জৈন্তিয়ার তেল-গ্যাস যায় কোথায়? 

একুশে জার্নাল ডটকম

একুশে জার্নাল ডটকম

মার্চ ০১ ২০২৩, ১৪:৪৫

আজ থেকে ১৮৮ বছর পূর্বে আমাদের মহান মাতৃভূমি, সভ্যতার সোনালী রাজ্য জৈন্তিয়ার বুকে নেমে এসেছিল এক ভয়ংকর শকুনের থাবা। সাম্রাজ্যবাদী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর থাবায় সেদিন বিপর্যস্ত হয়েছিল হাজার বছরের পুরানো সভ্যতার এই মহান লীলাভূমি। প্রাকৃতিক সম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডার হওয়ায় শ্রীভূমি জৈন্তিয়ার দিকে ইংরেজ বেনিয়াদের সবসময়ই কু-দৃষ্টি ছিল। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত হওয়ায় তারা দীর্ঘদিন ধরে এই রাজ্যটি দখলে নিতে পারেনি। অবশেষে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ তারা সুযোগ বুঝে রাজ্যটি কেঁড়ে নিতে সক্ষম হয়। লুটেরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সৈন্যরা সেদিন জৈন্তিয়ার রাজা রাজেন্দ্র সিংহকে বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল সিলেট শহরের উপকণ্ঠে- জমিদার মুরারী চাঁদের বাড়ীতে।

তারপর…………। তারপর অনেক দিন কেটে যায়। একের পর এক রাষ্ট্র আসে এবং যায়। কিন্তু জৈন্তিয়াবাসীর ভাগ্যের আর কোন পরিবর্তন হয় না। জৈন্তিয়া অনেক দিয়েছে, দু’হাত ভরে দিয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে পায়নি কিছুই। জৈন্তিয়ার সম্পদে লাভবান হয়েছে লন্ডন, বার্মিংহাম…. সমৃদ্ধ হয়েছে ঢাকা-কলকাতা। কিন্তু জৈন্তিয়া পায়নি কিছুই। এ ইতিহাসের যেনো শেষ নেই। জৈন্তিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করা হয়েছে এবং হচ্ছে। জৈন্তিয়াবাসী যে বঞ্চিত ছিল সেই বঞ্চিতই আছে। ভাগ্যের পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনাই নেই। নতুন নতুন মাফিয়া ছাড়া আর কোন কিছুই জৈন্তিয়ার ভাগ্যে জোটেনি। মাফিয়ারা জৈন্তিয়াকে খুবলে খেয়েছে। কিন্তু কেউই কোন প্রতিরোধ করেনি। কেউ না।

জৈন্তিয়া থেকে কয়েক লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ পাচার হয়েছে। জৈন্তিয়ার সম্পদে লন্ডন-বার্মিংহাম-ঢাকা-কলকাতায় ইমারত গড়ে উঠেছে। জৈন্তিয়াবাসী যে বোকা ছিল সেই বোকাই আছে। নিজেদের সম্পদের ওপর অবাধ লুণ্ঠণকে তারা কখনোই প্রতিরোধের চেষ্টা করেনি। জৈন্তিয়ার এই বিকি-কিনি আজও চলমান। গুটিকয়েক মানুষ ছাড়া বাকি সকলেই আজ জৈন্তিয়া বেঁচা-কেনায় ব্যস্ত! কীভাবে ও কত উপায়ে জৈন্তিয়াকে বিক্রি করা যায় সেটা গভীরে না গেলে বোঝা যায় না।

প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার খনিজ সম্পদ জৈন্তিয়া থেকে পাচার হয়ে যায়। দুর্নীতিবাজ সরকারী আমলাদের যোগসাজশে সরকারী কোষাগারকে ফাঁকি দিয়েই এই লুটতরাজ সংগঠিত হয়। একারণে এই সম্পদের ভাগ থেকে কেবল জৈন্তিয়াবাসীই বঞ্চিত হয় না, বাংলাদেশের জনগণও এই সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়। জৈন্তিয়ার সম্পদ চলে যায় মাফিয়াদের পকেটে। না জৈন্তিয়াবাসী, না বাংলাদেশবাসী- কেউই এ সম্পদের মূল ভাগ পায় না। অথচ কেউই কোন প্রতিবাদ করছে না।

