বাংলাদেশের আইসিইউ, করোনা ও কিছু বাস্তবতা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ১১ ২০২০, ০২:১১

ডা: রিফাত আল মাজিদ


১৯৮৪ সালের আগে বাংলাদেশে কোন আইসিইউ ছিল না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেকহা) একটা আইসিইউ স্থাপনের জন্য ১৯৮৩ সালে তৎকালীন সরকারের কাছ থেকে অধ্যাপক শাহজাহান নুরুস সামাদ ব্যাক্তিগত উদ্যোগে একটা সম্মতিপত্র অর্জন ও কিছু অর্থ বরাদ্দ করান। কিন্তু ঐ টাকা অত্যন্ত অপ্রতুল ছিল।

আমি ১৯৮৩ ‘র জুলাইতে এনাস্থেসিয়া বিষয়ে বাংলাদেশে প্রথম এফসিপিএস অর্জন করি। ঐ বছরই সেপ্টম্বরে আমাকে ঢামেক হাসপাতালে পদায়ন করে সেখানে একটি আইসিইউ স্থাপনের দ্বায়িত্ব প্রদান করা হয়। সরকার প্রদত্ত টাকায় অত্যন্ত সাধারণ ৮টা বেড আর ৪টা ভেন্টিলেটার আমদানী করা গিয়েছিল। কিন্তু ভেন্টিলেটার চালানোর জন্য মেডিকেল গ্যাস পাইপলাইনের কোন ব্যাবস্থা করা যাচ্ছিল না অর্থাভাবে। তার কিছুদিন আগে স্বাস্থ্য খাতে খরচের জন্য যুক্তরাজ্য সরকার ৮০ হাজার পাউন্ড বরাদ্দ দিয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্যি, ঐ টাকা খরচ না করার কারণে ফেরত চলে যায়। এই খবরটি দেন যুক্তরাজ্য সরকারের বাংলাদেশের প্রতিনিধি ক্রাউন এজেন্সীসের মিসেস সেন (ডা: শামন্ত সাল সেনের স্ত্রী)। এবং অধ্যাপক শাহজাহান নুরুস সামাদ ও মিসেস সেনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে ঐ ফেরত যাওয়া ৮০ হাজার পাউন্ড ফেরত আনা হয়। সেই টাকা খরচ করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমরা বাংলাদেশের প্রথম মেডিকেল গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করতে সক্ষম হই।

আইসিইউ স্থাপনের কাজ যখন চলছিল তখন আমাকে বৃটিশ কাউন্সিলের অর্থ সহায়তায় পাঠানো হয় যুক্তরাজ্যের এডিনবারার রয়াল ইনফারমারীতে আইসিইউর উপর প্রশিক্ষণের জন্য। ১৯৮৪ সালে দেশে ফিরে ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশের প্রথম মেডিকেল গ্যাস পাইপলাইনের উদ্বোধন করাই।
এর কিছুদিন পরই (জানুয়ারী ১৯৮৫) আমরা আইসিইউতে রোগী ভর্তি করা শুরু করি। এখানে লক্ষনীয় যে, আইসিইউটির কোন অফিসিয়াল উদ্বোধন হয়নি। কারণ এই ইউনিটটিতে সরকারের স্বীকৃতি ছিল না। অর্থাৎ এটির জন্য কোন বাজেট বরাদ্দ ছিল না।

অজ্ঞাত কারণে সরকারের কাছে বার বার তাগাদা দেওয়া সত্বেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আইসিইউকে তার ডেভলাপমেন্ট বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করেনি। যার ফলে এর পরিচালনা ব্যয় আমরা সরকারের কাছ থেকে কোন দিনই পাইনি। খোদ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এবং উপসচিব কয়েকজন বিভিন্ন সময়ে এই আইসিইউতে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। যখন তারা ভর্তি ছিলেন তাদেরকে এই ইউনিটটিকে সরকারের স্বীকৃতী প্রদানের জন্য অনুরোধ করা হলে সবাই কথা দিয়ে গেছেন, করে দেবেন বলে। কিন্তু কেউ তাদের কথা রাখেন নি।

সরকারের স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে দেশের প্রথম এই ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিটটির জন্য কোন অর্থ বরাদ্দ আসতো না। হাসপাতালের পরিচালকদের দয়ায় কন্টিন্জেন্সি ফান্ড থেকে বরাদ্দ নিয়ে এই ইউনিট চলে আসছে এতকাল।

এই ইউনিটের স্বীকৃতী না পাওয়ায় এই আইসিইউতে কোন নার্স বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। কোন ডাক্তারও পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন সময়ে ডিএ এবং এফসিপিএস এর কোর্সের ছাত্রদের দিয়ে এই ইউনিট চালানো হতো। কত শত বার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, যুগ্ম সচিব আর উপসচিবদের অফিসে ধরনা দিয়েছি। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। আইসিইউ স্বীকৃতি পায়নি। যদি এই আইসিইউটি সময়মত তার স্বীকৃতি পেয়ে যেত তাহলে দেশে আজকে আসিইউ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় প্রচুর জনবল পাওয়া যেত। শুধু তাই নয়, এর দেখাদেখি প্রাইভেট সেক্টরেও অনেক ভালো আইসিইউ প্রতিষ্ঠা পেয়ে যেতো।

বলতে কষ্ট হলেও বাস্তব চিত্রটা তুলে ধরলাম এই জন্য যে, আজকে কোরোনা নিয়ে অনেক কথা শুনছি। আইসিইউর অপ্রতুলতার কথা শুনছি। ভেন্টিলেটর নিয়ে কত কথা হচ্ছে, শত শত কোটি টাকা বরাদ্দ হচ্ছে ভেন্টিলেটর কেনার জন্য, আরো কত কি! কিন্তু আজকে সেই আইসিইউ এর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজনীয় ইন্টেনসিভিস্টের অভাব দেখা যাচ্ছে। আজকেই দেখলাম একজন উপসচিব আইসিইউতে বেড না পেয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেছেন। অবশেষে মারা গেছেন।

বাংলাদেশের বুরোক্রাটদের মানসিকতার কারণে দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আজকে এই বেহাল অবস্থা। তারা আছেন ডাক্তারদের প্রাইভেট প্রাক্টিস নিয়ে। সময়মত শুধু এই একটি আইসিইউকে যথাযথ মূল্যায়ন না করায় দেশে আজ আইসিইউর এই দুরবস্থা। এর জন্য কাউকে জবাবদিহি করা যাবে না কোনদিনই। কিন্তু ওপরওয়ালার কাছে এর জবাব একদিন দিতেই হবে।