বিশ্ব বন্ধু দিবস : বন্ধু নির্বাচনে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
একুশে জার্নাল
আগস্ট ০৪ ২০১৯, ১৮:৫৯
– সাদ সাইফুল্লাহ মাদানী
রবিবার (৪ আগস্ট) বিশ্ব বন্ধু দিবস। প্রতি বছর আগস্ট মাসের প্রথম রবিবার বিশ্বজুড়ে বন্ধু দিবস উদযাপিত হয়। ১৯৩৫ সাল থেকে বন্ধু দিবস পালনের প্রথা শুরু হয়। জানা যায় ১৯৩৫ সালে আমেরিকার সরকার এক ব্যক্তিকে হত্যা করে। দিনটি ছিল আগস্টের প্রথম শনিবার। তার প্রতিবাদে পরের দিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করেন। এরপরই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষেই আমেরিকান কংগ্রেসে ১৯৩৫ সালে আগস্টের প্রথম রবিবারকে বন্ধুত্ব দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকে দেশে-বিদেশে এদিবসটি পালিত হয়ে আসছে।
পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের যেমন খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থান প্রয়োজন, তেমনি সমাজে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির। কেননা মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে চলা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আর মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিই এমন যে কোনো মানুষ একাকী থাকতে চায় না। সমাজের অন্য সবার সঙ্গে প্রীতির মেলবন্ধনে জড়িয়ে থাকতে আগ্রহী। এই পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মায়াজাল মানুষের মধ্যে বন্ধুত্বের আবহ সৃষ্টি করে। একেক জনের পেশা একেক রকম। তাই সমাজে একজনকে আরেকজনের প্রয়োজন পড়ে। এটা আল্লাহর এক অশেষ নিয়ামত। কেননা সমাজবদ্ধতার প্রশ্নে মানুষ একে অপরের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। সঠিকভাবে যথার্থ বন্ধু নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে মানুষ তার সামাজিক এবং ব্যক্তিগত জীবনকে সুষ্ঠু ও নিরাপদ করে তোলে। এই বন্ধুত্বের ব্যাপারে ইসলামের রয়েছে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি।
বন্ধু নির্বাচন: মানবজীবনে আদর্শ বন্ধু নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই বন্ধু নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন অতীব জরুরি। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বন্ধুত্ব গ্রহণ এবং এর মর্যাদা সম্পর্কে বহু বাণী উল্লিখিত হয়েছে। আসলে যে কাউকে বন্ধু বলা যায় না, বন্ধু বানানো যায় না। সত্যবাদী, নামাজি, দ্বীনদার ও পরোপকারী ব্যক্তিকে বন্ধু হিসেবে নির্বাচন করা উচিত।
এ জন্য কোরআনে বন্ধু নির্বাচনের দিকনির্দেশনা প্রদান করে ঘোষিত হয়েছে-‘আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন, যারা সকাল-সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহ্বান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে অবচেতন করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্যকলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার আনুগত্য করবেন না। ‘ (সুরা কাহাফ : ২৮)
বন্ধু নির্বাচনে কেমন ব্যক্তি অগ্রাধিকার পাবে-এ ব্যাপারে উৎসাহিত করতে গিয়ে পবিত্র কোরআনে আরো সুস্পষ্ট ঘোষণা এসেছে। ইরশাদ হচ্ছে-‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সত্যবাদীদের সঙ্গী হও। ‘ (সুরা তাওবা : ১১৯)
অন্যদিকে বন্ধু নির্বাচনে জোরালো নির্দেশনা প্রদান করে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন-‘মুমিন ব্যতীত অন্য কাউকে সঙ্গী নির্বাচন করবে না। ‘ (তিরমিজি)
