পতনের মুখে কাবুল : মার্কিনদের চোখে ভিয়েতনাম-বিভীষিকা

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ১৪ ২০২১, ১২:৫৯

নোমান বিন আরমান: সপ্তাহের শুরুতে আমেরিকা বলেছিলো, ৯০ দিনের মধ্যে তালেবানের হাতে কাবুলের পতন হতে পারে। আজ শুক্রবার তারা বলছে, এই পতন এক মাসের মধ্যেই হবে। এই সময় ফ্রেমের কথা সিআইয়ের ‘ইনটেলিজেন্স রিপোর্টের’ ভিত্তিতেই বলছিলেন মার্কিন কর্মকর্তারা। তবে তাদের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পুর্ভাবাসের চেয়ে দ্রুততম সময়ে মার্কিনজোট ও তাদের দোসরদের সাফাই করে তালেবানকে কবুল করতে যাচ্ছে কাবুল।

তালেবানের ইচ্ছের ওপর নির্ভর করছে কাবুল-জয়। তালেবানের জন্য সেটা আজকালের ব্যাপার মাত্র।

তালেবানের এমন অগ্রযাত্রায় হতভম্ব পুরো বিশ্ব। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে এটা, এই হিসেব কেউ মিলাতে পারছে না। দুই মাসের মধ্যে তালেবানকে ধুলোয় মিশেয়ে দিতে প্রথমে একাই এসেছিলো যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আফগানিস্তানের গিরিখাদে তারা আটকে গিয়েছিলো ২০ বছরের জন্য। এই বছর আফগানিস্তান ছাড়া শুরু করেছে তারা। তাদের বিবেচনা ছিলো, মার্কিন সেনারা আফগান ছাড়ার প্রস্তুতি নিলেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। এটাকে মোকাবেলা করে অন্তত বছর দুইয়ের আগে তালেবান কাবুল পৌছতে পারবে না। যেমনটা হয়েছিলো সোভিয়েত বিদায়ের পর। ততো দিনে গোল্ডফিশ মস্তিষ্ক ভুলে যাবে, আধুনিক সমরাস্ত্রে রিক্ত-নিস্ব তালেবানদের হাতে ‘সুপার পাওয়ার’ মার্কিনদের পরাজয়ের কথা। কিন্তু তাদের সব হিসেবকে এক ঝটকায় উড়িয়ে দিয়েছে তালেবান।

গত এপ্রিল থেকে নিয়ে জুলাই পর্যন্ত আফগানিস্তানের প্রায় ৯০ ভাগ এলাকা প্রায় বিনা বাঁধায় জয় করে নেয় তালেবানরা। এই জয়ে কাবুলে আশরাফ গনি প্রশাসনের ঘুম হারাম হলে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ‘সান্ত্বনা’ দিয়ে বলেছিলেন, আফগান প্রশাসনের ৩ লাখ প্রশিক্ষিত সেনার বিরুদ্ধে ৭৫ হাজার তালেবান কিছুই করতে পারবে না।

ওই সময় তালেবানের দোহা অফিসের কর্মকতারা মস্কো সফরে ছিলেন। সেখান থেকে তালেবান প্রতিনিধি দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা মৌলভী শিহাবুদ্দিন দিলওয়ার বলেছিলেন, তালেবানের জন্য কাবুল জয় দুই সপ্তার ব্যাপার মাত্র। এর দু’তিন দিনের মাথায় তালেবানের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করতে বি-৫২ বোমারু বিমান দিয়ে হামলা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এই হামলা ছিলো দোহা চুক্তির সম্পূর্ণ লঙ্ঘন। প্রকাশ্য এমন চুক্তি লঙ্ঘন করায় তালেবান বিস্মিত না হলেও একটা জবাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু নিজেরা কোনোভাবেই চুক্তি লঙ্ঘন করে পাল্টা হামলার পথে হাঁটেনি। যদিও তাদের এই সামর্থ ও নৈতিক ভিত্তি ছিলো।

তালেবান তখন আমেরিকাকে হাতে না মেরে, অপমানে মারার পথ বেছে নেয়। সেটা হলো, মার্কিন সেনাদের চোখের সামনেই কাবুল জয় করে নেওয়া। এবং সেটা যে করতে সক্ষম এই জানানও তারা ইতোমধ্যে দিয়েছে।

