নির্বাচনের মাঠেও ছক্কা হাঁকালেন ইমরান খান

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ২৬ ২০১৮, ০০:০৬

খেলার মাঠ থেকে রাজনীতির মাঠে এসেও ছক্কা হাঁকালেন ইমরান খান। যৌবনে ক্রিকেটের বাইশ গজে কাঁপিয়েছেন। আর পড়ন্ত বেলায় পুরো পাকিস্তান! একেবারে জাত ‘কাপ্তান’ যাকে বলে। এক সময় দেশের হয়ে দল চালিয়েছেন।

এখন প্রধানমন্ত্রী হয়ে নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন পুরো দেশ। গুজব-কানকথাই শেষপর্যন্ত সত্য হল। সেনাশক্তিতে হোক আর কপালজোরেই হোক- জয়ের মালা উঠছে ইমরান খানের গলাতেই।

সে কথাই বলছে নির্বাচনের বেসরকারি ফল। শেষ খবরের ফলাফলে দেখা গেছে, ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পেতে যাচ্ছে ১০৫ আসন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) পাচ্ছে ৭১ আসন। আর বিলাওয়াল ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৩৯ ও অন্যরা ৫৭ আসন। সরকার গঠন করার জন্য প্রয়োজন ১৩৭ আসনে জয়।

ফলে হামলা-সংঘর্ষে শেষ হওয়া আতঙ্কের নির্বাচনে আরেক সমস্যা ভর করছে পাকিস্তানে। কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না। ঝুলন্ত পার্লামেন্ট গঠিত হচ্ছে দেশটিতে। সেক্ষেত্রে জোট সরকার আসবে পাকিস্তানে। সরকার গঠন করতে পিপিপিকে বাদ দিলে ইমরানকে অন্য দুই বা ততধিক দলকে কাছে টানতে হবে। কারণ প্রয়োজনীয় আসন পূরণে অন্য দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের সংখ্যা খুবই সীমিত। পাকিস্তানের পার্লামেন্ট কত দিন ঝুলে থাকবে- সেটা এখন

অনেকটা অনিশ্চিত। ইমরান তার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা দিয়ে যত দ্রুত অন্য দলগুলো বাগে আনতে পারবেন, তত দ্রুতই এর সমাধান হবে।

এমন খুশির দিনেও মন খুলে হাসতে পারেনি পাকিস্তান। রক্ত ঝরেছে, হামলা হয়েছে বেলুচিস্তানের কোয়েটায়।

সেনাবাহিনী থাক আর পুলিশ থাক- হামলা হবেই। ভোট আমেজে সব ভুলে থাকা ভোটারদের মাঝে এ শঙ্কা ছিল শুরু থেকেই। পুরো পাকিস্তানকে দুর্গে মুড়ে ফেলা লাখ লাখ ‘সেনাবর্মেও’ শেষ রক্ষা হল না। রক্ত ঝরল ভোটের দিনেও। নিভে গেছে ৩১ তাজা প্রাণ। শোকের ছায়ায় ঢেকে গেল গণতন্ত্রের উৎসব। একদিন আগে নামানোর পরও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হল সেনাবাহিনী। নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও বারবার রক্তাক্ত হয়েছে পাকিস্তান। তখন থেকেই ভোটের দিনের এ ভয় পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিল।

বুধবার ভোট গ্রহণ শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে হিসাব কাঁটায় কাঁটায় মিলে গেল। ‘ঐতিহাসিক নিরাপত্তাকে’ বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বেলুচিস্তান প্রদেশের রাজধানী কোয়েটার ভোট কেন্দ্রের ঠিক সামনেই আত্মঘাতী হামলা করে জঙ্গিরা। শুধু জঙ্গিরাই নয়, ভোট কেন্দ্র দখলে পেশিশক্তিতে মত্ত হয়ে উঠেছিল বড় দলগুলোর কর্মী-সমর্থকরাও। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থকদের কয়েক দফা সংঘর্ষ হয়েছে। কোনো কোনো কেন্দ্রে পিটিআই ও আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) মধ্যে সংঘাত হয়।

