বিএনপি ও বাংলাদেশের আগামীদিনের বিরোধীদল

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ১০ ২০১৯, ১১:৫৩

আবুল কাসেম আদিল: অপ্রাতিষ্ঠানিকভাবে যখন স্কুলের ছাত্ররা, বেকার তরুণরা, গার্মেন্টসের শ্রমিক ও পেশাজীবীরা বিরোধীদলের ভূমিকা পালন করছে — তখন প্রাতিষ্ঠানিক বিরোধীদলের কি দরকার আছে? প্রাতিষ্ঠানিক ও সংগঠিত বিরোধীদল যখন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলতে না পারে, তখন তো তারচেয়ে অপ্রাতিষ্ঠানিক ও অসংগঠিত বিরোধীদলই ভালো। আলামত বলছে, আগামীতে দেশে কার্যকর পরিবর্তন এলে অরাজনৈতিক অসংগঠিতদের হাত ধরেই আসবে। যে কোনো একটা ইস্যুতে হঠাৎ আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে পড়বে। তা হবে সরকার ও বিরোধীদল দুই দলের জন্যই ক্ষতিকর। সরকারের জন্য ক্ষতিকর এজন্য হবে যে, যেহেতু আন্দোলন সরকারের বিরুদ্ধেই হবে; বিরোধীদলের জন্য ক্ষতিকর এজন্য হবে যে, বিরোধীদলের ভূমিকা ছাড়া সফল আন্দোলন সংগঠিত করতে পারা বিরোধীদলের প্রয়োজনহীনতা প্রস্ফুটিত করবে। অবশ্য সেই মুহূর্তে বিরোধীদল চাইবে নিজের ঘরে ফসল তুলতে, সরকার ব্যস্ত থাকবে পায়ের নিচের মাটি সামলানোর কাজে। তবে আন্দোলনকারীরা সচেতন থাকলে সুযোগসন্ধানীদেরকে ফসল তোলা থেকে বঞ্চিত রাখবে।

যে কোনো যৌক্তিক আন্দোলন যে কেউ যে কোনো স্থান থেকে শুরু করতে পারে। তবে আন্দোলনকে পরিণতি দিতে হলে সংগঠিত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব জরুরি। বিরোধীদলগুলো যদি এই বিষয়টা বুঝতে ব্যর্থ হয়, তাহলে এটা জনগণের ক্ষতির কারণ তো বটেই, স্বয়ং বিরোধীদলের অস্তিত্বের জন্যও হুমকি স্বরূপ। বিরোধীদলের কাজ হলো সরকারের জনবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে সরব থাকা, জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জনতার পাশে থাকা। বিরোধীদল যদি তা করতে ব্যর্থ হয়, জনদাবি বুঝতে যদি অসমর্থ হয়, সেই বিরোধীদলের বিলুপ্তি অনিবার্য নয় শুধু, কাম্যও।

কোনো দল যদি মনে করে তার জন্মই হয়েছে ক্ষমতায় আরোহণের জন্য, এজন্য শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি করা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার অন্তরায় বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলা দরকার বোধ করে, তাহলে সেই দল চরম ভুলে নিপতিত রয়েছে। শুধু ক্ষমতার রাজনীতি করতে হলেও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কথা বলা ও জনতার পাশে থাকা জরুরি। কেননা ক্ষমতায় যেতে হলে জনতাকে লাগবে। জনতাকে পাশে পেতে হলে জনতার প্রয়োজনে সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে জনতার পাশে থাকতে হবে।

