পৃথিবীর দীর্ঘতম দিনের দেশেগুলোতে রোযার বিধান

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ১৫ ২০১৯, ১৫:৪৮

 

তাওহীদুল ইসলাম

ইসলাম বিশ্বজনীন পূর্নাঙ্গ ও সর্বোত্তম একটি জীবন বিধান। যা সর্ব কালের সর্ব যুগের সকল মানুষের উপযোগী একটি কল্যাণকর ধর্ম৷ ইসলাম মানুষকে এমন কোন বিধান পালন করার আদেশ দেয়না যা মানুষের ক্ষমতার বাইরে৷
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
وَمَا جَعَلَ عَلَيْكُمْ فِى ٱلدِّينِ مِنْ حَرَجٍ
তিনি তোমাদের উপরে ধর্মের ব্যাপারে কোনো কাঠিন্য আরোপ করেন নি। (সূরা আল হাজ্জ্ব, আয়াত: ৭৮)
তিনি আরো ইরশাদ করেন-
لَا يُكَلِّفُ ٱللَّهُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا
অর্থঃ আল্লাহ্ তাআলা কোনো উপরে তার ক্ষমতার অতিরিক্ত দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না।
(সূরা আল-বাকারা,আয়াত: ২৮৬)
মহান আল্লাহ তা’আলা সমগ্র মাখলুকাতের মাঝে মানবজাতির জন্য ঐশী জীবন বিধান অবতীর্ণ করে তাদেরকে সম্মানিত করেছেন৷ তাঁর পক্ষ হতে নাযিলকৃত এই প্রতিটি বিধানের মাঝেই নিহিত রয়েছে মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ ও মঙ্গল৷

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে যে সব বিধান পালনের নির্দেশ দিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম একটি বিধান হলো রমজান মাসের রোজা৷ এই রোজার মাঝেও রয়েছে উভয় জগতের বহু উপকারিতা৷

রোজার বিধান: প্রাপ্ত বয়স্ক সকল মুসলমানদের রোজার রাখা ফরজ হলেও সর্বাবস্থায় সকলের জন্য রোজা রাখতে বাধ্যতামূলক বিধান নয়৷ যারা রোজা রাখতে অপারগ তাদের জন্য বিকল্প সুযোগও রয়েছে ইসলামে ৷ এ বিষয়টি মহান আল্লাহ তাআলা নিজেই পবিত্র কুরআনে স্পষ্টরুপে উল্লেখ করেছেন-

شَهْرُ رَمَضَانَ ٱلَّذِىٓ أُنزِلَ فِيهِ ٱلْقُرْءَانُ هُدًى لِّلنَّاسِ وَبَيِّنَٰتٍ مِّنَ ٱلْهُدَىٰ وَٱلْفُرْقَانِ فَمَن شَهِدَ مِنكُمُ ٱلشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ وَمَن كَانَ مَرِيضًا أَوْ عَلَىٰ سَفَرٍ فَعِدَّةٌ مِّنْ أَيَّامٍ أُخَرَ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلْيُسْرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلْعُسْرَ وَلِتُكْمِلُوا۟ ٱلْعِدَّةَ وَلِتُكَبِّرُوا۟ ٱللَّهَ عَلَىٰ مَا هَدَىٰكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ
অর্থঃ রমযান মাস এইটি যাতে কুরাআন নাযিল হয়েছিল, — মানবগোষ্ঠীর জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে, আর পথনির্দেশের স্পষ্টপ্রমানরূপে, আর ফুরকান। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে কেউ মাসটির দেখা পাবে সে যেন এতে রোযা রাখে। আর যে অসুস্থ বা সফরে আছে যে সেই সংখ্যক অন্য দিনগুলোতে (রোযা পালন করবে)। আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সুবিধা চান, আর তিনি তোমাদের জন্য কষ্টকর অবস্থা চান না, আর তোমরা যেন এই সংখ্যা সম্পূর্ণ করো, আর যাতে আল্লাহ্‌র মহিমা কীর্তন করো তোমাদের যে পথনির্দেশ তিনি দিয়েছেন সেইজন্য, আর তোমরা যেন কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করো।
(সূরা আল বাকারা,আয়াত: ১৮৫)

