নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত নানা কর্মকাণ্ডে লিপ্ত বেফাক মহাসচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ১৪ ২০২০, ০৮:৩৯

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট: বাংলাদেশের কওমী মাদরাসাগুলোর শীর্ষ বোর্ড ‘বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ’ নিয়ে বেশ কয়েক বছর যাবত বেশ আপত্তিকর মন্তব্য উঠে আসছে। বিতর্কিত কাউন্সিলসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন বোর্ডটির মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মুফতী আবু ইউসুফ ও আলোচিত সাহেবজাদা আনাস মাদানী।

সম্প্রতি সোস্যাল মিডিয়া জুড়ে মহাসচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দুটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ পেয়েছে। বিগত বছর ফজিলত জামাতের পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটলে অনেক শিক্ষার্থী পরীক্ষা না দিয়ে চলে যায় বাড়িতে। তাই এবছর বোর্ড কর্তৃক সে সকল ছাত্ররা দাওরায়ে হাদীসের পরীক্ষা দিতে পারবে না বলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বেফাক।

১০ জুলাই বেফাকের মহাসচিব আব্দুল কুদ্দুস ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবু ইউসুফের একটি অডিও ক্লিপ প্রকাশ পেয়েছে, যেখানে তারা দুজন বেফাকের নীতি বহির্ভূত নানা অপকর্মে নিয়োজিত প্রমাণ পাওয়া যায়। এরপর সোস্যাল মিডিয়া জুড়ে তাদের পদত্যাগের দাবী উঠলেও এখনও পর্যন্ত তারা কোন ধরণের বিবৃতি দেননি। বরং তাদের এই ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য মাওলানা মাহফুজুল হকের নামে ভুয়া ৭লক্ষ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তুলে ধরে। তৎক্ষণাৎ বেফাক মহাপরিচালক মাওলানা যোবায়ের আহমদ চৌধুরী ‘মাহফুজুল হক নির্দোষ’ এই মর্মে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। তবে ভাবনার বিষয় হলো, মহাসচিব ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের ব্যাপারে তিনি নিশ্চুপ।

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ফরিদাবাদ মাদরাসার মুহতামিম ও শাইখুল হাদীস হওয়ার পাশাপাশি গৌরিপুরের এক প্রতিষ্ঠানের মুহতামিম ও শাইখুল হাদীসের পদে রয়েছেন বেফাক মহাসচিব মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস। দরসের ক্ষেত্রে ‘বুখারী আওয়াল’ কাগজে কলমে তার নামে লেখা থাকলেও মাঝে মধ্যে গিয়ে সবক পড়িয়ে আসেন তিনি ও ফরিদাবাদের নায়েবে মুহতামিম নূরুল আমীন। বাকীটা পড়ায় তার একান্ত শিষ্য আব্দুল হান্নান।

মুহতামিম হিসাবে তার রয়েছে নিয়মিত আলাদা বেতন ভাতা, তাছাড়া যখন যান তখন কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা রাহ খরচ সম্মানী দেয়া হয় প্রত্যেককে, এর বাহিরে রয়েছে প্রাইভেট গাড়ী ভাড়া ভাউচার আলাদা মঞ্জুর করা।

সেখানের শিক্ষকদের মাত্র ২ জন ছাড়া বাকী সবাই ফরিদাবাদের। ফরিদাবাদ ছাড়া অন্য মাদরাসা থেকে যেই আসুক, থাকুক, তাকে গোলামীর জীবন বরণ করেই থাকতে হয়। অন্যায় ও জুলমের প্রতিবাদ করায় চাকুরী হারাতে হয়েছে অনেক যোগ্য উস্তাযের। এ যেন এক পারিবারিক গোরস্থান, অন্য কোন পরিবারের লাশ দাফন করা নিষিদ্ধ।

বেফাকের প্রশ্ন ফাঁস : এটা গতবারের ঘটনা নয়, তার আগের বারের। অর্থাৎ ২০১৮ সালের বেফাক পরীক্ষার ঘটনা। ২০১৯ তো সারা দেশে হইচই পড়েছে কিন্তু ২০১৮ সালের বেফাক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি চমৎকারভাবে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে।

২০১৮ সালে গৌরীপুরের মেশকাতের কিছু ছাত্র মিলে রাতে প্রশ্নপত্রের রুমে ঢুকে মেশকাতসহ একাধিক জামাতের প্রশ্নপত্রের ছবি তুলে নিয়ে যায়। যা তারা তাদের কাছের লোকদেরকে দিয়েছে এবং বিক্রিও করেছে।

প্রশ্ন নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন মাদরাসার নাজেমে তা’লীমাত বেফাক মহাসচিবের একান্ত আস্থাভাজন মুফতী আব্দুল হান্নান। এ ঘটনা ছাত্ররা নিজেরা ঘটিয়েছে নাকি ঘটানো হয়েছে সেটা সচেতন পাঠক নির্ণয় করবেন। যেহেতু কোন তদন্ত হয়নি তাই জানা নেই।

