ফরীদ উদ্দীন মাসউদের কাছে আলেমসমাজের ঋণ -ফায়যুর রাহমান

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

আগস্ট ১৮ ২০১৮, ১০:০৭

একুশে জার্নাল মতামত : আজকের পৃথিবীতে যে উগ্রবাদী গোষ্ঠিগুলো রয়েছে, এদের জন্মের বহু আগেই উগ্রপন্থী মতবাদ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছিলেন দু’জন তাত্ত্বিক। এদের একজন পাকিস্তানের আবুল আলা মওদুদী, অপরজন মিসরের সাইয়েদ কুতুব।

ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যা দিয়ে উপমহাদেশে ইসলামের শান্তিপূর্ণ ধারাটিকে ব্যহত করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখা ব্যক্তিটির নাম ম আবুল আলা মওদুদী। তার তাকফিরি মতবাদে ভর করেই এ অঞ্চলসহ আরববিশ্বে জঙ্গিবাদের বীজতলা তৈরি করে। ধীরে ধীরে মওদুদীর চিন্তাকে আরববিশ্বে আত্মীকরণ করেন সাইয়েদ কুতুব। সময়ের সাথে সাথে উগ্র চিন্তার প্রচারক হয়ে একই সূতোর মালা হয়ে এগিয়ে যায় দুটি দল; জামাত ও ইখওয়ান।

ইখওয়ান ও জামাতের জন্যে অনেক লিটারেচার তৈরি হয়।মুসলিম যুবসমাজের চিন্তাকে বিচ্যুত করার চেষ্টা হয়। এদের প্রচেষ্টায় ধীরে ধীরে এই উগ্র লিটারেচার ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বজুড়ে।তৈরি কায়দা-আইএসের মতো নৃসংস গোষ্ঠি।

কায়দা-আইএসের মতাদর্শ যখন বাড়বাড়ন্ত, বিভ্রান্ত যুবকরা যখন এই ধারায় উজ্জীবিত হয়ে শান্তি-সম্প্রীতি ও ভালোবাসার ধর্ম ইসলামকে কলংকিত করছিলো, তখনই এগিয়ে আসেন মাওলানা ফরীদ উদ্দীন মাসউদ। তৈরি করেন জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চ। প্রকাশ করেন এক লক্ষ মুফতি-আলেমের সাক্ষর করা শান্তির ফতোয়া।এই ফতোয়ার শক্তি যে অস্ত্রের চেয়ে বেশি ছিলো, সেটা বুঝা গেছে ইতোমধ্যে। জঙ্গিবাদ ইসলামের শত্রু হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

জঙ্গিবাদবিরোধী শান্তির ফতোয়া প্রকাশের পরেই তার ওপর ক্ষ্যাপে যায় উগ্রবাদীরা।এ ক্ষেত্রে প্রোপাগান্ডা তৈরির কৌশল নেয় জামাত। তারা মাসউদের বিরুদ্ধে তৈরি করে নানান কিসিমের নেতিবাচক মিথ। তার গায়ে তকমা লাগায় দালালের। তাকে দাঁড় করায় ইসলামের চেতনাবিরুদ্ধ ব্যক্তি হিসেবে।কারণ কী? কারণ যেখানেই উগ্রবাদ, সেখানেই জামাত। সাম্প্রতিককালের উগ্র সালাফিদের প্রতি জামাতিদের সমর্থন দেখেই বুঝা যায় রসুনের গোড়া এক কেন।

মাসউদের বিরুদ্ধে জামাতিদের প্রোপাগান্ডার শ্রোতে গা ভাসায় হালছাড়া কিছু কওমিয়ানও। এরা নিজেদের অজান্তেই জামাতের সুরে সুর মেলায়। প্রোপাগান্ডার তালে তাল মেলায়। জামাতিদের মতো গালি দেয় ফরীদ মাসউদকে। এরা ভুলে যায় ফরীদ মাসউদ একটি প্রতিষ্ঠানের নাম। যে প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম দেওবন্দের ফসল। যে প্রতিষ্ঠান সহবত দিয়ে সযত্নে গড়েছেন আওলাদে রাসুল আসআদ মাদানী।

এরা ভুলে ফরীদ উদ্দীন মাসউদ দারুল উলুম দেওবন্দের উজ্জ্বল সন্তান। এখনো দারুল উলুম দেওবন্দে উচ্চশিক্ষায় যেতে যার সুপারিশ দরকারি। এরা ভুলে যায় মাসউদকে গালি দিলে প্রকারান্তে ওই গালি এসে পড়ে নিজের ওপরেই। থু থু যেমন উপর দিকে ফেললে নিজের মাথায় পড়ে।

