ঢাবি ভিসির ‘দশ টাকার’ ইতিবৃত্ত

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

জানুয়ারি ৩০ ২০১৯, ০৮:১৯

আরজু আহমাদ

অনেকগুলো মাদ্রাসার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পৃক্ততা আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানলে বিস্মিত হবে কি না জানি না! তবে বেশ অনেকসংখ্যক ছাত্রকে প্রতিবেলায় সেখানে মাত্র গড়ে ১৩ টাকা ৩৩ পয়সা হারে রোজ খাবারের ব্যবস্থা করা হয়।
এই ১৩ টাকায় একবেলায় ভাত, ডালের সাথে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শুটকি/ছোট মছ/মাংস/ডিম কিছু না কিছু থাকে। সারাদেশে অধিকাংশ মাদ্রাসায় কিছু বেশি কম টাকায় একই রকম চিত্র। অন্তত আমার জানাশোনায় এর ব্যতিক্রম খুব কমই।
কিছু জায়গায় দিনের প্রতি বেলার খাবার খরচা হয়ত ২০/২৫ হবে বড়োজোর।
দারুল উলুম দেওবন্দের দুপুরের খাবার খরচ বাংলাদেশি টাকায় ১৮ টাকা । রাতের খাবার ২৩ টাকা (রুপির বর্তমান মূল্য ধরে)। আর ওতে রোজকার আমিষের চাহিদা মেটানোর মত মাংস থাকে। দেওয়া হয় মহিষের মাংস।
শুধুই এতটুকুন না, দেওবন্দ চেষ্টা করে যতদূর সম্ভব শিক্ষার্থীদের খাদ্য ফ্রি করার। এছাড়াও, একটা বিপুল সংখ্যক ছাত্রকে মাসিক স্টাইপেন্ড দিয়ে থাকে কর্তৃপক্ষ।
এই যে খাবারগুলোর কথা বললাম সেখানে খেতে গিয়ে আপনি ভাতে গন্ধ, খাবার অনুপযোগী মোটা চাল আর মাঝেমধ্যে প্লেটে পোকা আবিষ্কার করবেন না।
মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় ফেরত এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়টি তাঁর ছাত্রদের ১ সৌদি মুদ্রায় দুপুরের খাবার দেয়। তাও বুফে ১০/১২ পদের। বাংলাদেশি মুদ্রায় যা ২২ টাকা মাত্র।
আর ইসলামী খেলাফতকালে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচ ছিল মওকুফ। রাষ্ট্র বহন করত থাকা, খাওয়ার খরচ। দিত উচ্চহারে বৃত্তি। বৃত্তি ছিল সব ছাত্রের জন্যই। কোনও কোনও কালে এর পরিমাণ ছিল এত বেশি যে, ঐ দিয়ে বিয়ে শাদি করে পরিবার অবধি পোষা যেত।
হিজরি সপ্তম শতাব্দীতে যখন উম্মতের ভয়াবহ এক পতনের কাল চলছিল। খেলাফত ছিল সবচে’ ভঙ্গুর। ফিরিঙ্গিরা যখন বাগদাদের সকল পুরুষকে হত্যা করেছিল। সেই দুর্বলতম সময়েও বৃত্তি বন্ধ হয় নি। ৩০০ রৌপ্যমুদ্রা বৃত্তি চালু ছিল।
এর আরেকটা উদাহরণ মুস্তানসিরিয়া মাদ্রাসা। আব্বাসিয় খলিফা মুস্তানসির ১২২৭ সালে মাদ্রাসাটি নির্মাণ করেন। উচ্চতর স্থায়ী গবেষণার জন্য ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে এটিই সর্ব প্রাচীন।
উপমহাদেশে যা কওমি মাদ্রাসা নামে পরিচিত, আদতে এটাই এর ভিত্তি প্রতিষ্ঠান। ১২৩৫ সালে মাদ্রাসার সদর হলে জল-চালিত একটা এলার্ম স্থাপন করা হয়, যা নামাজের সময় বেজে উঠত।
প্রতিষ্ঠাকালে খলিফা মাদ্রাসাটির গ্রন্থাগারে ৮০ হাজার ভলিউম হাতে লেখা কিতাব দান করেন। পরবর্তীতে নানা ব্যাক্তি অনুদানে তা ৪ লাখ ভলিউমে পৌঁছায়। যা ছিল তদানীং ইতিহাসের সর্ব বৃহৎ সংগ্রহ। চার মাজহাবের জন্য চারটি পৃথক হল ছিল।
আর প্রত্যেক ছাত্র মাসিক বৃত্তি হিসেবে সেখান থেকে স্বর্ণ মুদ্রা পেতেন।
সমরকন্দে শুধু কায়দা, আর কোরান হিফজের জন্য যে প্রাথমিক শিক্ষালয় ছিল, সেই তিল্লাকারী মাদ্রাসা নির্মাণে ১ হাজার ১ শত ২০ ভরি স্বর্ণ ব্যবহার করা হয়েছিল। বৃত্তি তো ছিলই।
ইংরেজরা এই বাঙলার বুকে থাবা বসাবার আগে, এ দেশের শিক্ষা ছিল মাদ্রাসা নির্ভর। এই মাটি তো সেই মাটি, যে মাটির এক পঞ্চমাংশই ছিল মাদ্রাসার জন্য ওয়াকফ করা।
সেই ওয়াকফ সম্পত্তিই ব্রিটিশরা লা-খেরাজ বা নিষ্কর সম্পদ হিসেবে অধিগ্রহণ করে। ১৮২২ থেকে ১৮৪০ পর্যন্ত ১৮ বছরে ইংরেজরা মাদ্রাসাগুলো থেকে এসব জমি কেড়ে নেয়।
এই সমগ্র ভূ-খণ্ডের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সম্পদ থেকে হওয়া আয় দিয়ে ছাত্রদের খাদ্য, বাসস্থান, মাসিক ভাতা চালু ছিল।
ঢাবি ভিসি ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির ছাত্র এবং শিক্ষক ছিলেন। তাঁর তো এসব জানা থাকা উচিত এবং মনে রাখাও উচিত।
আমরা কারো দাক্ষিণ্যে বেঁচে নেই। আমাদের থেকে বরং আমাদের গৌরবকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। পারলে তা ফিরিয়ে আনুন। তবেই গৌরবের জায়গা তৈরি হবে।

লেখক: সাংবাদিক এবং ইসলামি ইতিহাস বিষয়ক গবেষক। ময়মনসিংহ ৷