দেশপ্রেম জাহিরের পদ্ধতি

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

ফেব্রুয়ারি ২২ ২০২১, ০০:০০

আবুল কাসেম আদিল

বাংলাদেশের সেক্যুলারগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম ইস্যুতে ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীকে সবসময় বিব্রত করার চেষ্টা করে, লজ্জা দেয়ার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে এসে সেক্যুলারেরা তাদের দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক চেষ্টায় সামান্য হলেও সফল হয়েছে বলা যায়। ধর্মপ্রাণগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটা অংশ সেক্যুলারদের শর্তমত মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম ধারণ করার চেষ্টা করছে। চেষ্টা করছে বটে, কিন্তু তারা সেক্যুলারদেরকে এতেই কি সন্তুষ্ট করতে পেরেছে? আর কখনো সন্তুষ্ট করতে পারবে কি? আসলে সেক্যুলারদেরকে সন্তুষ্ট করার দরকার আছে কি? বরং উচিত হবে কি? বাংলাদেশি সেক্যুলারদের রাজনীতির যে গতিপ্রকৃতি, তাতে মনে হয় না তারা ধর্মপ্রাণগোষ্ঠীর প্রতি কখনো সন্তুষ্ট হতে পারবে বা হবে। সুতরাং ধর্মপ্রাণ জনগোষ্ঠীর উচিত হবে— সেক্যুলারদের সমালোচনায় কাতর না হয়ে, তাদের কথায় বিব্রত ও লজ্জিত না হয়ে নিজেদের কাজটা যথানিয়মে করে যাওয়া। এই বিষয়ে আত্মসমালোচনা ও পর্যালোচনার দরকার আছে যে, আমরা আমাদের চিন্তা, বিশ্বাস ও আদর্শে অটল আছি কি না। নিজেদের ভুলত্রুটি শুধরে সামনে অগ্রসর হওয়ার দরকার আছে; কিন্তু তাতে সেক্যুলারদের সমালোচনার প্রভাব যেন না পড়ে।

সেক্যুলারেরা যে ইসলামপন্থীদেরকে বিব্রত করার চেষ্টা করে, পদ্ধতিগতভাবে তা অন্যায্য। সেক্যুলারেরা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস ও দেশপ্রেমের একটা মাপকাঠি দাঁড় করিয়েছে। মাপকাঠিটা একান্ত তাদের নিজেদের আদর্শ, বিশ্বাস, শিক্ষা ও মূল্যবোধের অনুকূল। সেক্যুলারেরা চাইছে, ইসলামপন্থীরাও দেশকে তাদের মাপকাঠি মোতাবেক ভালোবাসুক।

ভালোভাবে দেখলে বোঝা যায়, আসলে দেশপ্রেম নিয়ে সেক্যুলারেরা অতটা ভাবিত নয়। তাদের সকল ভাবনাচিন্তা দেশপ্রেম জাহির করার পদ্ধতি নিয়ে। অর্থাৎ ইসলামপন্থীরা দেশকে ভালোবাসুক, এটুকুতে সেক্যুলারেরা সন্তুষ্ট নয়, তারা চায় ইসলামপন্থীদের ভালোবাসার প্রকাশ যেন তাদের মতো হয়। স্পষ্ট করে বললে, তারা ইসলামপন্থীদের থেকে দেশের প্রতি ভালোবাসা ঠিক চায় না, তারা চায় উৎসব-উদ্যাপন যেন সেক্যুলারদের মতো হয়। সেক্যুলারদের সঙ্গে ইসলামপন্থীদের সংঘাতের মূলে এই অন্যায্য চাওয়ার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।

তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশপ্রেম হলো: জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, দিবস-টিবসে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়া, এক মিনিট নীরবতা পালন করা ইত্যাদি। এই যে দেশপ্রেমের মাপকাঠি তারা দাঁড় করিয়েছে, এই মাপকাঠি উত্তীর্ণ হতে কেউ বাধ্য নয়। এসব না করলেই রাজাকার সাব্যস্ত করবে, সেই দিন অতীত হয়ে গেছে। এসব সেকেলে ধ্যানধারণা বাদ দিয়ে সেক্যুলারদেরকে বাস্তবতায় আসতে হবে।