কেউই প্রশ্ন করছে না যে, জৈন্তিয়ার মাটির বুক থেকে আজ পর্যন্ত কত টাকার তেল-গ্যাস তোলা হয়েছে? জৈন্তিয়ার পাথর কোয়ারীগুলো থেকে আজ পর্যন্ত কত টাকার পাথর তোলা হয়েছে? জনগণ কত পেয়েছে? জনগণ কী পেয়েছে? জৈন্তিয়ার হাওর-বাওড়-প্রকৃতি-পর্যটনকেন্দ্র সবকিছুই ইজারা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? কারা ইজারা দিচ্ছে? ইজারার অর্থ যায় কোথায়? হাজার বছরের পুরানো সভ্যতার লীলাভূমি জৈন্তিয়া আজ শূণ্য, রিক্ত ও নিঃস্ব। অথচ এই জৈন্তিয়ার মাটির তলা থেকে তোলা হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকার খনিজ সম্পদ।

জৈন্তিয়ার প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন করে সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড নামে একটি কোম্পানি। উত্তোলিত হওয়ার পর এই গ্যাস চলে যায় জালালাবাদ গ্যাস টি এ্যান্ড ডি সিস্টেম লিমিটেড নামে আরেকটি কোম্পানির হাতে। তারা তা পৌঁছে দেয় সারা দেশে। এই গ্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ব্যবহৃত হয় দেশের শিল্পক্ষেত্রসমূহে। এ দেশের শিল্পক্ষেত্রে জৈন্তিয়ার গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয় ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে। বর্তমানেও দেশের ইপিজেডগুলোতে জৈন্তিয়ার গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। এ দেশের শিল্পকে সচল রাখতে জৈন্তিয়ার গ্যাসের অবদান অনেক। কিন্তু এর বিনিময়ে জৈন্তিয়াবাসী কী পেয়েছে?

সারাদেশে জৈন্তিয়ার গ্যাস বিক্রি করে যে অর্থ আদায় করা হয়, তার কোনো অংশ কি জৈন্তিয়ার উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়? বিস্ময়করভাবে এ প্রশ্নের উত্তর হলো ‘না’। জৈন্তিয়ার গ্যাস বিক্রি করে সরকারি কোম্পানি যে টাকা আয় করে, তার কোনো অংশই জৈন্তিয়ার উন্নয়নে ব্যবহৃত হয় না।কোম্পানি যে টাকা আয় করে, তার বড় একটি অংশ ব্যবহৃত হয় কোম্পানির লোকজনেরই পেছনে। সেসব লোকজনের অধিকাংশই জৈন্তিয়ার নন। তারা উড়ে এসে জুড়ে বসা লোক।

কোম্পানির এই অকর্মা লোকগুলি কোম্পানির আয়ের একটি বড়ো অংশ খেয়ে ফেলে। আর বাকি টাকা চলে যায় সরকারের কাছে। সরকার সে টাকা থেকে কখনোই জৈন্তিয়ার উপজেলাগুলোর জন্য বিশেষ কোন বরাদ্দ দেয় না। জৈন্তিয়ার উপজেলাগুলোতে সরকার যে উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়, তা আর দশটা উপজেলার মতোই। যেসব উপজেলায় এক টাকার খনিজ সম্পদও নেই, সেসব উপজেলার সরকারি বরাদ্দ আর জৈন্তিয়ার উপজেলাসমূহের সরকারি বরাদ্দ একই নিয়মে চলে। খনিজ সম্পদের জন্য জৈন্তিয়া আলাদা কোনো বরাদ্দ পায় না। তাহলে জৈন্তিয়ার খনিজ সম্পদে লাভটা কার হলো?