এরা এই সত্যটি ভুলে যায় যে, ফরীদ মাসউদ না হলে কওমি মাদরাসা সনদের স্বীকৃতিটি কখনোই আসতো না। আর বর্তমান সরকার ছাড়া কওমি সনদের স্বীকৃতি দেওয়ার সাহসী উদ্যোগ কারো দ্বারা সম্ভব ছিলো না। চুতিয়া বিএনপির দ্বারা তো জিন্দেগিতেই না।

কওমি মাদরাসার লাখো জনশক্তিকে কাজে লাগানো যে রাষ্ট্রের জন্যে দরকারি, ফরীদ মাসউদের মতো একজন মানুষ ছিলেন বলেই এই বাস্তবতাটি সরকারকে বুঝাতে পেরেছিলেন।আর আওয়ামী লীগের মতো গণ-অভিমুখী সরকার ছিলো বলেই সেই বাস্তবতা বুঝে সেটি বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছে।

সনদের মূলা বিএনপিও ঝুলিয়েছিলো। কিন্তু জামাতি হিপোক্রেসিতে সেই মূলা মূখ পর্যন্ত আসেনি। এই সত্যটির প্রমাণ আমরা দেখেছি বর্তমান সরকার যখন স্বীকৃতির ঘোষণা দিলো, তখন সবচেয়ে বেশি নাখোশ হলো জামাত। কারণ জামাত কখনো চায় নি কওমির সন্তানেরা সরকারি চাকরিবাকরিতে ঢুকে তাদের বাড়াভাতে হাত দিক।

ফরীদ উদ্দীন মাসউদ তৎপর হবার আগ পর্যন্ত একাত্তরে জামাতি কুকর্মের দায় ভোগ করতে হতো কওমির আলেমদেরও। রাজাকারের তকমা বহন করতে হতো কওমিয়ানদেরও। ফরীদ উদ্দীন মাসউদ জাতিকে বুঝালেন জামাত আর আলেমওলামা এক নয়। আলেমওলামা মানেই রাজাকার নয়।কওমি মাদরাসা যে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি, এদেশের আলেমওলামারাও যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, এই সত্যটি তিনিই জোর গলায় বললেন। এই ক্ষেত্রে আরেকজনের নাম অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে, তিনি সৈয়দ মবনু।সৈয়দ মবনুই সর্বপ্রথম কলম ধরেন এই বিষয়ে। খুঁজে বের করেন আলেম মুক্তিযোদ্ধাদের। সাক্ষাৎকার নেন তাদের। পত্রপত্রিকায় লেখেন নিবন্ধ। তার নিবন্ধে অনুপ্রাণিত হয়ে এগিয়ে আসেন আরেকজন। তার নাম শাকের হোসেন শিবলী। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় এই সত্য যে, কওমি আলেমরা রাজাকার ছিলেন না, মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

জামাতি উগ্রচিন্তার প্রভাবে আগে এদেশের কওমি মাদরাসাগুলোকে জঙ্গিবাদের জন্যে দায়ী করা হতো। কিন্তু ফরীদ মাসউদের শান্তির ফতোয়ার পরে দৃশ্যপট পরিবর্তন হলো। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ঘোষণা এলো কওমির সন্তানেরা জঙ্গি হয় না। জঙ্গি হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অধিকারী ইংরেজি শিক্ষিত তরুণরা।

এদেশের রাষ্ট্রীয় আচার-অনুষ্ঠানে যখন ভান্ডারিদের প্রভাব ও অংশগ্রহণ একচ্ছত্র ছিলো, তখনই ফরীদ উদ্দীন মাসউদ নিয়ে এলেন ভারসাম্য।মাসউদ না হলে রাষ্ট্রের যারা কর্তা, তাদেরকে আজীবন ভান্ডারি ইসলামই বুঝানো হতো, দেওবন্দী উদার ইসলামের আলো সেখানে অনুপস্থিত থাকতো।

এইসব নানা কারণে ফরীদ উদ্দীন মাসউদের কাছে এদেশের আলেমসমাজের অনেক ঋণ।তারা যতদিন এই ঋণ উচ্চকন্ঠে স্বীকার না করবেন, ততদিন আলেমসমাজের ওপর জামাতি খড়গ উড়তে থাকবে। এদেশের আলেমরা আজীবন জামাতি প্রোপাগান্ডার তলে আশ্রয় নেবেন, নাকি আত্মচেতনায় ঘুরে দেড়াবেন, দেখায় অপেক্ষায় আছি।
-ফায়যুর রাহমান

বিঃদ্রঃ মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী   একুশে জার্নাল এর মতামত বিভাগের সকল কলামের দায়ভার সম্পূর্ন সংশ্লিষ্ট লেখকের। এর সাথে একুশে জার্নালের মতামতের সাথে কোন সম্পর্ক নেই।
-সম্পাদক