পৃথিবীর দীর্ঘতম দিনের দেশেগুলোতে রোযার বিধান:
পৃথিবীর ভৌগলিক অবস্থানের ভিন্নতার কারণে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান রয়েছে৷ সে কারণেই দেশ ভেদে রোজা সময়ও দীর্ঘ ও সংক্ষিপ্ত হয়৷
ইউরোপের উত্তরের দেশগুলোতে যেমন, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়েতে এই ব্যবধান আরো বেশি সেখানে গ্রীষ্মকালীন রোজা ২০ থেকে ২২ ঘণ্টা পর্যন্ত দীর্ঘ হয়ে থাকে৷ এ সব এলাকার রোজার ব্যাপারে উলামায়ের মতামত হলো, তারা নিজ নিজ এলাকার সময় অনুযায়ী সাহরী ও ইফতার করবে৷

ইফতারের সময়ের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে কারীমে নির্দেশনা এসেছে-
وَكُلُوا۟ وَٱشْرَبُوا۟ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَكُمُ ٱلْخَيْطُ ٱلْأَبْيَضُ مِنَ ٱلْخَيْطِ ٱلْأَسْوَدِ مِنَ ٱلْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا۟ ٱلصِّيَامَ إِلَى ٱلَّيْلِ وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمْ عَٰكِفُونَ فِى ٱلْمَسَٰجِدِ تِلْكَ حُدُودُ ٱللَّهِ فَلَا تَقْرَبُوهَا كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ ٱللَّهُ ءَايَٰتِهِۦ لِلنَّاسِ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
অর্থঃ ..আর আহার করো ও পান করো যতক্ষণ না তোমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে ভোরবেলাতে সাদা কিরণ কালো ছায়া থেকে, তারপর রোযা সম্পূর্ণ করো রাত্রি সমাগম পর্যন্ত। আর তাদের স্পর্শ করো না যখন তোমরা মসজিদে ই’তিকাফ করো। এ হচ্ছে আল্লাহ্‌র সীমা, কাজেই সে-সবের নিকটে যেয়ো না। এইভাবে আল্লাহ্ তাঁর আয়াতসমূহ মানুষের জন্য সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন যাতে তারা ধর্মপরায়ণতা অবলন্বন কর৷(সূরা আল বাকারা, আয়াত: ১৮৭)

ইমাম বুখারী (রহ.) তার সহিহ বুখারীতে ইফতার সময়ের ব্যাপারে একটি স্বতন্ত্র পরিচ্ছদ তৈরি করেছেন৷ তিনি বলেছেন,
باب متى يحل فطر الصائم وأفطر أبو سعيد الخدري حين غاب قرص الشمس
‘রোজাদারের জন্য কখন ইফতার করা জায়েয হবে? হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু সূর্য অস্ত যাবার পরে ইফতার করেছেন৷’
এই পরিচ্ছেদের অধিনে তিনি নিম্নোক্ত হাদীসটি বর্ণনা করেছেন৷
عمر بن الخطاب عن أبيه رضي الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا أقبل الليل من ها هنا وأدبر النهار من ها هنا وغربت الشمس فقد أفطر الصائم
অর্থ:হযরত উমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম বলেছেন যখন পূর্ব দিগন্ত থেকে রাতের অন্ধকার ছেয়ে আসবে, পশ্চিম দিগন্তে দিনের আলো হারিয়ে যাবে এবং সূর্য এবং সূর্য অস্ত যাবে তখন রোজাদার ইফতার করবে৷(সহিহ বুখারী:১৮৫৩)

উল্লিখিত কুরআন-সুন্নাহর নুসূসাতের আলোকে এ বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয় যে, ইফতারের সময় সূর্য অস্তমিত হওয়ার পরেই হয়৷ সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বে ইফতার করার কোন সুযোগ নেই৷

সুতরাং যে সব এলাকায় দিন অধিক লম্বা ও রাত ছোট সে সব এলাকার বাসিন্দাদেরকেও গোটা দিন রোজা পালন করতে ৷ তবে যদি কোন ব্যক্তির রোজা পালন করতে অধিক কষ্ট হয় এবং অভিজ্ঞ ডাক্তারের মতামত অনুযায়ী রোজা রাখলে তার জীবনহানি বা মারাত্মক রোগাক্রন্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে তার জন্য রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে৷ পরবর্তিতে যখন সম্ভব সে উক্ত রোজার কাজ করে দেবে।

তবে তাদের জন্য সৌদির সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে ইফতার করার সুযোগ নেই ৷ কেননা তাদের মধ্যে যারা অপারগ শরীয়ত তাদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা রেখেছে৷ আর যারা অপারগ নয় তাদের রোজা পালনে অন্য এলাকায় লোকের তুলনায় কষ্ট বেশি হবে ঠিক কিন্তু তাদের সাওয়াব ইনশা আল্লাহ অধিক হবে৷

