পবিত্র মসজিদ ও আমাদের দায়বদ্ধতা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জুলাই ২৫ ২০১৯, ২২:৪১

মাওলানা জুনাইদ আহমদ জুনেদ

সবুজের সমারোহে ঘেরা এক গ্রামে দূর অতীতে একটি অবহেলিত মসজিদ ছিল! মসজিদটি ছিল কাঁচা মাটির তৈরী। একেবারে ছোট্ট একটি কুঁড়েঘরের মত। এর আশেপাশে ছিল বহু সংখ্যক লোকজনের বসবাস।

কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, তাদের প্রায় কেউই মসজিদে নামাজ পড়তে আসতোনা! মসজিদের পাশের বাড়ীতে একজন মুন্সী সাহেব বাস করতেন। শুধু ঐ মুন্সি সাহেবকেই দেখা যেত মসজিদে যাতায়াত করতে। অন্য কেউ না গেলেও প্রত্যেক নামাজের সময়ই উনি নিজ দায়িত্বে আযান দিতেন এবং নামায পড়তেন।

এমনকি নামাজের সময় ছাড়াও অবসরের পুরোটা সময়ই উনি মসজিদের দরজার পাশে বসে বসে দিনের আলোয় কোরআন তিলাওয়াতে মশগুল থাকতেন।

এভাবে চলতে থাকে অনেক দিন,অনেক মাস এমনকি অনেক বছর! একসময় মুন্সী সাহেব মারা যান! উনার মৃত্যুটা হয়েছিল খুব চমৎকার মৃত্যু। ঈদুল ফিতরের দিন। উনার ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনীরা উনার পাশে বসে তিলাওয়াত ও দোয়া দুরুদ করা অবস্থায় স্পষ্ট হাসিমুখে হয়েছিল উনার ইন্তিকাল! ধারণা করা হয়, মসজিদের সাথে গভীর সম্পর্কের বদৌলতে উনার এতো চমৎকার মৃত্যু হয়েছে! মুন্সী সাহেবের ইন্তিকালের পর মসজিদটি একেবারে মুসল্লি শূণ্য হয়ে পড়ে!

কেউ তার ধারে কাছে যায়না। পরিচর্যা করেনা!এভাবে থাকতে থাকতে মসজিদটি হয়ে যায় একটি পরিত্যক্ত কুঁড়েঘরের মত! এভাবে কেটে যায় অনেক দিন। সেসময় মসজিদের আশ পাশের লোকজনের উপর নেমে আসে বিভিন্ন পেরেশানি ও দরিদ্রতা। কোন কাজেই কেউ সফলতার মুখ দেখেননি। পদে পদে শুধু অভাব অনটন আর দুঃখ দুর্দশা! তখন সমাজের কতিপয় লোকজন ধারণা করেন যে, মসজিদকে অবহেলা করার ফলশ্রুতিতেই বোধয় এমনটা হচ্ছে!

বিষয়টি অনুমান করতে পেরে আবার মসজিদের সাথে তারা সম্পর্ক গড়ে তুলেন। নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করা শুরু করেন। তখন মসজিদটির পানে তাকালে মনে হত যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। কিন্তু তারাও বেশিদিন টিকে থাকতে পারেননি! শয়তানের প্ররোচনায় তারা দুনিয়াবি কাজের ব্যস্ততায় পড়ে আস্তে আস্তে মসজিদে যাওয়া বন্ধ করে বসেন!

একসময় আবারো আগের মত মসজিদটি বন্ধ হয়ে যায়! দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত অবস্থায় মসজিদটি পড়ে থাকতে থাকতে ফের কয়েকজন আল্লাহর বান্দা মসজিদটি পরিস্কার করে নামাজ পড়া শুরু করেন। কিন্তু মুসল্লি একেবারেই নগণ্য! বেশীরভাগই শুধু একজন স্থানীয় মৌলভী সাহেব একা-একা নামাজ পড়তেন। কেউ ধারে কাছে আসতোনা। এভাবেই চলছিল মসজিদ। হঠাৎ একদিন প্রবল ঝড় তুফান শুরু হয়। আর তুফানের ঝাপটায় কাঁচামাটির তৈরী মসজিদটির অর্ধেক ভেঙ্গে পড়ে যায়। এবং এভাবে আরো কিছুদিন চলে যায়। এরপর মসজিদের আশ পাশের কয়েকজন তরুণের ঈমান জাগ্রত হয়। তারা চিন্তা করে দেখলেন যে, এ মসজিদটি একটি প্রাচীন মসজিদ। এর পরিচর্যা করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। এ দায়িত্বে অবহেলা করলে আমরা আল্লাহর আদালতে দাঁড়িয়ে রেহাই পাবোনা! তাই তারা সবাই মিলে তাদের অভিভাবকদের দোয়া ও সহযোগিতা নিয়ে মসজিদের হাল ধরেন। ভাঙ্গা মসজিদকে মেরামত করে নামাজ পড়া শুরু করেন। তাদের মধ্যথেকেই একজন তরুণ আলেমকে ইমামতির দায়িত্বে নিয়োজিত করেন।

