বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

অক্টোবর ০৬ ২০১৮, ১৭:০৭

আবুল কাসেম আদিল: গতকাল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ নামক দলটি সম্পর্কে এক জায়গায় একটি মন্তব্য করেছিলাম। মন্তব্যটি হলো, ‘সংখ্যার সঙ্গে প্রজ্ঞার যোগ হলে দলটি অন্যরকম ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারবে।’ মন্তব্যটি খুবই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করেছি। গতকাল দলটির একটি সমাবেশে বিপুল পরিমাণ কর্মীসমর্থকের উপস্থিতি ঘটেছে। উপস্থিতির সংখ্যাধিক্যে দলটির সমর্থকদের অত্যুচ্ছ্বাস দেখে আমার উপরোক্ত মন্তব্য করা। কারণ রাজনীতিতে সংখ্যার অনেক মূল্য আছে বটে, কিন্তু সংখ্যার মূল্য নির্ধারিত হবে প্রজ্ঞার ভিত্তিতে। ইসলামী রাজনীতিকদের মধ্যে এই জিনিসটার পর্যাপ্ত অভাব আছে বলে মনে করি। শুধু ইসলামী আন্দোলনের বেলায় নয়, এই কথাটা সাধারণভাবে সব ইসলামী দলের ক্ষেত্রেই ঠিক।

খেয়াল করে দেখলাম, ইসলামী দলগুলো সম্পর্কে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই কম জানেন। বলা ভালো, মোটেই জানেন না। তাঁরা আন্দাজে ঢিল ছুড়ছেন। এই না জানার জন্য আমি অবশ্য তাঁদের দোষ দিতে চাই না। কারণ, বিশ্লেষকেরা বিশ্লেষণ করেন তথ্যের ভিত্তিতে। আর ইসলামী দলগুলোর তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সবসময় যথেষ্ট কার্পণ্যের পরিচয় দিয়ে আসছে। গণমাধ্যম বামদের তিরিশ জনের আন্দোলনকে যেভাবে তুলে ধরে, ইসলামী দলের তিন হাজার লোকের আন্দোলনকেও ততটুকু তুলে ধরে না। গণমাধ্যম সেই অর্থে এখনও গণমাধ্যম হয়ে উঠতে পারে নি। গণমাধ্যম নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ ও এজেন্ডা দ্বারা চালিত হয়। কোন্ বিষয়ে কতটুকু গুরুত্ব দেবে, মিডিয়ার কর্তাব্যক্তিরা বসে ঠিক করে। ইসলামী আন্দোলনসহ সব ইসলামী দল মিডিয়ার একপেশে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বলি। সংবাদমাধ্যমের ভণ্ডামি সম্পর্কে একটা কথা বেশ প্রচলিত। ‘মিডিয়া যে সমাবেশের লোকসমাগম বেশি হওয়া কামনা করে সেখানে যদি লোক কম হয়, তাহলে মঞ্চের ছবি ছাপে। আর যে সমাবেশের জনসমাগম কম হওয়া কামনা করে সেখানে যদি লোক বেশি হয়, সেক্ষেত্রেও মঞ্চের ছবি ছাপে। আর অপছন্দের সমাবেশে লোকসংখ্যা যদি এত বেশি হয় যে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, সেক্ষেত্রে অর্থের উৎস নিয়ে বিতর্কের অবতারণা করে।’ বহুদিন যাবৎ অঘোষিত এই নিয়মটা মিডিয়ায় কঠোরভাবে পালিত হয়ে আসছে। এই অনিয়মটাই এই মহলে এক ধরনের নিয়মে পরিণত হয়েছে।

সব দোষ মিডিয়ার ঘাড়ে না চাপিয়ে ইসলামী দলের নেতাদের দায়িত্বশীলতার কথাও বলা দরকার। মিডিয়ায় যথাযথ গুরুত্ব পাওয়ার জন্য অবশ্য আলেমরা কখনোই সচেষ্ট ছিলেন না। এখানে এসে আবার প্রজ্ঞার কথা বলতে হবে। আগেই বলেছি— রাজনীতিতে সংখ্যার অনেক মূল্য আছে বটে, কিন্তু সংখ্যার মূল্য নির্ধারিত হবে প্রজ্ঞার ভিত্তিতে। এখানে এসেই আলেমরা বারবার মার খেয়ে যান।

