বেফাক সমস্যা সমাধানের গঠনতান্ত্রিক উপায়- রশীদ জামীল

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ২২ ২০২০, ২২:৩৬

অস্তিত্বের প্রশ্নে বিপর্যস্থ বাংলাদেশের সর্ব বৃহৎ কওমি মাদসাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাককে দৃশ্যমান ধ্বংসের খাদের কিনারা থেকে বের করে নিয়ে আসতে চাইলে উপায় এখন একটাই, গঠনতন্ত্রে ফিরে যাওয়া। গঠনতান্ত্রিক উপায়ে সমাধানের উপায় খোঁজা। প্রশ্নহল, যাদের দ্বারা এই কাজটি সম্ভব, তাঁরা উদ্যোগটি নিতে রাজি হবেন কিনা! যদি হন, তাহলে বেঁচে যাবে ঐতিহ্যের এই স্মারকটি। আর নাহলে ডেকে আনা দুর্ভাগ্য মেনে নিয়ে আমাদের উচিত হবে বিস্মৃত ইতিহাসের অংশ হওয়ার জন্য তৈরি হতে শুরু করা।

বেফাকের অনিয়ম নিয়ে আমরা কথা বলে আসছিলাম এক যুগ আগে থেকে। তখন আমাদের দিকে চোখ লাল করে না তাকিয়ে সতর্ক হলে এবং ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের অনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারলে আজ এই দিন দেখতে হত না।

বেফাকের গুটি কতেক নীতিহীন লোকের কারণে পুরো বেফাক আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। গোঠা কওমি অঙ্গন আজ সাধারণ মানুষের বিনোদনের বস্তু। উলামায়ে কেরামের অবস্থান মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। আমাদের মুরব্বিরা একবেলা খেয়ে একবেলা উপোস করে গড়ে তুলেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানগুলো; যেগুলোর মাটি নরম হয়েছিল তাদের শেষ রাতের চোখের পানিতে, আলখেল্লাধারী সফেদ শ্মশ্রুমণ্ডিত কিছু লোকের কারণে সেগুলো আজ হুমকির মুখে!

আমরা কারা?
আমরা কেন কথা বলি?
আমাদেরকে এই অধিকার কে দিল?

আমরা যারা কওমি প্রজন্ম, আমরা যারা আমাদের জীবনের ষোলটি বসন্ত কাটিয়েছি কওমি আঙিনায়, কথাবলার অধিকার আমাদের থাকতেই হবে। ছোট-বড়-মাঝারি- কে কী পদক্ষেপ নিলেন অথবা নীরব থাকলেন- সেদিকে তাকিয়ে থেকে প্রতিষ্ঠানটির ধ্বংস আমরা দেখতে পারব না। এখন, কেউ যদি আমাদেরকে কথাবলার থেকে বিরত রাখতে চায়, তাহলে ফিরিয়ে দিক আমাদের ষোল বছর। তারপর করুক যার যা খুশি, আমরা আর নাক গলাব না।

সরি বাংলাদেশের মুরব্বি উলামায়ে কেরাম। কিছু মনে করবেন না। আপনাদের নীরবতা আমাদের ব্যথিত করেছে। আপনাদের উদাসীনতা আমাদের আশাহত করেছে। আমরা আশা করেছিলাম স্বপ্নের পাঁজর ভাঙার শব্দ আপনারা শুনতে পাবেন। ভেবেছিলাম মুরাকাবা থেকে বেরিয়ে এসে বাস্তবতার শব্দদুষণ আপনাদের কানে আগে যাবে। আপনারা আমাদের আশাহত করলেন।

#ডবল_স্ট্যান্ডার্ড_অথবা_স্বেচ্চাচার
যেকোনো সংগঠন ততক্ষণ লাইনে থাকে যতক্ষণ সংগঠনটি তার গঠনতন্ত্র ফলো করে চলে। গঠনতন্ত্রের ভায়োলেশন মানেই সমস্যার শুরু। এই যে মৃত্যুশয্যায় কাতরাচ্ছে বেফাক, এর পেছনে মূল কারণই হচ্ছে গঠনতন্ত্র ভায়োলেট করা। এই মুহূর্তে বেফাক চলছে সভাপতি এবং মহাসচিব নামক দু’জন ব্যক্তির আঙুলের ইশারায়- এভাবে বললে কি ভুল হবে? অথচ, গঠনতন্ত্র সামনে রাখলে দুজনেরই দায়িত্বে থাকারই সুযোগ থাকার কথা ছিল না। লেট’স অ্যক্সপ্লেইন।