সারা পৃথিবীতেই সাধারণ একটা নিয়ম হলো, যেসব এলাকা থেকে খনিজ সম্পদ আহরণ করা হয়, সেসব এলাকার জনগণের উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট কোম্পানি কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়। এটা বিভিন্ন উপায়ে করা হয়ে থাকে। কোথাও কোথাও দেখা যায়, খনিজ সম্পদ আহরণে নিয়োজিত কোম্পানি প্রতিবছর স্থানীয় জনগণের উন্নয়নে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে। সেটা হতে পারে রাস্তাঘাট, শিক্ষা, চিকিৎসা-সেবা প্রভৃতি খাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ ব্যয় অথবা প্রাকৃতিক সম্পদেরই একটা অংশ (যেমন, প্রাকৃতিক গ্যাস) জনগণের মধ্যে বিতরণ করা।

আবার কোথাও কোথাও দেখা যায়, রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমেই প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর স্থানীয় জনগণের অধিকার সুরক্ষিত করা হয়। এসব আইনের ধারা অনুযায়ী উত্তোলিত খনিজ সম্পদের একটা অংশের ওপর স্থানীয় জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করা হয়। বাংলাদেশেও এমন বিধান রয়েছে। বাংলাদেশের আইনেই জৈন্তিয়ার খনিজ সম্পদের ওপর স্থানীয় জনগণের মালিকানা নিশ্চিত করা সম্ভব। জৈন্তিয়া থেকে উত্তোলিত সকল সম্পদের ২৫% মালিকানা জৈন্তিয়ার জনগণের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব।

এমনটা হলে জৈন্তিয়ার উপজেলাগুলো রাস্তাঘাট-বাঁধ নির্মাণ, হাওর-উন্নয়ন, শিক্ষা ও চিকিৎসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে অভুতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। বর্তমানে সরকার জৈন্তিয়ার উপজেলাগুলোতে যে বরাদ্দ দিয়ে থাকে, তা অনেক ক্ষেত্রে অন্যান্য উপজেলার চেয়ে কমই হয়ে থাকে। কারণ, অন্য উপজেলাগুলো অনেক সময় রাজনৈতিক নেতাদের সুদৃষ্টির কারণে সরকারেরর কাছ থেকে বিশেষ বরাদ্দ আদায়ে সক্ষম হয়, যা জৈন্তিয়ায় এক বিরল ঘটনা। এ এক অদ্ভুত বৈষম্য। প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার হয়েও জৈন্তিয়া সরকারের বিশেষ বরাদ্দ থেকে সর্বদাই বঞ্চিত।

বাংলাদেশে প্রথম গ্যাস ও তেল আবিষ্কৃত হয় এ জৈন্তিয়ার মাটিতেই। প্রথম তেল-গ্যাস উত্তোলনও শুরু হয় জৈন্তিয়ার মাটিতে। ১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (পিপিএল) দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ গ্যাসের সন্ধান পায় জৈন্তিয়ার হরিপুরে। এ গ্যাস তুলতে গিয়ে সে বছরই ঘটে যায় এক মারাত্মক দুর্ঘটনা। ভূগর্ভস্থ গ্যাসের উচ্চচাপের কারণে খননস্থলে ভয়াবহ এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে বিশাল অগ্নিকুণ্ডের সৃষ্টি হয়। সেই সঙ্গে খননকাজে ব্যবহৃত সকল যন্ত্রপাতি ও স্থাপনা তলিয়ে গিয়ে অকুস্থলে এক বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়, যা এখনো স্থানীয় মানুষের কাছে ‘উৎলা’ নামে পরিচিত।

এরপর ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নতুন গ্যাসকূপ খননকাজ সফলভাবে সম্পন্ন হয় এবং দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ভূগর্ভস্থ গ্যাসের উত্তোলন শুরু হয়। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে এ গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। দেশের শিল্পক্ষেত্রে গ্যাসের ব্যবহার এটাই প্রথম। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ফেঞ্চুগঞ্জ সার কারখানায়ও হরিপুরের গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ে হরিপুরের গ্যাসকূপের সংখ্যা দাঁড়ায় ৬টি, যা ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে এসে ