তাবলীগ জামায়াত ও একজন হযরতজী

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ডিসেম্বর ০৯ ২০১৮, ১১:৫৭

আবুল কাসেম আদিল

এক.

টজতাবলীগ ও তাবলীগ জামায়াত। এই দুইয়ের পার্থক্য এখনই স্পষ্ট হওয়া জরুরি। ‘তাবলীগ’ অর্থাৎ দ্বীনের প্রচার ও পৌঁছানো ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে ছিল, আছে এবং থাকবে। পক্ষান্তরে ‘তাবলীগ জামায়াত’ একসময় ছিল না, এখন আছে, ভবিষ্যতে না-ও থাকতে পারে। যখন এই জামায়াত ছিল না, তখনও দ্বীন ছিল; এই জামায়াত থাকাকালেও দ্বীন আছে; যখন এই জামায়াত থাকবে না, দ্বীন তখনও থাকবে।

আল্লাহর মনোনীত দ্বীনের প্রতি আহ্বান, সত্য-সুন্দর ও কল্যাণের প্রতি মানুষকে পথপ্রদর্শন — এই মৌলিক দাওয়াহ মানবজন্মের শুরুলগ্ন থেকে ছিল, চিরকাল থাকবে। ইজতেমা, তিনদিন, চিল্লা, সাল— দাওয়াহর এই বহুবিধ সাময়িক কর্মপন্থা দ্বারা সাফল্যলাভ হলে ভালো, না হলেও সমস্যা নেই। যতদিন এই আঙ্গিকের দাওয়াতি কাজে সাফল্য আসবে, ততদিন এসব নিয়ম-কানুন বলবৎ থাকবে। যখন এই নিয়মে দাওয়াতি কাজ পরিচালনা করলে সাফল্য আসবে না, তখন এ নিয়ম বিলুপ্ত হবে। কিন্তু মৌলিকভাবে দাওয়াহ থাকবে। সময়ে সময়োপযোগী করে দাওয়াহর নতুন কর্মপন্থা নির্ধারিত হবে। দাওয়াহর এই প্রচলিত কার্যক্রম কুরআন-সুন্নাহর অকাট্য দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয়, দাওয়াহ সাব্যস্ত। দাওয়াহর মূলনীতি ও নবী-রাসূলদের দাওয়াতি কাজের বিবরণ কুরআন-হাদীসে খুব স্পষ্টভাবে বিবৃত আছে। দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে যে নিয়মই প্রণীত হোক, তা কুরআন ও সুন্নাহর মূলনীতির আলোকে প্রণীত হবে বা হতে বাধ্য।

প্রচলিত তাবলীগ জামায়াতের পরিচালিত কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ ইজতিহাদী আখ্যা দেওয়া যায়। ইজতিহাদী বিষয়ে দ্বিমত করার যথেষ্ট সুযোগ আছে। ভারতের মেওয়াত নামক স্থান থেকে যখন এই জামায়াতের আবির্ভাব হয়, তৎকালীন শীর্ষ আলেমগণ এর বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। বিরুদ্ধাচরণ দোষের হলে তাঁরা নিশ্চয় তা করতেন না। তখন বিরুদ্ধাচরণ করা গেলে এখনও নিশ্চয় করা যাবে। তাছাড়া যে কোনো জামায়াতকে সমর্থন তখন পর্যন্ত করা যাবে, যখন পর্যন্ত তার ক্ষতিকর দিক স্পষ্ট না হবে। নেতিবাচকতা স্পষ্ট হওয়ার পরও তা সমর্থন করে যাওয়া গোঁড়ামি ছাড়া কিছু নয়। বিশ্বের শীর্ষ আলেমগণ যে ব্যক্তির প্রতি বীতরাগ, একটি দল এমন ব্যক্তির পকেটবন্দি হয়ে গেলে সে দল সম্পর্কে নতুন করে ভাববার অবকাশ আছে। যে ‘দ্বীনের জামায়াত’ বিশ্বের বিজ্ঞ ও বরেণ্য আলিমদের উপদেশ উপেক্ষা করে নিজেদের খেয়াল-খুশিমত চলতেই বেশি আগ্রহী, সেটি লাইনচ্যুত হতে বাধ্য।

দুই.

