মাহফিল নিয়ে কয়েক লাইন

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জানুয়ারি ২২ ২০২০, ১৯:২১

এক.

কিছু ব্যতিক্রম বাদে বিজ্ঞ আলেমরা মাহফিলে বক্তৃতা করেন না। লাগামহীন বক্তাদের বিকল্পরূপে অনেকেই প্রস্তাব করছেন, বিজ্ঞ আলেমদেরকে মাহফিলের বক্তারূপে নিয়ে আসার জন্য।

আমার মনে হচ্ছে, এতে সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ মাঠের বাস্তবতা এক্ষেত্রে বড় বাধা। মেঠো বক্তব্যের জন্যই মাঠ। বিজ্ঞদেরকে মাঠে নামিয়ে দিলে তারাও মাঠের প্রয়োজনে মেঠো হয়ে যাবেন। বিজ্ঞ হিসেবে জানতাম, এমন অনেকেই প্রথম প্রথম মোটামুটি ঠিকঠাক বক্তৃতা করলেও ধীরে ধীরে নিজেকে মাঠের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন; মাঠকে নিজের মতো বানিয়ে নিতে পারেন নি।

ওয়ায এক ধরনের আর্ট। এক নাগাড়ে দুই-আড়াই ঘণ্টা পর্যন্ত শ্রোতা ধরে রাখা খুব সোজা ব্যাপার নয়। পারফর্মিং আর্ট দিয়েই বক্তারা শ্রোতা ধরে রাখার কসরত করেন। এই আর্ট সবার আয়ত্বে থাকার কথা নয়।

ওয়ায মাহফিলকে এখন শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান বললে ভুল হবে। এটা এক ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সংস্কৃতিটা যেহেতু সর্বজনীন নয়, নির্দিষ্ট ধর্ম-সম্প্রদায় কেন্দ্রিক— সুতরাং এই অনুষ্ঠানের কোনো অনুষঙ্গে ধর্মীয় রীতিনীতি উপেক্ষিত হচ্ছে কি না, খেয়াল রাখা আবশ্যক। তবে আমরা অনেকসময়ই গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করি, বক্তারা ধর্মীয় বৈধতার সীমার মধ্যে থাকেন না। মাহফিল যখন প্রতিপক্ষকে একহাত নেয়ার উপলক্ষে পরিণত হয়, বক্তারা যখন কৌতুক-অভিনেতার মতো ভাঁড়ামি করেন— তখন একে আর নিরীহ বলা চলে না।

যেহেতু ওয়ায মাহফিল একটি ধর্মীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সুতরাং এতে ধর্ম ও সংস্কৃতি দুই-ই রক্ষিত হতে হবে। সংস্কৃতি হওয়ার কারণে হালকা হাস্যরস থাকতে পারে; ধর্মীয় সংস্কৃতি হওয়ার কারণে হাস্যরস ধর্মের সীমার মধ্যে থাকতে হবে। মিথ্যাবচন, ভাঁড়ামি ও জাল হাদীসের বর্ণনা কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

দুই.
ওয়ায মাহফিল নিয়ে সেক্যুলার সম্প্রদায়ের দ্বিচারিতা চোখে পড়ার মতো। একদিকে তারা রাজনীতিতে ধর্মীয় অনুষঙ্গের ব্যবহার দেখতে পছন্দ করে না, অন্যদিকে তারা ঠিকই মাহফিলে মাহফিল গিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে আসে। অর্থাৎ তারা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার দেখতে অপছন্দ করলেও, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রাজনৈতিক বক্তব্য দিতে তাদের মন্দ লাগছে না। তাদের এই খায়েশের কারণে বিগত কয়েক বছর কিছু মাহফিলে হট্টগোলের ঘটনাও ঘটেছে।

এক কথায় যদি বলি, সেক্যুলারিজমের বঙ্গীয় অর্থ হলো রাজনীতিতে ধর্মের ভূমিকা থাকবে না; কিন্তু ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রাজনীতি চলবে।

এজন্য অবশ্য একতরফা সেক্যুলার রাজনীতিকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এজন্য মাহফিলের আয়োজক ধর্মীয় নেতারাও অনেকাংশে দায়ী। ধর্মীয় নেতারাই রাজনৈতিক নেতাদেরকে ডেকে নিয়ে আসেন। ক্ষুদ্র ও সাময়িক স্বার্থের জন্য বড় ও স্থায়ী সমস্যা দাওয়াত করে আনেন।

রাজনৈতিক, সামাজিক, আর্থিক— ধর্মীয় নেতাদের হাতে কোনো ক্ষেত্রের কর্তৃত্ব নেই। একমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই তাদের সামান্য কথা বলার সুযোগ আছে। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ধর্মীয় নেতারা যথেচ্ছ ও অপরিকল্পিত ব্যবহারের মাধ্যমে নিজেদের কর্তৃত্বাধীন একমাত্র প্লাটফর্মটার আবেদন নষ্ট করছেন; এই প্লাটফর্মটাকে স্বেচ্ছায় রাজনৈতিক নেতাদের হাতে তুলে দিয়ে নিজেদের বিপদ নিজেরা ডেকে আনছেন।