ইসলামী দলের সমাবেশে লোক-সমাগম বেশি দেখলেই কেউ কেউ প্রশ্ন তোলেন— যারা সমাবেশে এসেছে, তারা সবাই ভোট দেবে তো? এত মানুষ ভোট দিলে এই দলের প্রার্থীরা জেতে না কেন? এর সরল উত্তর হলো, মানুষ ভোট দিচ্ছে তো। বিগত কয়েকটি সিটি নির্বাচনেই ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরা প্রচুর ভোট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি ছাড়া অন্যান্য ইসলামী ও বাম দলের সমষ্টিগত ভোটের চেয়েও ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীরা বেশি ভোট পেয়েছেন। তারপরও কোনো একটি উপজেলায় এবং সিটিতে কেউ নির্বাচিত হতে পারে নি কেন? পারেনি, কারণ এই সমাবেশে যদি দশ লাখ লোক উপস্থিত হয়ে থাকেন, এঁরা কোনো একটি সংসদীয় আসন বা সিটি কর্পোরেশন থেকে এসে একত্রিত হন নি। এই দশ লাখ লোক তিনশ সংসদীয় আসন থেকে এসে একত্রিত হয়েছেন। এই দশ লাখ ভোটারকে তিনশ আসনে বিভাজিত করলে (১০০০০০০÷৩০০) ফলাফল দাঁড়ায় গড়ে তিনশ তেত্রিশ করে। সুতরাং এই পরিমাণ ভোট তো তাঁরা পাচ্ছেনই। এই পরিমাণ নয় শুধু, বিগত সিটি নির্বাচনগুলোতে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ আনুমানিক গড়ে বিশ হাজার করে ভোট পেয়েছে। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সমাবেশে যে পরিমাণ লোক হয়, এই দলের ভোটার আরো বেশি।

তারপরও আমি মনে করি, নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের পদ্ধতি পরিবর্তন করলে দলটি আরো বেশি সাফল্য পাবে। এই দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে একটা প্রবণতা কাজ করে, তা হলো যেভাবেই হোক জাতীয়-স্থানীয় সব নির্বাচনে সব আসনে প্রার্থী দিতে হবে। এই হিসাব মাথায় রেখে তাঁরা প্রার্থী নিযুক্ত করেন। এজন্য তাঁরা সংসদ, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ এই ধারাবাহিকতায় প্রার্থী প্রস্তুত করেন। নেতারা দলের বিদ্যমান নেতাদের মধ্য থেকে তিনজনকে তিনটি জায়গার জন্য মনোনীত করেন। এই তিনজনের মধ্যে যোগ্যতার ক্রমাসারে সংসদ, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের জন্য মনোনয়ন দেয়া হয়। অনেক জায়গায়ই দেখা যায়, যাঁকে সবচে যোগ্য বিবেচনায় সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য মনোনয়ন দেয়া হয়, তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর্যায়ের জনপ্রিয় নেতা। তাঁকে ইউনিয়ন পরিষদে মনোনয়ন দিলে সহজে চেয়ারম্যান হয়ে যেতে পারতেন। তিনি ওই সংসদীয় আসনের ইসলামী আন্দোলনের বিদ্যমান নেতাদের মধ্যে সবচে জনপ্রিয় হতে পারেন, কিন্তু সার্বিক বিচারে আওয়ামী লীগ-বিএনপি তথা প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীদের তুলনায় তিনি যেহেতু ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রিয় নেতা, তাঁকে ইউনিয়ন পরিষদের জন্যই মনোনীত করা উচিত। তাহলে জিতে যাওয়ার সুযোগ বেশি। এতে তৃণমূলে দল শক্তিশালী হবে। এই জায়গায় জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের কৌশল তুলনামূলক ভালো মনে হয়। জমিয়ত এই কৌশলে বেশ কয়েকটি উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান জিতিয়ে আনতে পেরেছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি অভিযোগ যে, দলটি প্রার্থী দিয়ে বিএনপির ভোট নষ্ট করে। এই অভিযোগের ভিত্তি এই যে, মনে করা হয় রাজনীতিতে ইসলাম-পছন্দ লোকেরা আওয়ামী লীগের চেয়ে তুলনামূলক বিএনপিকে পছন্দ করে। যখন ইসলামী দল প্রার্থী দেয় আর সেই নির্বাচনে বিএনপিও প্রার্থী দেয়, তাহলে বিএনপির ভোটই কাটা যায়। কারণ ইসলামী আন্দোলন প্রার্থী না দিলে এই দলের ভোটগুলো বিএনপিই পেত। এই সমীকরণ অতি সরলীকরণ। প্রথম কথা হলো, ইসলামী আন্দোলনের নিজস্ব একটা সমর্থকগোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। চরমোনাই পীর সাহেবের মুরিদেরা এই দলের নেতা-কর্মী-সমর্থক। এদেরকে পীর সাহেব এই পর্যায়ে বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন যে, নাজাত পেতে হলে এই দলকেই ভোট দিতে হবে। মুরিদেরা এটা বিশ্বাসও করে নিয়েছে। এই কয়েকদিন আগেও পীর সাহেবের ভাই ও দলের সহসভাপতি প্রকাশ্যে বলেছেন, হাতপাখায় ভোট দিলে ভোট পাবেন আল্লাহর নবী। আল্লাহ নবীর প্রতিপক্ষকে ভোট দেওয়ার দুঃসাহস কে করবে! কথাটা কতটা হাস্যকর ও দুঃসাহসপূর্ণ, সেদিকে যাব না। শুধু এটুকু বলতে চাই, এইভাবে মুরিদদেরকে পীর সাহেবেরা নিজের দলের ভোটার বানিয়েছেন। এরা একান্তই এই দলের ভোটার। এই ভোটাররা পীর সাহেবের অন্ধভক্ত। এরা বিএনপিকে ভোট তো দেবেই না, অন্য ইসলামী দলকে ভোট দিতেও অনিচ্ছুক।