হযরতজী বিষয়ক সঙ্কট শুরু হওয়ার পর অনেকেই এই বিষয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন। অধিকাংশের কথাই প্রান্তিক এবং সাময়িক সমস্যার ওপর দৃষ্টিপাত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। ভালো করে নজর দিলে সমস্যাটা ধরা যাবে। সমস্যা মূলত স্রেফ একজন হযরতজীকে নিয়েই নয়, সমস্যা আরো গভীরে। সিস্টেম যদি এরকমই থাকে, তাহলে এই হযরতজীকে দমানো গেলেও নতুন হযরতজী জন্ম নিতে সময় লাগবে না। কারণ আমরা প্রান্তিক আলোচনা করে সাময়িক সমস্যার সমাধান করলেও সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করতে সচেষ্ট নই। সুতরাং সমস্যার মূলে কুঠারাঘাত করতে হবে। মূল সমস্যা জ্ঞানে। প্রচলিত দাওয়াত ও তাবলীগের দাঈদের মধ্যে জ্ঞানের অভাব আছে। শরয়ী পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞানের কথা বলছি না। এটি সাধারণ দাঈদের জন্য তো সম্ভব নয়ই, এমনকি বিজ্ঞ আলিমেরও বিশেষ কোনো বিষয়ে অজ্ঞতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। বলছি ইসলাম ও দাওয়াহর একান্ত মৌলিক জ্ঞান থাকতে হবে। দাওয়াহর কাজ যে পন্থায়ই হোক, দাওয়াহ সম্পর্কে একান্ত মৌলিক ধারণা রাখতে হবে। দাওয়াহর একটি মূলনীতি হলো, জ্ঞান। মূলত সমস্যাগুলো হচ্ছে, দাওয়াহ সম্পর্কে মৌলিক জ্ঞানশূন্য দাঈদের কারণে। জ্ঞানশূন্যতা পূরণ করতে না পারলে সমস্যা একটার পর একটা হতেই থাকবে। সাধারণ পর্যায়ের দাঈদের ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু, অন্তত কেন্দ্রীয় মুরব্বি পর্যায়ের দাঈদের মধ্যে মৌলিক জ্ঞানের অভাব মেনে নেওয়া যায় না।

আল্লাহ বলেছেন—
قُلْ هَـذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَاْ وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللّهِ وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
বলে দাও, এই আমার পথ। আল্লাহর দিকে ‘সজ্ঞানে’ দাওয়াত দিই আমি এবং আমার অনুসারীরা। আল্লাহ পবিত্র। আমি অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত নই।

এই আয়াতে আল্লাহ সজ্ঞানে দাওয়াত দেওয়ার কথা বলেছেন। সুতরাং দাঈদের জন্য ইসলামের মৌলিক বিষয়ে জ্ঞানার্জন আবশ্যক।

দুঃখজনক হলো, দাওয়াহ সম্পর্কেই নয় শুধু, অনেক দাঈ ইসলামের মৌল চেতনা ধারণ করতেই অক্ষম। এজন্য একজন দাঈ তো হযরতজীমুক্ত বিশ্ব ইজতেমাকে পাকিস্তান মেনেজড ইজতেমা বলে আখ্যায়িত করেছেন। মৌলিক জ্ঞানের অভাবে দাওয়াহর কাজে জীবনক্ষয় করেও অন্ধ জাতীয়তাবাদের ঊর্ধ্বে উঠে ইসলামের বৈশ্বিক উম্মাহচেতনা স্পর্শ করতে পারেন নি। এত বড় দ্বীনের কাজকে একজন ব্যক্তির ওপর নির্ভর্শীল মনে করা অবশ্যই ভ্রান্তি। লজ্জাজনক হলো, এঁরা একজন বিতর্কিত ব্যক্তিকে বর্জন করতে পারছেন না, স্রেফ অন্ধ আনুগত্যের কারণে। হাজারো আলিমের বিনীত আহ্বান পায়ে দলতে রাজি আছেন, কিন্তু একজন হজরতজীকে ছাড়তে নারাজ। এরচে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে!

আল্লাহ সবাইকে সুমতি দিন।