তারা যোগ্যতার বিনিময় করে, শেয়ার করে, আমরা করি না

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

আগস্ট ০৩ ২০১৯, ১৪:৫০

সৈয়দ শামছুল হুদা

যোগ্যতার কোন বিকল্প নেই। মানুষের মেধার সর্বোচ্চটুকু সুকুমার বৃত্তির কাজে নিরত প্রয়োগের মাধ্যমে যে যতটুকু উঁচুমার্গে পৌঁছতে সক্ষম হবে সেই কর্তৃত্ব করবে সবকিছুর। যোগ্যতা ছাড়া কিছু হয় না। জগতসংসারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে হলে, একটি পর্যায়ে পৌঁছতে হলে যোগ্যতার কোন বিকল্প নেই। যোগ্যতা ছাড়া সংগঠন চালানো যায় না। যোগ্যতা ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান চালানো যায় না। যোগ্যতা ছাড়া কোন কিছুই চলে না।

যোগ্যতার গুরুত্ব অপরিসীম। এই যোগ্যতার রয়েছে বহুরূপ। বহুচিত্র। একে নির্দিষ্ট কোন অবয়বে চিন্তা করা অনেক কঠিন। যে যেই লাইনে কাজ করতে চায়, উন্নতি করতে চায়, সফল হতে চায়, প্রভাব সৃষ্টিকারী শক্তি হতে চায়, তাকে সেই লাইনের সকল প্রকার কলা-কৌশলগুলো সর্বাত্মকভাবে আয়ত্ত্ব করতে হবে। একজন মুচিও যদি তার লাইনের সর্বোচ্চ কৌশলটা প্রয়োগ করা বুঝে, তাহলে সে সেই ক্ষেত্রে সফল হবেই। তাকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।

যোগ্যতা আসলে কী জিনিস! এটা কী কোন নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন অধ্যয়নের মাধ্যমে অর্জিত হয়? নাকি সুনির্দিষ্ট পুস্তক পাঠের মাধ্যমেই অর্জিত? আসলে যোগ্যতা অর্জনের নির্দিষ্ট কোন বিধি-বিধান নেই। যোগ্যতা অর্জনের জানালাটি অনেক বড়। অনেক বিস্তৃত। যে যেই লাইনে কাজ করতে চায়, সেই লাইনে মেধার সর্বোচ্চটুকু প্রয়োগ করে তার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের সঠিক প্রয়োগই যোগ্যতা।

পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত সবকিছু পরিবর্তন হচ্ছে। যোগ্য মানুষেরা নিত্য-নতুন কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা যোগ্যতার সংজ্ঞাকে প্রতিনিয়তই পাল্টে দিচ্ছে। আজকে যে পদ্ধতিতে কাজ করলে মানুষ যোগ্য মানুষ হিসেবে প্রশংসা করছে, দেখা যাচ্ছে, কাল সেই কৌশল আর কাজ দিচ্ছে না। সেখানে সফলতা অর্জনের জন্য নতুন কৌশল প্রয়োগ করছে। আল্লাহ তায়ালা মানুষকে যথেষ্ট জ্ঞান দিয়েছেন। যে জাতি সেই জ্ঞানকে নতুন নতুন বিষয় আয়ত্ত্ব ও ধারণ করার কাজে ব্যয় করে তারাই অগ্রসর হয়। আর যারা অন্ধের মতো অন্যের অনুসরণ করে তারা সেই অগ্রসরদের পেছনেই পড়ে থাকে।

রাসুল সা. এর যুগ থেকে মুসলমানদের সোনালী যুগ পর্যন্ত অর্থাৎ মুসলমানরা এত বেশি নিজেদের মেধার বিকাশ ঘটিয়েছিল যে কারণে পাশ্চাত্য এদের কাছেও ঘেষতে পারে নাই। আব্বাসীয় খেলাফতের সময়টাই ছিল মুসলমানদের আবিস্কার-উৎকর্ষতার সোনালী যুগ। সেই সময়টাতে আমেরিকার আবিস্কারই হয়নি। ইউরোপ আবিস্কার কাকে বলে জানতোই না। তারা গ্রানাডা, কর্ডোভাকে কাছ থেকে দেখে অবাকই হতো। মুসলমানরা এত উন্নত হয় কীভাবে? অতঃপর তাদের মধ্যে একধরণের ঈর্ষা তৈরী হয়। তারা মুসলমানদের উন্নতির নিকট ধর্ণা দিতে থাকে। কিছু কিছু বিষয় শিখতে থাকে। সবশেষে তারা ক্রুসেড যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানদের একেবারে সর্বোচ্চ অর্জনটুকুর সন্ধান পেয়ে যায়। তারা বাহ্যিকভাবে ক্রুসেডে পরাজিত হয়ে, মুসলিম এলাকাগুলোতে অর্জিত জ্ঞানকে ধারণ করে এবং সেই জ্ঞান থেকে আরও নতুন কিছু অর্জনের প্রেরণা লাভ করে একসময় বিনা যুদ্ধে মুসলমানদের সব এলাকা তারা দখল করে নেয়।