তাদের এই ঘটনা ফাঁস হয়ে গেলে নাজেম সাহেব ছাত্রদের উপর ‘অপবাদ’ দেয়ায় মেশকাতের সব ছাত্র আর পরীক্ষা দিবে না সংকল্পে রাতের আঁধারে মাদরাসা ত্যাগ করেছে। তারপর সকাল থেকে নাজেমে তা’লীমাত ফোন করে ছাত্রদেরকে বুঝিয়ে শুনিয়ে সবাইকে পরীক্ষার হলে আনতে আনতে সময় তখন ১০ টা ৪৫।

অথচ পরীক্ষা শুরু সকাল ৯.০০ টায়। ওদিকে মহাসচিবের সাথে সার্বক্ষণিক চলছে যোগাযোগ। মহাসচিব বলেছেন ছাত্রদেরকে যে কোন উপায়ে আনিয়ে পরীক্ষা দেয়ানোর জন্য। তারপর ‘সুষ্ঠুভাবে’ এই ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়। সকল ছাত্রই অত্যন্ত সুন্দরভাবে পরীক্ষা দেয় সেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রে। এটা এখনো ওই মাদরাসায় স্বীকৃত ঘটনা। শুনা যায়, এটা তখন ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল মরহুম আশরাফ আলী সাহেবের মাধ্যমে। তাকে কি বুঝিয়েছিল কে জানে!

অডিও ক্লিপের ঘটনা: ২০১৯ সালের পরীক্ষায় সেই মাদরাসার মেশকাতের অধিকাংশ ছাত্র পরীক্ষা দেয়নি, কারণ পরীক্ষা দেয়ারই উপযুক্ত নয় এমন দুর্বল ছাত্র এরা। অল্প কয়েকজন মাত্র বেফাকে পরীক্ষা দিয়েছে।

গত শনিবার (১১জুলাই) রাতে নতুন করে বেফাকের নিয়ন্ত্রক মাওলানা আবু ইউসুফ ও আল্লামা আহমদ শফীর পুত্র আনাস মাদানীর ৩মিনিট ১০সেকেন্ডের কথপোকথনের অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়। সেখানে আবু ইউসুফ আহমদ শফী পুত্রের নিকট বর্তমান বেফাকের খাস কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আকুতি মিনতি করেন। মুফতি ওয়াক্কাস, মাওলানা জুবায়ের চৌধুরী, মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন রাজু, মরহুম শাহ সাহেব রহ. সম্পর্কে অভিযোগ করে বলেন, তারা হাটহাজারী মাদরাসা ও আল্লামা শফী সাহেবকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে এবং মাইনাস করার চিন্তাভাবনা করছে। আল্লামা শফী, মাওলানা আব্দুল কুদ্দুস, মাওলানা নুরুল আমীন, আপনি এবং আমাকে একসাইট করে ওনারা কথা বলছে। আবু ইউসুফ খাস কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আনাস মাদানীকে বলেন, আব্বাজানকে বলেন খাস কমিটি ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। তিনি যেন বলেন, খাস কমিটি আমি করেছি ফায়দার জন্য, কিন্তু এখন কোন লাভ নেই। আমাদের পক্ষে মরহুম মাওলানা আশরাফ আলী, মাওলানা নুরুল আমীনসহ কয়েকজন আমাদের পক্ষে রয়েছেন।

ফোন কলের শেষ দিকে এসে আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী সাহেব মিটিংয়ে আসছেন কিনা জানতে চান আনাস মাদানী। তখন আবু ইউসুফ বলেন, আসে নাই। তবে কাসেমী সাহেব দুদিন আগে আমার খুবই বিরোধিতা করেছে। নির্ধারিত সময় পর ফিস নেওয়ায় আমার উপর ক্ষেপেছে।

এছাড়াও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আবূ ইউসুফ প্রশ্নফাঁস করে তার ছেলে সুলতান আহমদ মেরাজকে সানাবিয়্যা মারহালার পরীক্ষার মেধা তালিকায় সারা বাংলাদেশে ৪র্থ স্থান এবং ফযিলত মারহালায় ১ম স্থান অর্জনে সহায়তা করেছেন। অথচ ঢালকানগর মাদরাসার ১ম সাময়িক ও ২য় সাময়িক পরীক্ষায় ২০/২৫ জন ছাত্রের মধ্যে তার অবস্থান ছিল ১২/১৩ নম্বরে। পরের বছর তাকমীল মারাহালায় তার ছেলে ২০ তম স্থান লাভ করেন।

এহেন অপকীর্তি সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে কোন বিবৃতি প্রদান করা হয়নি এবং প্রতিবেদনের স্বার্থে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন একাধিক প্রতিবেদক। বরং পূর্বের ন্যায় ধামাচাপা দেয়ার অপচেষ্টা ও উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দরবারে ছুটাছুটি করার অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রবলভাবে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে স্বচ্ছতা নয়, বরং ক্ষমতার অপব্যবহার করাই যেন মূল উদ্দেশ্য।