পর্দার শরয়ী সীমারেখা ও প্রজেক্টরের মাধ্যমে ভিডিও ওয়াজ দেখা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ১২ ২০২০, ০০:৪২

মুফতি সৈয়দ নাছির উদ্দীন আহমদ

পর্দা করা নারী পুরুষ উভয়ের জন্য খোদা প্রদত্ত অপরিহার্য একটি বিধান।বিশেষ করে নারী জাতির ইজ্জত সম্মান ও সম্ভ্রম সংরক্ষণের জন্য পর্দার গুরুত্ব অপরিসীম।

ইসলামি শরিয়াহ দৃষ্টিতে এবং কুরআন সুন্নাহর শিক্ষার আলোকে মেয়েদের হিজাব ও পর্দার বিধান কী? মেয়েদের জন্য পর্দা জরুরী কেন?

ঐসমস্ত প্রশ্নের উত্তর তখনই বুঝে ওঠা সম্ভব যখন এই কথাটি বুঝে আসবে যে, এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ পাক কেন মেয়েদেরকে সৃষ্টি করলেন এর মৌলিক উদ্দেশ্য কী?

সূরা আহযাব আয়াত –৩৩ অর্থাৎ আল্লাহ পাক স্বীয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর সম্মানিতা স্ত্রীগণকে সরাসরি সম্বোধন করে বলতেছেন, তোমরা নিজ নিজ ঘরে স্থির থাক ।

এই আয়াতে শুধু এতটুকু বলা হয়নি যে,মেয়েদেরকে প্রয়োজন ছাড়া বাহিরে যাওয়া উচিত নয় বরং এই আয়াতে একটি মূল তত্ত্বের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নারীকে এজন্য সৃষ্টি করা হয়েছে,নারীরা ঘরের মধ্যে স্থির থেকে বাড়ীর কাজের আয়োজন করবে ।

সে হিসেবে মানুষের জীবন দুটি ভিন্ন বিভাগে বিভক্ত ।

এক: বাড়ীর ভিতরের অংশ যার দায়িত্ব আল্লাহ ও তাঁর রাসূল(সা:) মেয়েলোকের কাধে অর্পণ করেছেন ।

দুই: বাড়ীর বাহিরের অংশ যার দায়িত্ব মহান আল্লাহ পাক মানুষকে দিয়েছেন ।

তারা রুজি রোজগার ও অর্থ উপার্জন,রাজনৈতিক ও সামাজিক কাজ গুলো আন্জাম দিবে ।খোদা প্রদত্ত নারী পুরুষের কর্ম বন্টনের উপরোক্ত পদ্ধতির বিকল্প নেই ।কারণ যদি বিবেক দ্বারা মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাবের পর্যালোচনা করা হয় তাহলেও এ ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থা হতে পারেনা। এদিক নিয়ে এখানে আলোচনা করতে যাচ্ছি না ।

তবে বর্তমান যুগে নারীদের পর্দার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।তাই নারীর পর্দা সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করছি।

প্রথমত আমরা শরয়ী পর্দার স্তর নিয়ে আলোচনা করবো।কুরআন ও হাদীসে যে পর্দার আদেশ দেয়া হয়েছে উহার তিনটি স্তর । এগুলো কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এর মধ্যে কোন স্তর বাতিল হয়নি । তবে অবস্থার প্রেক্ষাপটে ভিন্ন ভিন্ন স্তরের বিধান নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে।

প্রথম স্তর: নারী ঘরের মধ্যে থাকবে এবং প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হবেনা।নিজের শরীর,পোশাক এবং প্রকাশ্য ও গোপন সৌন্দর্যের কোন অংশ,চেহারা,হাতের তালু ইত্যাদি পরপুরুষের দৃষ্টিগোচর থেকে বাঁচিয়ে রাখা ।