তাদেরকে বুঝতে হবে, আনুষ্ঠানিকতার নাম দেশপ্রেম নয়। আনুষ্ঠানিকতার নাম যদি দেশপ্রেম হয়ও, তাদের বানানো আনুষ্ঠানিকতা দেশপ্রেম হতে যাবে কোন দুঃখে! আরো বুঝতে হবে, দেশপ্রেম আর দেশপ্রেমের উদ্যাপন দুটি ভিন্ন জিনিস। প্রেম সবসময় মনের ব্যাপার। মনে প্রেম আছে কি না তা মাপার মতো কোনো মাপকাঠি নেই। মনে প্রেম থাকলে তা উদ্যাপন করতেই হবে, সেরকম কোনো শর্তও নেই। আবার উদ্যাপন করলে বিশেষ এক পদ্ধতিতেই করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। বরং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ যদি ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতিতে দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে, তাহলে সেটা দেখতে বেশি সুন্দর এবং ন্যায্য। সবাইকে একই রঙে রাঙানো দেখতে চাওয়ার চেষ্টা ফ্যাসিবাদী মানসিকতা থেক উদ্ভূত।

শহীদ মিনারে ফুল দেয়া, মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নেয়া বা বিশেষ কোনো আনুষ্ঠানিকতাকতা যদি কেউ দেশপ্রেম মনে করে, সে তা মনে করতেই পারে। সে তা পালন করুক। কিন্তু কাউকে সে বাধ্য করতে পারে না। পালন না করলে অদেশপ্রেমীও মনে করতে পারে না। বিশেষ একটা গোষ্ঠী নিজেদের শিক্ষা ও মূল্যবোধ অনুযায়ী দেশপ্রেমের একটা সংজ্ঞা দাঁড় করাবে, অতঃপর সেই সংজ্ঞার মাপকাঠিতে এই দেশের গরিষ্ঠ জনগণের দেশপ্রেম মাপজোখ করবে, এমনটা আর হওয়ার নয়। তাদের দেশপ্রেমের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হয়ে দেশপ্রেমী হতে হবে, এদেশের মানুষের এমন ঠেকা পড়ে নি। মানুষ তাদেরটা খায়ও না, তাদেরটা পরেও না যে, তাদের চাহিদামত দেশপ্রেম জাহির করবে। তাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী দেশপ্রেমী না হলে দেশ এবং মানুষের কিছুই যায়-আসে না।

সেক্যুলার-প্রণীত মাপকাঠি অনুযায়ী যারা দেশপ্রেমী নয়, দেশের প্রতি তাদেরও ভালোবাসা আছে। গিয়ে দেখুন মাদরাসার ছাত্ররা বিজয় দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বক্তৃতা করছে, শহীদদের জন্য দোয়া করছে। তারা তাদের মতো করে আনুষ্ঠানিকতা করছে। তাছাড়া আগেই বলেছি, আনুষ্ঠানিক কিছু না করলেও দেশপ্রেমের কোনোই ঘাটতি হয় না।

নিজের সুবিধামত ফিল্টারিং করার অভ্যাস পরিহার করতে হবে। এসব এখন অকার্যকর, সেকেলে। এসব বিভেদই কেবল উস্কে দেয়। সবার মনে আছে নিশ্চয়, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ পরিমাপ করার জন্য একজন অধ্যাপক একটি ফিল্টার তৈরি করেছিলেন। সেটি এমন অকার্যকর হয়েছে, সে ফিল্টার থেকে ছাড়া পাওয়ার চেয়ে আটকে যেতেই মানুষ পছন্দ করে বেশি। বুকে-পিঠে ‘রাজাকার’ লিখে সহাস্য বদনে রাজপথে মিছিল করতেও আমরা দেখেছি। এই জাতীয় ফিল্টার মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেমের মহিমাই নষ্ট করে স্রেফ।

আমাদের সোজা কথা— দেশপ্রেম জাহিরের বিধিবদ্ধ পদ্ধতি নেই। প্রত্যেক মতাদর্শের মানুষ নিজেদের পছন্দমত উপায়ে দেশপ্রেম জাহির করুক, অথবা না করুক। বিশেষ পদ্ধতিতে দেশপ্রেম জাহির করতে জোরজবরদস্তি করা যৌক্তিক নয়।