টোকাই কাহিনী | অবন্তী রহমান

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

ফেব্রুয়ারি ১৩ ২০১৯, ০৬:২৭

আর এক প্লেট ভাত খামু স্যার! বহুদিন পর ভালো তরকারি দিয়া ভাত খাইছি তাই প্যাটের মধ্যে ক্ষিদা আরো বাইড়া গেছে। আমারে আরেক প্লেট ভাত খাওয়াবেন স্যার?

আরো এক প্লেট ভাতের অর্ডার দেয় ফাহাদ হোটেলের কর্মচারীকে।
মুহুর্তের মধ্য আরো এক প্লেট সাদা ধবধবে গরম ভাত এনে দেওয়া হয় ছেলেটির সামনে। ছেলেটি গোগ্রাসে ভাত গিলতে থাকে যেন কতশতাব্দী এমন খাবার খায় না।

ফাহাদ অপলক দৃষ্টিতে এতক্ষন ছেলেটির খাওয়া দেখছিলো এইবার ছেলেটিকে ফাহাদ জিজ্ঞেস করলো
নাম কি তোর?? তুই কোথায় থাকিস?

আমার নাম তপু স্যার। আমি এই হোটেলের পিছনে যে রেলস্টেশন আছে ঐখানে থাকি। সারাদিন কাগজ টোকানোর পরে রাইতে গিয়া ঐখানে ঘুমায়।

তোর বাবা মা কোথায়?

বাবা মারে কোনদিন চোখে দেখিনাই স্যার। আমি বড় হইছি এক খালার কাছে সেই খালাটাও বড় দুঃখিনী আছিলো তার স্বামী সন্তান ছিলো না।
এক সকালে ভোরে মাইনষের চেঁচামিচিতে উইঠা দেখি খালার ঘরের সামনে ম্যালা ভীড়!
ভীড় ঠেইলা যাইয়া দেহি খালা ঘুমায় আর চারপাশের থেইকা মানুষ ঘিরে রাখছে। আমি কিছুই বুঝতে পারিনাই তখন সেসময়। আবার গিয়া পাশের ঘরে শুইয়া পড়ছি। কিন্তু ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হইয়া আসছিলো। কিছুক্ষন পর একজন আইসা কয় তোর খালা মইরা গেছে।
জানেন স্যার ঐদিন ঐসময় আমি কাঁদতে পারিনাই কাদিওনাই। খালার জানাযা, দাফনের পর কবরের সামনে গিয়া খুব কাঁদছিলাম। ঐডাই ছিলো আমার শেষ কান্না এরপর কতকিছু হইছে আমার লগে কিন্তু কখনো কান্না আসেনাই।

তোর খালা কখনো তোর বাবা মায়ের কথা বলে নাই??? বা তুই কখনো জানতে চাস নি কি তোর পরিচয়?
কোথায় তোর বাবা মা?

অনেক জিজ্ঞেসা করেছি স্যার খালারে আমার বাবা মা কোথায়?
খালা ও বলতে পারেনাই শুধু কইছে আমারে নাকি পরিত্যাক্ত এক ডোবার কাছ থেইকা কুড়াইয়া পাইছে।
শুধু একটা কাপড় দিয়া জড়ানো ছিলো আর কিছুইনা।
জানেন স্যার অনেকেই আমারে জারজ কইয়া ডাকে আমার নাকি জন্মের ঠিক নাই। একটা ইস্কুলে পড়তে যাইতাম কয়েকদিন যাবার পরে আমারে বাইর কইরা দেয় রাখেনাই। আমার বাবা মায়ের নাম জিগাইছে আমি কইতে পারিনাই তাই।
আচ্ছা স্যার বাবা মায়ের নাম না জানলে কি মানুষ হওয়া যায়না?
আমার কি অপরাধ কন স্যার???

ফাহাদের কাছে তপুর এই প্রশ্নের কোন জবাব থাকেনা। কারন তপু জানে এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর মিললেও সমাজ তার দাপটে অহংকারের ক্ষমতায় মানেনা। ফাহাদ উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে আচ্ছা তপু তোর খালা মারা যাবার পর থেকে তুই কাগজ কুড়োনোর কাজ করিস???