পাঞ্জাব, খাইবার পাখতুনখাওয়া ও সিন্ধুতে দফায় দফায় সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন অন্তত ২ জন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের মোট আসন ৩৪২টি। এর মধ্যে সরাসরি নির্বাচন ২৭২ আসনে। বাকি ৬০ আসন নারী ও ১০টি সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত। পাকিস্তানের ১১তম জাতীয় নির্বাচনে একযোগে ৮৫ হাজার ৫০৮টি ভোট কেন্দ্রে বুধবার সকাল ৬টায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়, শেষ হয় সন্ধ্যা ৬টায়। এরপর শুরু হয় ভোট গণনা।

প্রাক্কলিত ফলাফলে দেখা গেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ২২ আসনে, মুত্তাহিদা মজলিসে আমল ও গ্রান্ড ডেমোক্রেটিক পার্টি ৯টি করে আসনে জয় পাচ্ছে। বৃহস্পতিবার সকালে আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন। দেশটির মোট নিবন্ধিত ভোটার ১০ কোটি ৫৯ লাখ ৯৫ হাজার ৪০৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৫ কোটি ৯২ লাখ ২২ হাজার ৯২৭, নারী ৪ কোটি ৬৭ লাখ ৩০ হাজার ৫৬৯ জন ও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ১ হাজার ৯১৩ জন। নির্বাচন কমিশনের তথ্যানুসারে, জাতীয় পরিষদে ৩ হাজার ৪৫৯ জন প্রার্থী ছিলেন। প্রাদেশিক পরিষদেও ভোট হয়েছে। পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদে প্রার্থী ১ হাজার ৬২৩ জন। সিন্ধু থেকে ৮২৪ জন, খাইবার পাখতুনখাওয়ায় ৭২৫ জন ও বেলুচিস্তানে প্রার্থী হয়েছেন ২৮৭ জন।

ভোট শুরুর কয়েক ঘণ্টা পর বেলা ১১টার দিকে কোয়েটার ইস্টার্ন বাইপাস এলাকায় পুলিশ ভ্যান লক্ষ্য করে বোমা হামলা হয়। এতে নিহত হন ৩১ জন। সহিংসতা ও সন্ত্রাসী হামলার শঙ্কায় ভোট কেন্দ্রগুলোর আশপাশে সকাল থেকেই নিরাপত্তা বাহিনীর তৎপরতা ছিল। মোতায়েন করা হয়েছিল ৩ লাখ ৭০ হাজার সেনা ও সাড়ে ৪ লাখ পুলিশ সদস্য। নি-িদ্র এ নিরাপত্তার মধ্যে এ হামলা হল।

কোয়েটা সিভিল হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, হামলায় আহত ৩০ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। হতাহতদের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ বেসামরিক নাগরিকরাও আছেন। কোয়েটা পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহসিন বাট বলেন, এটি আত্মঘাতী হামলা বলেই মনে হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে দেখছে।

হাশিম গাজী নামে এক স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, ‘হামলাকারী ভোট কেন্দ্রে প্রবেশ করতে চাইছিল। পুলিশ তাকে ঠেকাতে গেলে সে নিজের শরীরে থাকা বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।’ কোয়েটার ওই আসনটি নির্বাচনের আগে থেকেই স্পর্শকাতর হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল। বিস্ফোরণের পর সেখানে ভোট গ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়। জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস) এ হামলার দায় স্বীকার করেছে। এছাড়া সিন্ধু প্রদেশের লারকানায় একটি ভোট কেন্দ্রের বাইরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হয়েছেন অন্তত ৩ জন।