সুরা আহযাব আয়াত ৩৩ এতে স্পষ্ট যে, এই নির্দেশ রাসুল(সা:) এর স্ত্রীদের জন্য খাস ছিলনা। অর্থাৎ প্রতিটি নারীকে তার ঘরেই অবস্থান করতে হবে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ(রা:) থেকে বর্ণিত, হুজুর(সা:) বলেছেন,নারী লুকানোর বস্তু । যখন সে বাইরে যায় শয়তান তার দিকে উঁকিঝুঁকি মারে।(মুসনাদে বাযযার, হাদীস : ২০৬১)

এজন্য হযরত আয়েশা(রা:) থেকে দীর্ঘ হাদীসে শেষের অংশে বলা হয়েছে নারীরা বাড়ীর বাইরে যাওয়ার অনুমতি প্রয়োজনের সাথে সীমাবদ্ধ । প্রয়োজন ব্যতীত নারীরা আপন ঘরেই থাকবে ।(সহীহ মুসলিম হাদীস নম্বর ২১৭০)

পর্দার দ্বিতীয় স্তর : নারীর প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে নারী অবশ্যই বোরকা অথবা চাদর দ্বারা নিজেকে এভাবে আবৃত করবে যেন তার শরীরের কোন অংশ প্রকাশিত না হয় ।

সূরা আহযাব ৫৯ নম্বর আয়াতে তাফসীর করতে গিয়ে আল্লামা ইবনে জারির তবারী(রাহ:) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস(রা:) থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেন, আল্লাহ পাক মুমিন নারীদেরকে এই আদেশ দিয়েছেন যে,যখন তারা কোন প্রয়োজনে বাড়ীর বাইরে যাবে তখন চাদর দ্বারা নিজের চেহারা মাথার উপর দিয়ে ঢেকে নিবে এবং শুধু চোখ খোলা রাখবে ।(তাফসীরে ইবনে জারির ২২/৪৬)

পর্দার তৃতীয় স্তর: একজন নারী বাড়ি থেকে বের হবার সময় তার সমস্ত শরীর মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা থাকবে ।ফিতনার আশঙ্কা না থাকলে প্রয়োজনে চেহারা ও হাতের তালু খুলতে পারবে । ফিতনার আশঙ্কা হলে খুলতে পারবেনা ।

সূরা নূর ৩১ নম্বর আয়াতে নারীদেরকে দৃষ্টিকে নত রাখতে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাজত করতে আদেশ করা হয়েছে।

পাশাপাশি সাধারণত প্রকাশমান তথা দুই হাতের তালু ও চেহারা,তাছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করতেও বলা হয়েছে।

সূূূূরা নূরের এই আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনে কাছির(রাহ:) বলেছেন,নারী পরপুরুষের সামনে নিজ সৌন্দর্যের কোন অংশ প্রকাশ করবেনা যে অংশ গোপন করা অসম্ভব উহা ব্যতীত ।

উপরোক্ত পর্দার তিনটি স্তরের মধ্যে আসল হচ্ছে প্রথম স্তর তথা নারীকে নিজের ঘরে অবস্থান রাখবে । কুরআন ও হাদীসে নবুবীর মাধ্যমে নারীর প্রতি এই নির্দেশই দেয়া হয়েছে যে,বিনা প্রয়োজনে নিজ ঘৃহ থেকে বের হতে পারবেনা ।

যদি কোন প্রয়োজনে বাড়ীর বাইরে যেতেই হয় তাহলে সে অবশ্যই শরয়ী বোরকা অথবা চাদর দ্বারা নিজ চেহারা ঢাকবে,চেহারা খোলা রাখবেনা। তবে দুই অবস্থা উহা থেকে ভিন্ন ।

এক: চেহারা খোলার এমন প্রয়োজন হয় যে,চেহারা ঢাকলে ক্ষতি হতে পারে।যেমন: ভিড়ের মধ্যে চলার সময় অথবা অন্য কোন প্রয়োজনে যেমন স্বাক্ষ্য ইত্যাদি দেয়ার সময় ।