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলাকে তাঁর উমরা পালন অবস্থায় বলেছিলেন, ‘তোমার উমরার সাওয়াব উমরা পালনে তোমার কৃত খরচ এবং কষ্ট পরিমাণ হবে’৷ ( সহিহ বুখারি:১৬৯৫) এ হাদিসের আলোকে ফুকাহায়ে কেরাম বলেন, ইবাদতের সাওয়াব ইবাদত পালনে কষ্ট অনুপাতে হবে৷ সুতরাং যে এলাকায় লোকেরা অধিক কষ্ট করে রোজা পালন করবে তাদের সাওয়াবও অধিক হবে ৷

এই মাসআলার ব্যাপারে কেউ কেউ ভিন্নমত পোষন করেছেন৷ তারা বলেন, যে সব এলাকায় ষোল ঘন্টার অধিক রোজা রাখতে হয় তাদের জন্য সৌদির সময়ের সাথে মিল রেখে পার্শবর্তি কোন মুসলিম এলাকার সাথে মিল রেখে রোজা রাখবে ৷

তাদের যুক্তি হলো পুরো একমাস ধরে দিনে ২০/২১ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা কষ্টকর এবং শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ৷ আর ইসলাম মানুষকে কষ্টে আপতিত করা সমর্থন করে না।
ইসলামের মূল কথা ধর্ম পালন যেন যন্ত্রণাকর না হয়, বরঞ্চ সহজ হয়।’

এই মতামতটি গ্রহণযোগ্য নয়৷কারণ দীর্ঘতম দিনের এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে যাদের রোজা রাখতে শরয়ী ওযর রয়েছে তাদের জন্য শরীয়ত ভিন্ন পথ রেখেছে যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে যে, তারা রোজা না রেখে পরবর্তীতে কাজা করে দেবে৷

কোন এলাকার দিন দীর্ঘ হওয়ার কারণে ভিন্ন এলাকার সময়ের সাথে মিলিয়ে ইফতার করার অবকাশ কুরআন-সুন্নাহর মাঝে কোথাও সরাসরি যেমন নেই তেমনি এর কোন ইশারা-ইঙ্গিত নেই৷ বরং এই মতামত সুস্পষ্ট নসের পরিপন্থি৷ আর সে সব মাসআলাতে কুরআন-সুন্নাহর স্পষ্ট নস ( দলিল) রয়েছে সেখানে নসের বিপরীত কিয়াস গ্রহণযোগ্য নয়৷ সুতরাং আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, ইংল্যান্ড, ক্যানাডাসহ যে সব দেশে ১৮ -২২ ঘণ্টা লম্বা দিন সে সব এলাকার বাসিন্দার জন্য সৌদির সময়ের সাথে মিলিয়ে ইফতার করার কোন সুযোগ নেই৷

লাজনাতু দ্দাইমাহ লিল বুহুছিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা ফিল মামলাকাতিল আরাবিয়্যাহ আস সুউদিয়্যাহ এর সর্ব সম্মিলিত সিদ্ধান্তও এমন৷ বিস্তারিত দেখুন কমেন্ট বক্সে প্রদত্ত লিংকে৷)
তবে পৃথিবীর যে সব দেশে ৬ মাস রাত ও ৬ মাস দিন হয় বা কোন মৌসুমে সূর্য অস্তমিত যায় না৷ সে সব দেশের মানুষ রাত-দিন হিসাবে ২৪ ঘণ্টার সময় ভাগ করে পার্শ্ববর্তী অন্যান্য দেশের সাথে মিলিয়ে নামায-রোজা পালন করবে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা দিনে ও রাতে মোট ৫ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। এছাড়া দাজ্জালের আবির্ভাবের সময়ে তার প্রথম দিন বর্তমানের এক বছরের সমান, দ্বিতীয় দিন একমাসের, এবং তৃতীয় দিন এক সপ্তাহের সমান হবে। বাকী ৩৭ দিন বর্তমানের দিনের সমান হবে মর্মে রাসূল (ছাঃ) হাদীছ বর্ণনা করলে ছাহাবীগণ সেদিনের নামায কিভাবে পড়তে হবে তা জানতে চাইলে তিনি উক্ত সমাধান প্রদান করেন। (মুসলিম হা/২৯৩৭, তিরমিযী হা/২২৪০, আবুদাঊদ হা/৪৩২১)

লেখক: তাওহীদুল ইসলাম
নাসার সিটি, কায়রো, মিশর