গত জুলাইয়ে নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে প্রার্থীদের বাসভবন, গাড়িবহর, সমাবেশকে কেন্দ্র করে বড় চারটি আত্মঘাতী হামলা হয়েছে। নির্বাচনের দু’দিন আগে ২২ জুলাই খাইবার পাখতুনখাওয়ার দেরা ইসলাম খান এলাকায় জঙ্গি হামলায় পিটিআই প্রার্থী ইকরামুল্লাহ গান্দাপুর ও তার গাড়িচালক নিহত হন। এ দিনের আরেক হামলায় একটুর জন্য প্রাণে রক্ষা পান জমিয়াত ওলামায়ে ইসলামের প্রার্থী আকরাম খান দুরানি। ১৩ জুলাই বেলুচিস্তানের মাস্তাং জেলায় দলীয় সমাবেশে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টির (বিএপি) প্রার্থী নওয়াবজাদা সিরাজ রাইসানিসহ ১২৮ জন। ১০ জুলাই পেশোয়ারে নির্বাচনী সমাবেশে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন এএনপির প্রার্থী হারুন বিলওয়ারসহ ৩৪ জন।

ইমরান খানের মাথায় পাকিস্তানের কলঙ্কিত আশীর্বাদ ‘সেনাবাহিনীর হাত’ রয়েছে বলে অভিযোগ ছিল। কাটাছেঁড়া মেয়াদে হলেও কোনো বেসামরিক দল পাকিস্তানে দ্বিতীয়বারের মতো মেয়াদ পূর্ণ করেছে। এবারের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে ‘নীরব অভ্যুত্থান’ হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ইসলামাবাদ-২ আসনে নিজের নির্বাচনী এলাকায় ভোট দিয়েছেন ইমরান খান। পরে সংবাদকর্মীদের তিনি বলেন, ‘পিটিআইয়ের জন্য আমি আপনাদের কাছে ভোট চাই না। শুধু বলব, আপনারা আপনাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসুন, ভোট দিয়ে দেশের প্রতি দায়িত্ব পালন করুন।’ পিটিআই চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের উচিত দেশের সেবা করা ও ভোটাধিকার প্রয়োগ করা। আমার আনুগত্য দেশের প্রতি, সম্পদের প্রতি নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাইরের শক্তি পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চায়।’

ভোট গ্রহণ শুরুর প্রথম প্রহরেই ভোট দেন নওয়াজ শরিফের মা শামীম আক্তার। লাহোরের ইসলামিয়া কলেজের এনএ-১২৪ কেন্দ্রে ভোট প্রয়োগ করেন তিনি। পিএমএল-এন দলের প্রধান শাহবাজ শরিফ লাহোরে মডেল টাউনের একটি কেন্দ্রে তার ভোট প্রয়োগ করেন। নির্বাচনী আইন মেনে শাহবাজ লাইনে দাঁড়ান। একের পর এক তার পালাও আসে। পরে গণমাধ্যমকর্মীদের শাহবাজ বলেন, ‘ভোটারদের বেশির ভাগই পিএমএল-এনকে ভোট দিতে উদগ্রীব হয়ে আছে। ‘মিয়া সাহেব (নওয়াজ শরিফ) ও তার মেয়ের (মরিয়ম নওয়াজ) আত্মত্যাগের প্রতিদান দেবে তারা।’ শাহবাজ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির চারটি ও পাঞ্জাবের দুটি প্রাদেশিক আসনে লড়ছেন।

দফায় দফায় সংঘর্ষ : নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন ও ইমরান খানের পিটিআই সমর্থকদের মধ্যে কেন্দ্রে কেন্দ্রে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। পাঞ্জাব নওয়াজ শরিফের জন্মস্থান ও পিএমএল-এনের ঘাঁটি। ভোট গ্রহণ শুরুর কিছুক্ষণ পরই প্রদেশটির রাজানপুর জেলায় পিএমএল-এন ও পিটিআই সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। শুরু হয় হাতাহাতি। আহত হয়েছেন উভয় দলের কয়েকজন সমর্থক। পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। পাঞ্জাবের খানেওয়াল।