কোরআনের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে-‘মুমিনগণ যেন অন্য মুমিনকে ছেড়ে কোনো কাফিরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। আর যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক থাকবে না। ‘ (সুরা আলে ইমরান : ২৮)
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাজালি রহ. বলেছেন, ‘যার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে তার মধ্যে পাঁচটি গুণ থাকা চাই। তা হলো-‘বুদ্ধিমত্তা ও সৎ স্বভাবের অধিকারী হওয়া এবং পাপাচারী, বেদআতি ও দুনিয়াসক্ত না হওয়া। ‘ হজরত ইমাম জাফর আস-সাদিক রহ. মুসলিম মিল্লাতকে বন্ধু নির্বাচনে সতর্ক করে বলেছেন, ‘পাঁচ ব্যক্তির সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সমীচীন নয়। তা হলো-মিথ্যাবাদী, নির্বোধ, ভীরু, পাপাচারী ও কৃপণ ব্যক্তি। ‘ বন্ধু মনোনয়নে হজরত আলী রা.-এর উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘নির্বোধের বন্ধুত্ব থেকে দূরে থাকো। কারণ সে উপকার করতে চাইলেও তার দ্বারা তোমার ক্ষতি হয়ে যাবে। ‘ (দিওয়ানে আলী)
এ প্রসঙ্গে দার্শনিক সক্রেটিস বলেছেন-‘বন্ধুত্ব করার সময় খুবই ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে; কিন্তু যখন বন্ধুত্ব হয়ে যায় তখন তা দৃঢ়তর ও স্থায়ী করো। ‘
হঠাৎ করে কারো সাথে পরিচিত হবার মধ্য দিয়ে অর্থাৎ কোনোরকম বিচার বিশ্লেষণ ছাড়া বন্ধুত্ব গড়ে উঠলে অনেক সময় দুঃখজনক পরিণতি ঘটতে পারে। অনেক ইন্টারনেট বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি খুব সহজেই অনুমান করা যায়। যাই হোক, এই যে আমরা বিচার বিবেচনার কথা বললাম, ইসলাম এ সম্পর্কে কী বলে অর্থাৎ একজন ভালো বন্ধুর গুণাবলী কী ইসলামের দৃষ্টিতে সেদিকে একবার নজর দেওয়া যাক।
জগদ্বিখ্যাত মরমী কবি আল্লামা জালালুদ্দিন রুমি রহ. এ সম্পর্কে লিখেছেন
অসৎ বন্ধু থেকে দূরে থাকো যতোটা পারো!
সে যে বিষধর সাপের চেয়েও ভয়ংকর আরো,
দুষ্ট সাপ শুধু আঘাত করে তোমার প্রাণের পর,
অসৎ বন্ধু ছোবল মারে প্রাণের সাথে ঈমানের পর।
ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বন্ধুর বৈশিষ্ট্য : ইসলামের দৃষ্টিতে ভালো বন্ধুর অন্যতম একটা বৈশিষ্ট্য হলো বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হওয়া। এই বিবেকবান বন্ধু সদুপদেষ্টা হয় এবং তার ওপর সব সময় আস্থা রাখা যায় কেননা এ ধরনের বন্ধু ভুলত্রুটি থেকে ফিরিয়ে রাখে। আলী (আ.) বলেছেন, বিবেকবান বন্ধুর সাহচর্য অন্তরাত্মাকে প্রাণচাঞ্চল্য দান করে। পক্ষান্তরে অজ্ঞ এবং মূর্খ বন্ধু কারও কোনো উপকার তো করেই না বরং তার কথাবার্তা আর আচার-আচরণ অন্যদের বিরক্তি আর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বন্ধুত্বের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শিষ্টাচার হচ্ছে অসুখ-বিসুখ, বিপদ-আপদেও বন্ধুত্ব অটুট রাখা। লোকমান হাকিম বলেছেন, ‘প্রয়োজনের মুহূর্ত ছাড়া বন্ধুকে চেনা যায় না।’ একজন ভালো বন্ধু পাওয়ার প্রথম ও প্রধান শর্ত হলো বন্ধুত্বের সম্পর্কের মাঝে কোনো ধরনের স্বার্থ কিংবা প্রাপ্তির চিন্তা মাথায় না রাখা।
আমাদের উচিত হবে জীবনের এই উজ্জ্বল সময়ে যাকে তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করা। ছাত্রছাত্রীদের জন্য ছাত্র জীবনে বন্ধু হওয়া উচিত, সৎ, বুদ্ধিমান, মেধাবী, ধৈর্যশীল, চরিত্রবান, ধার্মিক, সুন্দর মনের অধিকারী, পরোপকারী ও নিরলস। একজন ভালো বন্ধুই পারে পাল্টে দিতে আপনার জীবন, পরিবারের জীবন এমনকি সমগ্র জাতির জীবন। এই হোক বন