এবং চলতে থাকে নামাজ সহ দ্বীনের দাওয়াতি কার্যক্রম। তরুণদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নামাজ আদায় দেখে বৃদ্ধি পেতে থাকে মসল্লি। একসময় তরুণরা পরামর্শ করলেন, মসজিদটি কিভাবে উন্নত করা যায়(?) কিন্তু দরিদ্র অধ্যুষিত এলাকায় বিল্ডিং আকারে মসজিদ পুনঃনির্মাণের সিদ্ধান্ত নিতে তারা সাহস পাচ্ছিলেননা! তবে যেভাবেই হউক পুনঃনির্মাণ করতে হবে। তাই আপাতত বাঁশের খুঁটি দিয়ে টিনসেডের ঘর নির্মাণ করার পরিকল্পনা নিয়ে তারা এগুচ্ছিলেন। কিন্তু আল্লাহর দয়ায় কিছুদিনের ব্যবধানেই বিদেশী অনুদান ও তরুণদের প্রচেষ্টায় দেশীয় অনুদান মিলিয়ে প্রায় ১২ লক্ষটাকা ব্যয়ে চমৎকারভাবে শক্তিশালী বিল্ডিং আকারে মসজিদটিকে পুনঃনির্মাণ করা হয়। মসজিদ পুঃনির্মানের পর মসজিদের মুসল্লি সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায়। তাবলীগ জামাতের লোকজনও আসতে থাকেন।

তখন থেকে ঐ এলাকার অবস্থাও দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। বিশেষকরে সংশ্লিষ্ট সকলেরই অবস্থা দিন দিন উন্নত হতে শুরু করে। কিছুদিনের ব্যবধানেই তাদের অনেকেই কাঁচা ঘরের পরিবর্তে পাকা ঘর নির্মাণে সক্ষম হন। অনেকেই ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে লাভবান হতে শুরু করেন। অনেকেরই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সম্মান বাড়তে থাকে। এককথায় মসজিদের সাথে সুসম্পর্কের বদলার একটা অংশ যেন আল্লাহ তায়ালা দুনিয়াতেই দিয়ে দিয়েছেন! বিষয়টা সবাই আঁচ করতে না পারলেও সমাজের বিচক্ষণ ব্যক্তিগণ ঠিকই আঁচ করছিলেন। কিন্তু আফসোস! শত আফসোস!

এতোকিছু নিজের চোখে দেখেও তারা আল্লাহর দয়ার কথা ভুলতে বসেছেন! দুনিয়ার লোভ লালসায় আপাদমস্তক ডুবে গিয়ে প্রাণের মসজিদটিকে ভুলে যেতে শুরু করেছেন! যে মসজিদের সাথে আল্লাহর কুদরতি সম্পর্ক। যে মসজিদের সাথে সম্পর্ক থাকায় সম্পর্ককারীদের অতীত অবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হল। সেই মসজিদকে ভুলতে বসা কখনো জ্ঞানী লোকদের কাজ হতে পারে না। বর্তমানে ওখানকার ইমাম সাহেব নগণ্য সংখ্যক মুসল্লি নিয়ে নামাজ আদায় করে তাদের জন্য দোয়া করে যাচ্ছেন এবং আশংকা করছেন, মসজিদের সাথে সম্পর্ক বেশিদিন বিচ্ছিন্ন থাকলে আল্লাহর অসন্তুষ্টিতে তারা নিপতিত হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে যেতে পারেন ! আসুন আল্লাহর পবিত্র ঘর মসজিদকে আবাদ করি এবং মুসল্লিদের মসজিদমুখী করতে সম্মিলিতভাবে সার্বিকভাবে প্রয়াস চালাই। আল্লাহ সবাইকে শুভ বুদ্ধি এবং তাওফিক দান করুন।

লেখক : ইমাম ও  শিক্ষক