ভারত উপমহাদেশের মোগল সাম্রাজ্য তারা বিনা যুদ্ধে দখল করে নেয়, উসমানী খেলাফতের অধীনে থাকা বিশাল এলাকা তারা বিনাযুদ্ধে দখল করে নেয়। মধ্যপ্রাচ্যে সাফাভী বংশের অধীনে থাকা এলাকাগুলো বিনা যুদ্ধে দখল করে নেয়। বুদ্ধির জোরে। মেধার জোরে। কৌশলের জোরে। ক্রুসেড থেকে তারা অনেক শিক্ষা অর্জন করে। সেই শিক্ষাকে আরও ভালোভাবে ঘষে-মেজে সুন্দর করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে কাজে লাগায়। ফলে আজ যে দিকে চোখ যায়, শুধু তাদের উন্নতিই চোখে পড়ে। মুসলমানরা একটা সময়ে এসে মেধা প্রয়োগের কথা ভুলে যায়। “যা হইছে আলহামদুলিল্লাহ, অনেক করছি, আর কত?” টাইপের মনোভাব তৈরী হয়। চলে আসে অলসতা, এক ধরণের নির্লিপ্ততা।আজও মুসলমানরা এ ঘোর অমানিশা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি।

বর্তমান যুগেও যে কোন জায়গায়, যে কোন প্রতিষ্ঠানে, যে কোন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে হলে, পারিপার্শ্বিক বিষয়ের সর্বোচ্চ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। প্রযুক্তি, ভাষা, ভৌগলিক জ্ঞান, সমরজ্ঞান, কৌশলের প্রয়োগ জ্ঞান অর্জন করতে হবে। ভাসা-ভাসা জ্ঞান দিয়ে, কৌশল দিয়ে, ‍শক্তি দিয়ে টিকে থাকা যাবে না। আর সামগ্রিক উন্নতির জন্য শুধু এককজ্ঞানও যথেষ্ট নয়। সম্মিলিত চেষ্টা চালাতে হবে। একজন মানুষের পক্ষে অনেকগুলো জ্ঞান, যোগ্যতা অর্জন সম্ভব নয়। যখন যোগ্য মানুষগুলোর মধ্যে যোগ্যতার বিনিময় হবে, যখন অভিজ্ঞতার বিনিময় হবে, যখন একেকজন তার অর্জিত জ্ঞান দ্বারা অন্যকে সাহায্য করার মনোবৃত্তি তৈরী করবে, তখনই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

দশজন পরিশ্রমি মানুষ, যোগ্যতা অর্জনে নিরত মানুষ যদি কোন একটি বিষয়ে কোনভাবে একভাবে হতে পারে, তাহলে তাদের সফলতা কোনভাবেই কেউ ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু বর্তমান সময়ের মুসলমানদের মধ্যে এই ক্ষেত্রেই যত গন্ডগোল। কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি না। কেউ কাউকে সাইড দিতে রাজি না। কেউ কারো সাথে নিজের যোগ্যতা শেয়ার করতে রাজি না।নিজের কোন ক্ষতি হচ্ছে না জেনেও অন্যকে সে উপরে উঠতে দিচ্ছে না। এই মনোভাবই আমাদেরকে দুর্বল করে দিচ্ছে। আমাদের সব অর্জনকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছে। কেউ একজন এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে নিজের সামান্য মেধা দিয়ে সাহায্য তো দূরের কথা, জাপটে ধরে ধাক্কা দিয়ে পেছনে ফেলে দিচ্ছে।

আজকে যদি পাশ্চাত্যের উন্নতির কারণগুলো খোঁজা হয়, তাদের উন্নয়নের প্রেরণাগুলো নিয়ে গবেষণা করা হয়, তাহলে দেখা যাবে তাদের উন্নয়নের পেছনে পারস্পরিক সহযোগিতাকেই প্রধান কারণ হিসেবে পাওয়া যাবে। আমরা কি পারবো সেই যোগ্যতা অর্জন করতে, যে যোগ্যতা দিয়ে শুধু আমিই এগিয়ে যাবো না, আমার আরও দশটা ভাইকে এগিয়ে নিয়ো যাবো- এই প্রেরণা অর্জন করতে? যতদিন মুসলমানদের মধ্যে এই মনোবৃত্তি ফিরে না আসবে, ততদিন মুসলমানদের মুক্তি নেই। অগ্রগতি নেই। উন্নতি নেই। যোগ্যতার বিনিময়, যোগ্যতার আদান-প্রদান, যোগ্যতার সহযাত্রী বানানোর সুদিন না আসা পর্যন্ত মুসলমানরা বিচ্ছিন্নই থেকে যাবে। শত কোটি মুসলমান থাকা সত্ত্বেও তাদের হাতে নেতৃত্ব নেই। গুটি কয়েক ইহুদি সারা বিশ্ব চালায়। কারণ তারা যোগ্যতার শেয়ার করে। বিনিময় করে। আমরা করি না।