তিনটি ভাবনা ক্যাপসুল

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ০৬ ২০১৯, ১৮:০০

মনোয়ার শামসী সাখাওয়াত

১.
মুসলিম আত্মপরিচয় কী সংকীর্ণ জাতিবাদী বা সাম্প্রদায়িক দোষে দুষ্ট?
একজন মুসলিম যখন ইসলামকে ভালোবেসে সবকিছুকে ইসলামের আলোকে বোঝেন, দেখেন বা করেন তখন তাঁকে জাতিবাদী বা সাম্প্রদায়িক ট্যাগ দিতে চান কেউ কেউ। তারা বলতে চান যে আপনি তো “আইডেনটিটি পলিটিক্স” করছেন। আপনি নিজের একটি পবিত্র, নিষ্পাপ ও দিব্য শাস্ত্রানুসারী মুসলিম পরিচয় বিনির্মাণ করছেন। এটা করতে যেয়ে আপনি নিজেকে অস্তিত্বসোপানের উচ্চস্তরে অবস্থানকারী একজন হিসাবে দেখাচ্ছেন। আপনি শুধু আপনার জন্য একটা শুদ্ধতার ভুবন তৈরি করছেন না। আরেকটি অ-মুসলিম অশুদ্ধ অপরত্বের ভুবনও তৈরি করছেন।
এভাবে আপনি আপনার আপন ভুবন এবং অপর ভুবনের মধ্যে একটি দ্বিমাত্রিক/বাইনারি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক তৈরি করছেন। ওনারা বলতে চান এভাবে আপনি একটি শুভ আর অশুভের অতিসরলীকৃত ভুবনগত দ্বন্দ্ব বিনির্মাণ করছেন। সেখানে নিজেকে শুভ ভুবনের অস্তিত্ব হিসাবে দেখিয়ে নিজের সবকিছুকে নৈতিক মূল্যসোপানের উৎকৃষ্ট উচ্চে স্থাপন করছেন। আর বিপরীত মেরুবর্তী সবকিছুকে অশুভ ভুবনের অস্তিত্ব হিসাবে দেখিয়ে নৈতিক মুল্যসোপানের নিকৃষ্ট নিম্নস্তরে নিক্ষেপ করছেন। এভাবে আপনি নিজেকে সর্বদা গৌরবান্বিত ও ন্যায়ানুবর্তী প্রমাণ করছেন এবং অপরকে সর্বদা গৌণ ও অন্যায্য হিসাবে দেখাচ্ছেন।
যেহেতু আপনি ইসলামের চশমা পরে সবকিছু দেখছেন তাই আপনি সংকীর্ণ, জাতিবাদী ও সাম্প্রদায়িক। এটা হল মোটা দাগে মার্ক্সিস্ট ও পোস্টমডার্নিস্টদের মুসলিম বা ইসলাম অনুসারীদের সম্পর্কে একটি কমন সমালোচনা।