দুই : কাজ কর্মের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে চেহারা খুলে যাওয়া । তবে উভয় অবস্থায় পুরুষের প্রতি নির্দেশ হল তারা তখন দৃষ্টি নত রাখবে ।(তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম ৪/২৬১)

তাছাড়া নারীরা যে সমস্ত পুরুষদের সাথে পর্দা করা ফরজ তাদের মধ্য থেকে কারো চেহারা দেখা মুলত জায়েয নয় । সরাসরি হোক কিংবা কোন প্রযুক্তির মাধ্যমে হোক । কেননা গায়রে মাহরাম তথা বেগানা পুরুষের দিকে দৃষ্টিপাত করা থেকে মহান আল্লাহ নিষেধ করেছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন, হে নবী! মুমিন নারীদের বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টি অবনত রাখে। … সূরা নূর :৩১

হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ (রা.)হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,হঠাৎ দৃষ্টি পড়ে গেলে করণীয় কী- এব্যাপারে আমি রাসূলুল্লাহ(সা:) কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি আমাকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে আদেশ করলেন।(সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২১৫৯)

উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামা (রা.) বলেন,আমি একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ছিলাম।

উম্মুল মুমিনীন মায়মুনা (রা.) ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এমন সময় আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম উপস্থিত হলেন। এটি ছিল পর্দা বিধানের পরের ঘটনা।

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,তোমরা তার সামনে থেকে সরে যাও । আমরা বললাম, তিনি তো অন্ধ, আমাদেরকে দেখছেন না?!

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরাও কি অন্ধ? তোমরা কি তাকে দেখছ না? (সুনানে আবু দাউদ ৪/৩৬১, হাদীস : ৪১১২; জামে তিরমিযী ৫/১০২, হাদীস : ২৭৭৯)

বর্ণিত হাদীসের মাধ্যমে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, গায়রে মাহরাম পুরুষ নারীকে না দেখলেও নারী তাকে দেখতে পারবেনা ।

তবে বর্তমান প্রযুক্তির তৈরি ইউটিউব,টিভি চ্যানেল প্রজেক্টর ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলামি স্কলারদের ভিডিও বক্তব্য নারীরা দেখতে পারবে কি না এব্যাপারে কথা হল এই যে,পর্দার ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মাঝে ক্ষাণিক পার্থক্য আছে।

যেমন আকৃষ্টতা থাকুক বা না থাকুক কোন অবস্থাতেই শরয়ী ওজর ছাড়া পুরুষদের জন্য গায়রে মাহরাম নারীদের দিকে তাকানো জায়েজ নয় । কিন্তু নারীদের বেলায় দুই সূরত ।

১.আকৃষ্ট হবার শংকা নিয়ে পুরুষের প্রতি দৃষ্টিপাত করা।

২.আকৃষ্ট হবার শংকা নেই এ অবস্থায় তাকানো ।

প্রথম সূরতে নারীদের জন্য পর-পুরুষের দিকে তাকানো জায়েজ নয় । তবে দ্বিতীয় সূরতে শর্ত সাপেক্ষে জায়েজ যদিও তা উত্তম নয় ।

সুতারাংপ্রজেক্টর ইত্যাদির মাধ্যমে ইসলামি স্কলারদের ভিডিও দেখে বক্তব্য শোনা ঐ নারীর জন্য বৈধ,যার আকৃষ্ট হবার শংকা বা সম্ভাবনা নেই নিশ্চিত।কিন্তু যদি আকৃষ্ট হবার শংকা থাকে, তাহলে এভাবে দেখে বয়ান শোনা কিছুতেই জায়েজ হবে না । (কিতাবুল ফাতওয়া-৬/১০১)

তাই উত্তম হলো আকৃষ্ট হবার শংকা না থাকলেও প্রজেক্টর ইত্যাদির মাধ্যমে নারীরা গায়রে মাহরাম তথা বেগানা পুরুষের ভিডিও ওয়াজ সহ ইসলামিক অনুষ্ঠান না দেখা ।