গত পাঁচ বছর ধরে দেশে কার্যকর ও সত্যিকারের সংসদীয় বিরোধীদল নেই। মাঠের বিরোধীদলকেও মাঠে দেখা যায় নি। এই সময়ের মধ্যে দেশে অনেকগুলো জন-আন্দোলন হলো। কোটাবিরোধী আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলন মানুষকে তুমুলভাবে আলোড়িত করেছে। অথচ দুঃখজনকভাবে এসব ইস্যুসহ কোনো জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে মাঠের বিরোধীদলকে জনতার পাশে পাওয়া যায় নি। এর আগের পাঁচ বছরে সুন্দরবন-বিধ্বংসী রামপালবিরোধী আন্দোলন ও শিক্ষাখাতের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন সাড়া জাগিয়েছিল। এই সময়গুলোতেও বিরোধীদলকে সরব দেখা যায় নি। ৫ জানুয়ারি পূর্ববর্তী সময়ে যদিও বিরোধীদলকে আন্দোলন করতে দেখা গেছে, দুঃখজনকভাবে তা ছিল শুধু দলীয় স্বার্থকেন্দ্রিক। আমরা বিরোধীদল বিএনপিকে কার্যকর আন্দোলন করতে দেখেছি দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াকে বাড়িছাড়া করার সময় আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর। বাহ্যত প্রথমটি ব্যক্তিস্বার্থের আন্দোলন, দ্বিতীয়টি তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রহিতকরণ সরাসরি বিএনপির ক্ষমতায় আরোহণের অন্তরায়।

অথচ এই সময়গুলোতে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে, বিচারব্যবস্থা পঙ্গু হয়েছে, বেকার-সমস্যা বেড়েছে, জননিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে, নতজানু পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়িত হয়েছে, প্রতিবেশী দেশকে জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে করিডোর দেওয়া হয়েছে — কিন্তু আমরা বিরোধীদল বিএনপির টিকিটিরও দেখা পাই নি। দাবি করার সুযোগ আছে যে, বিভিন্ন ইস্যুতে মেঠো আন্দোলন না করলেও বিএনপি তো বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে সরব থেকেছে। বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে অংশগ্রহণ যে কেউই করতে পারে। তা তো মানুষ করছেও। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ সরকারের গণবিরোধী কাজের প্রতিবাদ করছে। একটি প্রতিষ্ঠিত ও সংগঠিত রাজনৈতিক দল যদি এটুকু করেই তৃপ্ত হতে চায় ও জনতার সন্তুষ্টি কামনা করে, তাহলে তো চলে না। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের কাছে মানুষের দাবি আরো বেশি। দুঃখজনকভাবে মানুষের দাবি পূরণ করতে বারবার দলটি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। আনন্দের কথা হলো, মানুষ এখন আর কোনো দল ও সংগঠনের আশায় বসে নেই। প্রায় সব পেশার মানুষই নিজের অধিকার আদায়ে কথা বলতে শুরু করেছে, কথা বলতে শিখে ফেলেছে। ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমরা তার আলামত দেখতে পেয়েছি। এখনকার গার্মেন্টসের শ্রমিকদের আন্দোলন মানুষের সেই চেষ্টারই সামান্য প্রকাশ মাত্র।

৩০ ডিসেম্বর তথাকথিত একটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। বিরোধীদল বিএনপি সরকারের দমন-পীড়ন, নির্বাচন কমিশনের অনিরপেক্ষতা, প্রশাসনের বৈরি আচরণ সত্ত্বেও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। ধারণা করি, বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব আশা করেছিলেন সামান্য একটু সুযোগ পেলে জনগণ ধানের শীষে ভোট দিয়ে ব্যালটবাক্স ভর্তি করে ফেলবে; ভোট দিয়েই ক্ষান্ত হবে না, সেই সঙ্গে ভোট ডাকাতির সরকারি ষঢ়যন্ত্র নস্যাৎ করে দেবে। মানুষ ভোট দিতও, ভোট ডাকাতির ষঢ়যন্ত্র নস্যাৎ করতও। বিএনপির প্রতি বিশেষ অনুরাগে নয়, সরকারের প্রতি বিবমিষা থেকে মানুষ তা করত। কিন্তু মানুষকে তা করতে সাহস যোগাতে বিএনপির ভূমিকা কী? এটা সত্য যে, বর্তমান সরকারের মেয়াদ প্রলম্বিত হলে শুধু বিএনপির ক্ষতি নয়, সমগ্রের ক্ষতি। এমনকি জাতীয় স্বার্থবিরোধী কাজের ক্ষতি থেকে সরকারি দলের সাধারণ সমর্থকও মুক্ত নয়। কিন্তু সেই সরকার-বিতাড়নের জন্য সফল আন্দোলন কখনো অসংগঠিত জনতা দিয়ে কিছু হয়, যতক্ষণ না কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক সংগঠন তার নেতৃত্ব দেয়। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি তার প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। সারাদেশের তীব্র সরকারবিরোধী জনমত কাজে লাগাতে অসমর্থ থেকেছে।