২.
“ইজতিহাদ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি বলে বিবেচিত না হয়ে কেবলমাত্র আইনসংক্রান্ত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। ইজতিহাদের এই সীমাবদ্ধ ধারণা এক ধরনের ব্যাধির সৃষ্টি করে যার ফলে তাক্বলীদ এতটা প্রসার লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।”
— ‘চিন্তার সংকট এবং ইজতিহাদ’ – শাইখ ড. তাহা জাবির আল আলবানী
মুসলিমরা কেন পিছিয়ে পড়ল তার একটা ভালো আর্গ্যুমেন্ট উপরের এই উদ্ধৃতিটি। এটা মূলত ইসলাহি বা সংস্কারবাদী/পুনর্জীবনবাদীদের ডিসকোর্স। পশ্চিমা প্রাচ্যবাদীরাও অবশ্য তাদের এজেন্ডা পূরণের জন্য সুবিধাজনক মনে করে এই আর্গ্যুমেন্টটির কাছাকাছি একটা যুক্তি বেশি বেশি প্রচার করে। শাইখ আলবানীর এই মতটিতে সুযুক্তির বিন্যাস থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমা প্রাচ্যবাদীদের মতের সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যাবার কারণে ইসলামী সংস্কারবাদী/পুনর্জীবনবাদীদের অনেকসময় বিব্রত হতে হয়।
অন্যদিকে অক্ষরবাদী ও চির-অনুকরণবাদী ইসলামপন্থীরা ইসলাহীদের এই ভাষ্যের বিরোধিতা করে। তারা বলে মুসলিমরা পিছিয়ে গেছে তার কারণ মুসলিমদের তাক্কলিদ বা জ্ঞান-বিজ্ঞানে পিছিয়ে পড়া নয়, তার কারণ হল মুসলিমেরা কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হয়েছে। কাজেই ইজতিহাদ বা জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি অর্জন নয় মুসলিমদেরকে ফিরে যেতে হবে কোরআন-সুন্নাহর আক্ষরিক ভাষ্যের দিকে। তাহলেই পুরনো গৌরব ফিরে পাবে তারা।
পশ্চিমা প্রাচ্যবাদীরা এই আক্ষরিক ধারাকে আবার ফান্ডামেন্টালিস্ট বা মৌলবাদী আখ্যা দিয়ে তীব্রভাবে এর সমালোচনা করে। ফলে এই আক্ষরিকেরা সহজ-সরল মুসলিমদের কাছে একধরণের পাশ্চাত্যবিরোধী “জিহাদী” ইমেজের সুবিধাও পায়। এদের কোনো কোনো উপদল এমনকি নানান কিসিমের রোমান্টিক জিহাদে নেমে শেষতক সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদে পরিণত হয়। পাশ্চাত্য এদেরকে দমনের নামে তখন বিভিন্ন মুসলিম দেশে দেশে সামরিক অভিযানে লিপ্ত হয়। তবে তারা শুধু সন্ত্রাসী/জঙ্গিবাদীদের দমন করেই ক্ষান্ত হয় না। তারা আসলে আল্টিমেটলি ইসলামী সংস্কারবাদী/পুনর্জীবনবাদীদের উত্থানকেই আসলে রুখে দিতে চায়। হয় মুসলিম দেশগুলোকে নৈরাজ্যময় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করে, নয়তো সামরিক বেসামরিক বশংবদ একনায়ক ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে বা টিকিয়ে রেখে যাবতীয় ফায়দা লুটতে থাকে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে মুসলিমদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিশেবে আপনি কোন ধারণা পোষণ করেন তা আপনার আত্মপরিচয় ও কার্যকলাপ দুটিকেই নির্ধারণ করছে।
এটি আসলে মুসলিম উম্মাহর ভেতরে বিরাজমান বিভাজনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশ।
৩.
বিভিন্ন মতের সহাবস্থান বা বহু্স্বরের পারস্পরিক সহিষ্ণুতা একটি ভাল মূল্যবোধ। বাস্তব ইসলামে আজ বহুদিন ধরে কোন একক স্বর নেই। বরঞ্চ নানা রকম স্বরের অস্তিত্ব আজকে অনস্বীকার্য। কাজেই বিভিন্ন বিপরীতমুখী চিন্তা ও মতের মধ্যে সৌহার্দ্য ও সুষমা বজায় রাখতে বহুবচনের প্রতি সহিষ্ণুতা একটি উপকারি পথ ও পাথেয় হতে পারে। ইসলামের পরিমন্ডলে তৌহিদ, শিরক- ও বিদাত-বিরোধীতা ইত্যাদি মৌলিক নীতি বা আদর্শকে বিসর্জন না দিয়েও বিভিন্ন মতামতের প্রকাশ ও পারস্পরিক সহিষ্ণুতার মূল্যবোধ অনুশীলন করা যেতে পারে।
এইভাবে ইসলামের পরিমন্ডলে একটি ধ্রুপদী উচ্চমানের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। যেখানে মতামতের বিভিন্নতা ও দ্বিধাবিভক্তি থাকা সত্ত্বেও তা সভ্য ও শীলিত সংঘর্ষ বিমোচনের পদ্ধতি অবলম্বন করে সমাধান করা যেতে পারে। তা যেন কখনোই হাতাহাতি, লাঠালাঠি ও অস্ত্র-ব্যবহার অর্থাৎ সহিংসতা এবং সন্ত্রাসের অন্ধকার ও নৈরাজ্যকর পথে অবনমিত না হয়।