পর্নোগ্রাফির মরণথাবা-১

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

নভেম্বর ২৯ ২০১৮, ১১:১৩

শেখ ওয়ালিদ আল হামিদীপর্ণগ্রাফি সম্পর্কে জানার পর এ ব্যাপারে কিছু লিখার চিন্তা করেও থেমে গিয়ে ছিলাম এই ভেবে যে, লজ্জাকর একটা বিষয়ে কিভাবে লিখি? পাঠক মহল কী ভাববে? ইত্যাদি। কিন্তু এখন ভাবছি এব্যাপারে নিশ্চুপতা সমাজের ক্ষতির কারণ ছাড়া কিছু নয়। আজকের এ লেখাটি ভূমিকা স্বরূপ। পর্ণগ্রাফির ভয়াবহ ক্ষতি সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত সহকারে ধারাবাহিক কয়েকটি প্রবন্ধ ও ডকুমেন্টারি তৈরির পরিকল্পনাকে সামনে রেখে আজকের এ ভূমিকার অবতারণা।

দুই.
ডিজিটালাইজেশনের এ যুগে পর্নোগ্রাফি সম্পর্কে জানা নেই এরকম মানুষের সংখ্যা ধারণা প্রাপ্তদের তুলনায় কম। যাদের এ সম্পর্কে বিন্দু পরিমাণ ধারণা নেই তারা আলহামদুলিল্লাহ বলুন। কারণ বর্তমান সমাজে চলমান মারাত্মক একটি ফিৎনা থেকে আপনি এখনো হেফাজত আছেন, আল্লাহ যেন ভবিষ্যতে হেফাজত রাখেন।

তিন.
পর্নোগ্রাফি হচ্ছে এমন অশ্লীল সিনেমা যেখানে যৌন সম্পর্কের ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। এটি খুবই একটি খারাপ কাজ। এটাযে খারাপ, এব্যাপারে সবাই ঐক্যবদ্ধ। কারণ এটা কেউ প্রকাশ্যে করে না। কয়েক বছর পূর্বে এটা সিডি ভিসিডি ক্যাসেট পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন ইন্টারনেটের সহজ লভ্যতা আজ এ সমস্ত ভিডিওকে পকেটের ইন্টারনেট সংযোজিত মোবাইল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। ব্যবহারকারীর একটু খারাপ ইচ্ছাই তাকে নরকের এ দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে।

কেউ এ ব্যাপারে অবগত হচ্ছে চরিত্রহীন কোনো সহপাঠী বা বন্ধুর মাধ্যমে আবার কখনো এপসে বা ওয়েবসাইটে ঘুরে বেড়ানো লিংকে ক্লিক করে পরিচয় হচ্ছে চরিত্রহীন হওয়ার এ মাধ্যমের সাথে। মোবাইল স্কিনের কয়েকটি টাচ অথবা কম্পিউটারের মাউস আর কী-বোর্ডের কয়েকটি ক্লিক আপনাকে পৌঁছে দেবে অন্ধকারের অথল গহ্বরে।

আমার দৃষ্টিতে পর্নোগ্রাফি চরিত্রবানের চরিত্র ধংসের জন্য অসৎ চরিত্রবানের পক্ষ থেকে ছোড়া ডিনামাইট। যা চরিত্র ধংসের অন্যতম উপাদান।

পর্নোগ্রাফি নেশা দ্রব্যের ন্যায় কিন্তু এর ক্ষতির পরিমাণ নেশা দ্রব্যের চেয়েও বেশি। ইহা দর্শকদের ক্ষণিকের জন্য মোহগ্রস্থ করে অতঃপর বারংবার তার দিকে টানে। পৌঢ়, যুবক এমনকি বর্তমান সমাজের কিশোরেরাও মারাত্মক সংক্রমক এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। স্কুল কলেজ এমনকি বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মাঝেও এই ব্যাধি সোবল মারছে। আক্রান্ত হচ্ছে অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তিবর্গের সন্তানেরাও। আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না এমন এমন মানুষও এ অবৈধ চিত্রের দর্শক যাদের সৎ চরিত্রের ব্যাপারে আপনার ধারণা আকাশ চুম্বি। এটা সবার জন্য সম্ভব কারণ এটা লুকিয়ে করা যায়। কেউ দেখে না। রুমের ভেতর দরজা বন্ধ করে দেখা যায়। লোক লজ্জার ভয় নেই।

কিন্তু কেউই ভাবে না এর ক্ষতির পরিমাণ কত বেশি।
সমাজে নারী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, সমকামিতা ও অবৈধ যৌনচার হঠাৎ করেই বেড়ে যাওয়ায় কারণ সম্পর্কে কখনো ভেবে দেখেছেন? আমাদের দেশের সংস্কৃতি তো এমন ছিল না। হঠাৎ করে কেন সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে বেহায়াপনা আর উলঙ্গপনার হিরীক পড়ল?