না স্যার,খালা মারা যাবার পরে আমারে এক সাহেব দত্তক নিতে চাইছিলো।
কিন্তু সাহেবের বউ রাজি হয়নাই আমার বাপ মার ঠিক নাই তাই।
তবে আমারে সাহেবদের বাসায় নিয়া যায় বাড়ির কাম করানোর লাইগা। ঐবাড়িতে গিয়া সারাদিনরাত কাম করতাম। আমারে দিয়া ঘর মুছানো থেকে রান্নাবাদে প্রায় সব কামের হুকুম করতো। খালা বাইচা থাকতে আমার কোনদিন কাম করা লাগেনাই। কামের অভ্যাস ছিলোনা তাই ঐ বাড়িতে কাম করতে আমার খুব কষ্ট হইতো। আর কামে ভুল হইলে সাহেবের বউ খুব পিটাইতো। একদিন সাহেবদের বাড়িতে অনুষ্ঠান ছিলো সবাই খাইয়া চইলা গেলে প্লেট ধুইতে গিয়া এক চিনামাটির প্লেট ভাইঙা যায় আমার থেইকা। সেইজন্য আমারে বেধড়ক পিটাইছিলো মাইর সহ্য করতে না পাইরা সেই যে ঐবাসা থেইকা পালাইছি আর যাইনাই।
আজ ও মাঝরাতে স্বপ্ন দেখি সাহেবের বউ আমারে পিটাইতাছে আর ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠি।

ঐ বাসা থেইকা আসবার পরে পুড়া একদিন শুধু রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছি
কত হোটেলের সামনে গিয়া দোকানের সামনে গিয়া একটি রুটি চাইছি কিন্তু কেউ দেইনাই।
গোটা শহরে এমন কোন দোকান নাই গিয়া খাবার ভিক্ষা চাই নাই কিন্তু পায়নাই৷ একসময় পেটের মইধ্যে কান্দন আরম্ভ হইলো। ক্ষিদার জ্বালা সহ্য করতে না পাইরা এক দোকানে ঝুলানো পাউরুটি ছিড়ে দৌড় দিছি।
কিন্তু না খাইয়া শরীর দুর্বল থাকায় বেশী দৌড়াতে পারিনাই দোকানদার ধইরা ফেলছে। দোকানদার গালাগাল করলেও গায়ে হাত দেয়নাই। কিন্তু রুটিটা কাইরা নিয়া যায়। ক্ষুদায় রাগে কান্না আসলেও কাদিনাই। এইভাবে আরো একদিন ঘুরছি হঠাৎ দেখি আমার বয়সী কয়টা ছেলেমেয়ে রাস্তায় কাগজ টুকাই। আমিও গিয়া যোগদি ওদের সাথে কিন্তু ওরা আমারে ওদের দলে নিতে চাইনা। এইদিকে পেটের ক্ষুদায় আমি পাগলপারা ওদের পা চাইপা ধরি ওরা আমারে ওদের মালিকের কাছে নিয়া যায়। মালিক আমারে দেইখা কাগজ টুকানোর কামে দেয়।
আর দুইটা রুটি আর আলুর তরকারি দেয় খাইতে। বিশ্বাস করেন স্যার ঐদিন তৃপ্তি নিয়া খাইছিলাম আর আজ আপনি খাওয়ালেন।

তপুর কথা শুনতে শুনতে কখন যেন চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে ফাহাদের। তপু বলে উঠে আপনি কাদতাছেন স্যার কিন্তু আমি কাদিনা কান্না আসেনা।

ফাহাদ বলে উঠে তপু তুই যাবি আমার সাথে? তপু বলে না স্যার আমি যামুনা আপনার লগে! আমি সেই সাহেবের বাড়ির কথা আজ ও ভুলিনাই। সারাদিন কাগজটুকাইয়া রাতে স্টেশনে এসে ঘুমাতে পারলেও শান্তি তবু কারোর গোলাম না এই আশ্বাস দিতে পারি নিজেকে।
আমাদের একটাই পরিচয় আমরা পথশিশু।