আরেকটি কারণ হলো, এই দলের নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুই দলকেই এক মনে করে। শুধু তা-ই নয়, এদের বড় একটা অংশ তুলনামূলক আওয়ামী লীগকে মন্দের ভালো মনে করে। সরাসরি আওয়ামী লীগকে বিএনপির চেয়ে মন্দের ভালো মনে করে না। আওয়ামী লীগকে ভালো মনে করে একটু ঘুরিয়ে। এই মনে করার পক্ষে তাদের দার্শনিক যুক্তিও আছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝেছি তা হলো— মূলত তুলনামূলক ভালো বিএনপিই। যেহেতু বিএনপির গঠনতন্ত্রে কিছুটা ধর্মীয় ভাবধারা আছে, এজন্য মানুষ বিএনপিকে পুরোপুরি ভালো মনে করার ধোঁকায় পতিত হবে। এতে ক্ষতি বেশি। কিন্তু আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র স্পষ্ট ধর্মনিেপেক্ষ হওয়ায় তাঁদেকে ভালো মনে করে না। সুতরাং আওয়ামী লীগ দ্বারা ক্ষতির আশঙ্কা কম। কারণ মানুষ এই দলকে ভালো মনে করার ধোঁকায় পতিত হবে না। তাদের এই যুক্তির অসারতা নিয়ে কথা বাড়ানোর দরকার মনে করছি না।

যুক্তি তাদের এটা হলেও আমার মনে হয়েছে, অন্য কোনো সুপ্ত কারণ আছে, যে কারণে এরা আওয়ামী লীগকে একটু ভালো ‘পায়’। সবসময় দেখি, এরা বিএনপির সমালোচনা একটু বেশি করে। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের সমালোচনা বেশি করে। ফরহাদ মজহার আর শফিক রেহমান নিয়ে এরা বিস্তর সমালোচনা করে। এরচে বড় বড় পিস আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখে, সে নিয়ে এদের মাথাব্যথা কম। এই দলের তরুণদের বড় একটা অংশ আওয়ামীপন্থী আলেম মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের প্রতি অনুকম্প।

-আবুল কাসেম আদিল, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।