পর্নোগ্রাফি অনেক দর্শক ভাবেন আমি তো কারো ক্ষতি করছি না। কয়েক মিনিটের কিছু চলচ্চিত্র দেখে নিজের যৌন কামনাকে উপভোগের চেষ্টা করছি। প্রিয় ভাই/বোন- আমি বলি এটা হল শয়তানের প্রধান অস্ত্র আপনাকে এর মধ্যে ডুবিয়ে রাখার জন্য। আপনি অবশ্যই ক্ষতি করছেন।

পর্নোগ্রাফি ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে পরবর্তীতে আরেকটি প্রবন্ধ লিখব ইনশাআল্লাহ।

চার.
সমাজে বিচ্যুতি ঘটলে এ সম্পর্কে ধর্মীয় সচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব আলেমের এবং সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির দায়িত্ব সমাজের যোগ্য নেতৃবৃন্দের। অথচ এ ব্যাপারে সবাই নীরব। সকল ধর্মেরই। দুই একজন মাঝে মধ্যে কথা বললেও তা অসম্পূর্ণ। কিন্তু পর্নোগ্রাফির অবৈধতা সকল ধর্মের হুকুমেই। এ ব্যাপারে কথা বলাকেও অশ্লীল মনে করছেন। এর ফাঁকে সমাজের অসংখ্য সদস্য অমানুষ হওয়ার এ পথে চলা শুরু করেছে।

অনেক অভিভাবক এ ব্যাপারে বে-খবর। আপনার সন্তানের প্রতি বা ছোট ভাইয়ের প্রতি অগাধ বিশ্বাস। যুগের সাথে তাল মেলাতে হাতে মোবাইল দিয়েছেন। ভালবেসে লেপটপ বা ডেস্কটপ কিনে দিয়েছেন। ভার্চুয়াল জগতে ঘুরে বেড়াতে দিয়েছেন ইন্টারনেট সংযোগ। কিন্তু একবারও খবর রাখছেন কি? এগুলো কিসে ব্যবহার করছে? উপকারী কাজে নাকি অপকারে?

পাচ.
এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজও হচ্ছে না। বাংলাদেশে আমার জানা মতে লস্ট মডেস্টি নামক একটি ব্লগ কর্তৃপক্ষের নিরলস ভাবে করে যাওয়া কাজ ব্যতীত আর কোনো উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউবে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ায় পিএইচডি গবেষণা রত মিজানুর রহমান আজহারী ভাইয়ের মোটামুটি তাত্ত্বিক একটি আলোচনা ব্যতীত আর তেমন কোনো কন্টেন্ট নেই।

লস্ট মডেস্টি নামক ব্লগের উল্লেখযোগ্য কিছু প্রবন্ধ সংকলন ‘মুক্ত বাতাসের খুঁজে’ নামক বইয়ের ভূমিকায় পড়ে ছিলাম- যদিও পর্নোগ্রাফি আমাদের ঘরে ঘরে ঢুকে পড়েছে কিন্তু এখনো পর্নোগ্রাফি নিয়ে কথা বলা আমাদের সমাজে ট্যাবু। পর্নোগ্রাফি নিয়ে কথা বলা “অশোভন”, “অশ্লীল”। হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়া পর্নোগ্রাফি “আকাশ সভ্যতার অংশ” হলেও, পর্নোগ্রাফির ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে আলোচনা “সভ্য আলাপচারিতার জন্য অনুপযোগী”।

অপ্রিয় সত্যকে স্বীকার করে নেয়ার বদলে আধুনিক মানুষ আগ্রহী সত্যকে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা করতে। অকপট স্বীকারোক্তির জায়গা দখল করে নিয়েছে বাস্তবতার এমন কোনো সংস্করণ খুঁজে নেয়ার চেষ্টা, যা স্বীকার করে নিলে জীবন, সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে অপ্রিয়, অস্বস্তিকর, বিপজ্জনক কিংবা মৌলিক প্রশ্ন করতে হয় না। বাস্তবতার এ সংস্করণ আদৌ কতটুকু সত্য, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না।

চোখ বন্ধ করে হলেও স্থিতাবস্থাকে (staus quo) টিকিয়ে রাখা মুখ্য। চারপাশ ঘিরে আসা জমাটবাঁধা নীল অন্ধকার যখন আমাদের পূত-পবিত্র জীবনে উঁকি দেয়া শুরু করে, দেখেও না দেখার ভান করি। প্রশ্ন করি না, চিন্তা করি না। পরিবর্তনের অস্বাচ্ছন্দ্যকর পথে হাঁটার বদলে মনমতো ব্যাখ্যা খুঁজে নিয়ে অন্ধকারের গহ্বরে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবার নিষ্ক্রিয় অপেক্ষা আমাদের পছন্দ। আর তাই আমরা আত্মপ্রতারণা করি, নিজের সাথে মিথ্যা বলি।

আসুন চরিত্র ধংসের এ মারাত্মক পথ সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করি। ক্ষয়ে যাওয়া সমাজকে রক্ষা করি। আজ এ পর্যন্তই। নিজে সচেতন হই, অপরকে সচেতন করি।
(চলবে)

-শেখ ওয়ালিদ আল হামিদী
ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মদীনা,
সৌদি আরব।