বেফাকের মহাসচিব অনৈতিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত। তিনি প্রতিষ্ঠানটির আর্থিক ও নৈতিক আমনতদারি রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বেফাকের সভাপতি এমন একজন মানুষ, যিনি তাঁর ডানে বামে কী হচ্ছে- সেটাই বুঝতে পারেন না, দেশ ও জাতির অবস্থা তো দূর কি বাত। এবার আসুন, বেফাকের গঠনতন্ত্র খুলে দেখি।

গঠনতন্ত্রে নির্বাহী পরিষদের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা অধ্যায়ের ‘গ’ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘আমানতদার, দেশ ও জাতির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ব্যক্তিরাই আমেলার সদস্য হওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন’। সভাপতির অন্যান্য যোগ্যতার মধ্যে একটি যোগ্যতা বলা হয়েছে, ‘সভাপতির দায়িত্ব পালনের জন্য অফিসে উপস্থিতি প্রয়োজন’।

তাহলে প্রথম অংশের কারণে মহাসচিব এবং দ্বিতীয় অংশের কারণে সভাপতি কেন অযোগ্য বিবেচিত হবেন না- এই প্রশ্ন যদি উঠানো হয়, সেটা কি অযৌক্তিক হবে? সভাপতি/মহাসচিব তো পরে, নির্বাহী পরিষদের সদস্য হওয়াই সুযোগই তো তাদের আর থাকে না।

#ক্ষমতার_ভারসাম্যহীনতা
চলমান অচলবস্থায় দুর্নীতি কিংবা অনৈতিকতার অভিযোগে অভিযুক্ত তিনজন কর্মকর্তাকে বহিস্কার করা হলো। যদিও তাদের বহিস্কারাদেশের বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। বহিস্কারের আগে তাদেরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া উচিত ছিল। আবার একই অভিযোগে অভিযুক্ত মহাসচিব স্বপদে বহাল… আপাতত আমরা সেদিকে যাচ্ছি না।

গঠনতন্ত্রে বলা আছে, ‘কোন সদস্য বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেফাকের আদর্শ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হলে কিংবা দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য করণ উল্লেখ করে লিখিত অনাস্থা প্রকাশ করলে, তা মজলিসে শুরায় পেশ করতে হবে। মজলিসে শুরা উক্ত অভিযোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত সদস্যের সদস্য পদ বাতিল করে দিতে পারবেন।

#পয়েন্ট_টু_বি_নোটেড
-‘কোন সদস্য বা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বেফাকের আদর্শ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ উত্থাপিত হলে… মজলিসে শুরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার পর অভিযোগ সত্য প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত সদস্যের সদস্য পদ বাতিল করে দিতে পারবেন।

তারমানে, যেকোনো কর্মকর্তা, কর্মচারিকে বরখাস্ত করার অধিকার মজলিসে আমেলার থাকলেও চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য মজলিসে শূরার কাছে দায়বদ্ধ। একক ক্ষমতাবলে কাউকে বহিস্কার বা দায়মুক্তি দেওয়ার ক্ষমতা সভাপতিকে দেওয়া হয়নি। বর্তমান সভাপতিকে দিয়ে সংবিধান বহির্ভুত ফরমানসমূহ জারি করানোর আগে সংশ্লিষ্টদের উচিত ছিল সংবিধান সংশোধন করে সভাপতিকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া!

#শূরার_ব্যর্থতা
বেফাকের প্রধান নীতি নির্ধারনী ফোরাম হচ্ছে সাধারণ পরিষদ বা মজলিসে শূরা। গঠনতন্ত্রে মজলিসে শূরার দায়িত্বের ৭ ও ৮ উপধারা হলো এমন,

৭. কোন সদস্যের ব্যাপারে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ উত্থাপিত হলে কিংবা অনাস্থা প্রস্তাব আনা হলে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা পূর্বক গঠনতন্ত্র মোতাবেক কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ।
৮. আমেলা কর্তৃক নিয়োগ বা বরখাস্তকৃত কোন অফিসিয়াল কর্মকতার নিয়োগ ও বরখাস্তের বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দান।

চলমান সংকটে মজলিসে শূরা তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের এই ব্যর্থতার দুই কারণ হয়ে থাকতে পারে।
১, দায়িত্ব সম্বন্ধে তাদের অজ্ঞতা।
২, সভাপতির প্রতি অতিভক্তি।