সুতরাং কথা একটাই। বিএনপি যদি এদেশের মানুষের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায়, তাহলে জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভূমিকা রাখতে হবে। সরাসরি ক্ষমতায় গমনের পথে অন্তরায় দূরিকরণের আন্দোলন করবে, তা হবে না। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের জন্য আন্দোলন করবে আর তাতে সফল হবে, তার আলামত দেখা যাচ্ছে না। স্পষ্ট কথা হলো — গণ-আন্দোলন লাগবে, দেশের সবচে বড় ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হিসেবে সে আন্দোলনে বিএনপিকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। গণ-আন্দোলনের কোনো শর্টকাট পদ্ধতি নেই। দিনক্ষণ ঠিক করে গণ-আন্দোলন করা যায় না। পরিকল্পিতভাবে জনস্রোত তৈরি করা যায় না। জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আন্দোলন করতে করতে একটা সময় গণ-আন্দোলন সৃষ্টি হয়। কোন ইস্যুটা মানুষকে বেশি আলোড়িত করে ফেলবে আর মানুষ পঙ্গপালের মতো রাস্তায় নেমে আসবে, তা আগাম বলা যায় না। সুতরাং রাজনৈতিক দল হিসেবে কর্তব্য হলো, আন্দোলনে থাকা। একসময় এমনিতেই জনস্রোত তৈরি হবে। মূলত ব্যাপারটা স্বল্প মেয়াদি নয়, দীর্ঘ মেয়াদি। কাজেই যারা মেঠো আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে সক্ষম, বিরোধীদলের নেতৃত্ব তাদের হাতে থাকাই বিধেয়। যারা বয়সের কারণে বা সাহসের অভাবে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে অসমর্থ, তাদের উচিত পদপদবী ছেড়ে দিয়ে তদস্থলে তরুণ সাহসী নেতৃত্বকে পদায়নের পথ করে দেওয়া।

তারপরও যদি বিরোধীদল নিজের কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হয়, তাহলে আন্দোলন বন্ধ থাকবে না। আগেই বলেছি, দেশের সকল পেশাজীবী নিজের অধিকার আদায়ের জন্য কথা বলা রপ্ত করে ফেলেছে। দেশে শ্রেণি ও পেশাভিত্তিক আন্দোলন চালু হয়ে গেছে। সামনের দিনগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকবে না শুধু, বরং বাড়বে। তবে সেই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কেবল সরকারের পতন হবে না, বিরোধীদলের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে। বিরোধী রাজনৈতিক দল নিজ কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে রাজনৈতিক দল হিসেবে তার তার প্রয়োজনও ফুরিয়ে যাবে। সরকার যেমন দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হলে তাঁকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে হয়, বিরোধীদল তার বিরোধীদলীয় কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হলে তাকেও বিদায় করা জরুরি। শেষোক্তটিকে অবশ্য বিদায় করার প্রয়োজন হয় না, রাজনৈতিক মাঠ থেকে নিজে নিজেই সরে যায়। সময়ের প্রয়োজন নতুন বিরোধীদল সৃষ্টি হয়ে শূন্যস্থানে প্রতিস্থাপিত হয়।

নিজের গুরুত্ব ধরে রাখতে হলে কথাগুলো বিএনপিকে বুঝতে হবে। শুধু বিএনপি নয়, সব বিরোধী রাজনৈতিক দলেরই কথাগুলো বোঝা উচিত। কেননা সময়ের আহ্বানে সাড়া দিতে না পারলে, যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হলে, কোনো দলেরই রাজনৈতিক গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ থাকে না, সামনেও থাকবে না।