা অভিমান কারো প্রতি নেই। তার সাথে যে নির্মম ও নিষ্টুর আচরণ, নির্যা-তন করা হচ্ছে, হয়, তার শিকিভাগ যদি আমাদের কারো ওপর করা হতো, আমরা হয়তো (মা-আজাল্লাহ) ঈমান হারাতাম, ধর্ম পাল্টে ফেলতাম! কিন্তু বিশ্বাসের প্রতিভূ আফিয়ার ঈমানে এতটুকু চির ধরেনি। নির্যাতনে, নীপিড়নে তা আরও পোক্ত হয়েছে!

মার্কিন আদালত যখন ৮৬ বছরের সাজার অনায্য রায় ঘোষণা করেছে, তখন এতটুকু বিচলিত হননি ড. আফিয়া। কারও কাছে করুণা চাননি। উলটো তিনি ঘোষণা করেন, আমার ওপর করা অন্যায় বিচারের সঙ্গে যুক্ত সকলকে আমি ক্ষমা করে দিলাম। বিচারককেও ক্ষমা করার ঘোষণা দিয়ে বলেন, আমার প্রতি অবিচারের কারণে কেউ তাদের প্রতি রাগ পোষবেন না। সকলেই তাদের ক্ষমা করে দেবেন।’

আফিয়া মার্কিন কারা-গারে আছেন ৫ আগস্ট ২০০৮ সাল থেকে। দোহা চুক্তির পর তাঁর মুক্তিকে সময়ের ব্যাপার বলে ধারণা করা হচ্ছিলো। মুক্তির দিনক্ষণও প্রচারিত হচ্ছিলো। কিন্তু সব কিছু হঠাৎ থেমে যায়। তখন ক্ষমতায় ইমরান সরকার। বিরোধী রাজনীতিকরা অভিযোগ করেন, সরকারের অনাগ্রহেই তখন আফিয়ার মুক্তি আটকে যায়।

পাকিস্তানের রাজনীতিকরা মাঠে আফিয়ার মুক্তির কথা বললেও, মসনদে বসার পরই কেনো মুখে কুলুপ আঁটেন তার কোনো উত্তর মিলে না। এই রহস্যের জট কেউ খুলেন না। অভিযোগ রয়েছে, আইএসআই মার্কিনদের হাতে আফিয়াকে তুলে দিয়েছিলো। সেনাগোয়েন্দা সংস্থার কাপড় খুলে হাওয়ার ভয়েই কি ক্ষমতায় বসে নেতারা চুপসে যান?

প্রথম পর্বেই আমরা উল্লেখ করেছি, আফিয়ার মুক্তির জন্য নতুনভাবে কাজ করছেন ড. ফৌজিয়া সিদ্দিকী, পাকিস্তানের সংসদ সদস্য ড. মুশতাক আহমদ খান ও মার্কিন মানবাধিকার কর্মী ক্লাইভ স্ট্যাফোর্ড স্মিথ। আফিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের পর যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত, তুরস্কের রাষ্ট্রদূত, জাতিসংঘে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধিসহ অনেকের সঙ্গে তারা মতবিনিময় করেছেন। সহযোগিতা চাচ্ছেন। জনমত তৈরির জন্য কাজ করছেন।

দোয়া দিবস

আগামীকাল (৯ জুন) শুক্রবারকে #ইয়াওমুল_দোয়া আফিয়া মুক্তির দোয়া দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন আফিয়া মুভমেন্টের নেত্রী ড. ফৌজিয়া সিদ্দিকী। তিনি সকল ইমাম-খতিবদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, মজলুম ড. আফিয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে মুনাজাত করতে। আল্লাহ ছাড়া কোনো সাহায্যকারী নেই।

তহবিল গঠন

আফিয়া মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিকভাবে তহবিল গঠন হচ্ছে। ইতোমধ্যে ২২ হাজার ১৩৪ ডলার সংগ্রহ হয়েছে। এই লিংকের মাধ্যমে আফিয়ার জন্য তহবিল গঠন করা হচ্ছে।

কীভাবে মুক্তি

ড. মুশতাক আহমদ জোর দিয়েই বলছেন, পাকিস্তান সরকার উদ্যোগ নিলে মাস বা বছর নয়, এক সপ্তাহের মধ্যেই দেশে ফিরে আসতে পারবেন ড. আফিয়া সিদ্দিকী। এখন শুধু সরকারকে রাজি করানোই বাকি। সেটার জন্য নিয়মতান্ত্রিক সব কর্মসূচি তারা ঘোষণা করবেন। দেশটির নাগরিকদেও প্রত্যেকের অবস্থান থেকে আওয়াজ তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। এখন দেখার পালা, পাকিস্তান সরকার শেষ পর্যন্ত কী করে।

বিশ্বের মানুষ চায়, মুক্ত হোন আফিয়া। অবসান হোক জুলুমের দাস্তান।

 

আরও পড়ুন—