কারণ যেটাই হোক, অথবা উভয়টিই, ফলাফল, বেফাকের বর্তমান হালত। সুতরাং আমরা মনেকরি বেফাক যদি সহসাই এই সংকট কাটিয়ে উঠতে না পারে, অথবা এমন কোনো ভাগ্য বরণ করে- যেটা আমরা ভাবতেও চাই না, তাহলে বর্তমান শূরা সদস্যদের এভরি সিঙ্গেল পার্সনকে কোনো একদিন ইতিহাসের কাঁঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

#উত্তরণের_উপায়
বর্তমান সিচুয়েশনে সভাপতি/মহাসচিবের উচিত ছিল ইমার্জেন্সি শূরা মিটিং কল করা। সভাপতি বাস্তব জগতে নাই। মহাসচিব আছেন ঘোরের জগতে। যে কারণে সভা আহবান করা হচ্ছে না। অবধারিরভাবেই সংকট আরো ঘণিভূত হচ্ছে। এই অবস্থায় সামনে এখন একটাই পথ খোলা, গঠনতন্ত্রের প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সহ সভাপতিগণ কর্তৃক জরুরি সভা আহবান করা এবং ডিসিশান নেওয়া। বেফাক গঠনতন্ত্রের শেষ অধ্যায়ে বলা আছে-

#তলবী_সভা
সদর/নাযেম যথানিয়মে সভা আহবান না করলে, নায়েবে সদরদের সংখ্যাগরিষ্ট সংখ্যক সদস্য সভা আহবান করার প্রয়োজন মনে করলে তারা লিখিতভাবে সদর/নাযেমে উমীমীকে সভা আহবানের অনুরোধ করবেন। এই লিখিত অনুরোধের পর অন্যুন ১৫ দিনের মধ্যে তারা সভা আহবান না করলে সহ-সভাপতিগণ যৌথ স্বাক্ষরে সভা আহবান করতে পারবেন’।

বেফাকের বর্তমান জীবিত সহ সভাপতির সংখ্যা ৩৫। এরমধ্যে ৪ জন মারা গেছেন। নতুন ২জনকে যুক্ত করা হয়েছে। এখন আছেন ৩৩ জন। সুতরাং ১৭ জন সহ সভাপতি একমত হয়ে সভাপতি/মহাসচিবকে ১৫ দিন সময় দিয়ে তারপর তাঁরা নিজেরাই সভা আহবান করতে পারেন। সেই সভার সিদ্ধান্তই সাংবিধানিকভাবে বেফাকের বৈধ এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিশেবে বিবেচিত হবে।

#কারা_আসবেন_নেতৃত্বে?
আমরা অনলাইনে মাঝেমধ্যেই আমাদের পছন্দের ব্যক্তিবর্গকে বেফাক নেতৃত্বে দেখতে চাওয়ার খাহেশ জাহির করি। এমন দাবিগুলোতে যুক্তির চেয়ে আবেগই প্রাধান্য পায়। আমরা ভুলে যাই ভালো আলেম এক জিনিস, ভালো বক্তা আরেক জিনিস, ভালো সংগঠক এবং জাতীয় একটি শিক্ষাবোর্ডের নেতৃত্ব অন্য জিনিস। আর আবেগ দিয়ে নেতৃত্ব ঠিক করলে অবস্থা কী হয়, এটা চোখের সামনে দেখেও যদি বুঝতে পারি না, তাহলে কীভাবে হবে?

#কে_হবেন_সভাপতি?
গঠনতন্ত্রের বলা হয়েছে, ‘কোন রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তা বা সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত বা বহু সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত বা দায়িত্বশীল, এমন ধরনের ব্যক্তি অত্র প্রতিষ্ঠানের সদর হওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না’।

#কে_হবেন_মহাসচিব?
গঠনতন্ত্র বলছে, ‘ কোন রাজনৈতিক দলের কর্মকর্তা বা সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত বা বহু সংগঠনের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে জড়িত এমন ধরনের ব্যক্তি অত্র প্রতিষ্ঠানের নাযেমে উমূমী (মহাসচিব) হওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না।

এখন, হয় জেনেবুঝে সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজনৈতিক কোনো নেতাদের সভাপতি/মহাসচিব করতে হবে, আর নাহয় সংবিধান সংশোধন করে নেতাদের জন্য রাস্তা উন্মুক্ত করে দিতে হবে।

সম্মানিত সহ সভাপতিমণ্ডলি!
বেফাক রক্ষায় উদ্যোগটি কি নেবেন?
সাংবিধানিক অধিকারে তলবী সভা ডাকবেন?