৫ আগস্ট থেকে তালেবানরা আফগানিস্তানের প্রদেশগুলো বিজয় অভিযান শুরু করে। ওই দিন তারা নিমরুজ প্রদেশর রাজধানী যুরনাজ জয় করে নেয়। ৬ আগস্ট জয় করে জুরযান প্রদেশের রাজধানী শেবারগান। ৭ আগস্ট জয় করে কুন্দুজ ও সারপুল। এই দুই প্রদেশের রাজধানীও একই নামে। ৮ আগস্ট জয় করে তাখার প্রদেশের রাজধানী তালকান। ৯ আগস্ট জয় করে সামনিগান প্রদেশের রাজধানী আইব্যাক। ১০ আগস্ট থেকে জয়ের সংখ্যা অবিশ্বাস্যহারে বাড়তে থাকে। ওই দিন তালেবান ৩টি প্রদেশের রাজধানী জয় করে নেয়। সেগুলো হলো, ফারাহ (রাজধানী ফারাহ, বাগলানের রাজধানী পুলখামরি, বাদাখশানের রাজধানী ফায়জাবাদ। ১২ আগস্ট জয় করে চারটি প্রদেশের রাজধানী। সেগুলো হলো, গাজনী, হেরাত, বাদগিস (রাজধানী কিলয়াহ নু), হেলমন্দ (রাজধানী লস্করগাহ) ও কান্দাহার। ১৩ আগস্ট জয় করে নেয় ৬টি প্রদেশ। সেগুলো হলো, গাওর (রাজধানী ফিরোজগাহ), লাওগড় (রাজধানী পুল আলম) জাবিল (রাজধানী কিলাত), উরজুকান (রাজধানী তারিনকুত) এবং উরদুখ ও পাখতিয়া। উরদুখ হলো একদম কাবুল লাগোয়া প্রদেশ। এখান থেকে কাবুলের দূরত্ব মাত্র ৩০ মাইল।

গনি প্রশাসনের হাতে এখন মাত্র ১৪টি প্রদেশ রয়েছে। এরমধ্যে কাবুল ছাড়া কোথাও তাদের প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই। মার্কিন জোট খুব করে চেয়েছিলো, এখনও চাচ্ছে আফগানে গৃহযুদ্ধ হোক। সেটা হবার বিন্দুমাত্র কোনো সম্ভাবনা আর নেই। সুপার পাওয়ারকে পরাজিত করে তালেবানই হয়ে উঠেছে আফগানের মুখ। এই মুখের মুখোমুখি হওয়ার শক্তি আর এখন কারও মধ্যে নেই।

বিভিন্ন গোত্র ও গোষ্টি দিয়ে তালেবানকে মোকাবেলা করার মার্কিনজোটের যে স্বপ্নস্বাদ ছিলো সেটি ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। বড় একটা সম্ভাবনা ছিলো হেরাতের সাবেক গভর্নর ও তালেবান বিরোধী নেতা ইসমাইল খান অন্তত কিছুটা প্রতিরোধ করবেন। এতোদিন তিনি মাঠ পর্যায়ে তার মিলেশিয়া বাহিনী নিয়ে বেশ দৌড়ঝাপও দিয়েছেন। কিন্তু গত সপ্তাহে তালেবান তার বাড়ি কব্জায় নেওয়ার পর আজ তাকেও গ্রেপ্তার করেছে। তবে গ্রেপ্তারের পর তিনি বিরোধিতা প্রত্যাখান করে তালেবানকে সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সবশেষ রয়ে গেছেন তালেবানের কট্টর বিরোধী আবদুর রশিদ দোস্তম। কিন্তু শেবারগানে দোস্তমের রাজকীয় বাড়ি দখলে নিয়ে তালেবান আগেই তার কোমর ভেঙে দিয়েছে।

এই অবস্থায় এখন মার্কিনজোট, তাদের মিত্র ও সহযোগী গাদ্দারদের আর পালানোরও যেনো সময় নেই। তালেবান এখন একদমই কাবুলেরে দোরগোড়ায় রয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে কাবুল জয় করে নিতে পারে। প্রাণ নিয়ে পালাতে তাই নতুন করে পেন্টাগন ৩ হাজার সেনা পাঠাচ্ছে কাবুলে। তাদের সঙ্গে ব্রিটেনও পাঠাচ্ছে ৬শ’ সেনা। এরা সকলে মিলে কাবুলে হামিদ কারজাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টকে পলায়নরতদের জন্য নিরাপদ রাখতে কাজ করবে। এদের সাপোর্টের জন্য কাতারে মার্কিন ঘাঁটিতে পাঠানো হচ্ছে আরও এক হাজার সেনা। পাশাপাশি জরুরি প্রয়োজনে প্রস্তুত থাকতে কুয়েতে রিজার্ভ রাখা হচ্ছে আরও চার হাজার সেনা। এতো প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে শুধু পলায়নকে নিরাপদ রাখতে।

পেন্টাগানের এই পলায়ন প্রস্তুতি দেখে সারাবিশ্বেই মার্কিনদের নিয়ে ব্যাপক ‘মজা নেওয়া’ হচ্ছে। আলোচনায় আসছে ১৯৭৫ সালে ভিয়েতনাম থেকে তাদের এমন নির্লজ্জ পলায়নের কাহিনিও। বলা হচ্ছে, সেখানে তো উঁচু ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে সামরিক হেলিকপ্টারে করে নিজেদের লোকদের সরিয়ে নিতে পেরেছিলো। কাবুল থেকে হয়তো সেটারও সুযোগ মার্কিনরা পাবে না। মার্কিনেদের ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা কাবুলে আরও বিভীষিকার হতে চলেছে বলে স্বীকার করছেন মার্কিন শীর্ষ রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা মিচ ম্যাকনেল।

কাবুলে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের দূতাবাসের প্রায় ৮ হাজার কর্মীরা এখন প্রস্তানের প্রহর গুণছে। দেখা যাক, কাবুল থেকে তারা কীভাবে পলায়।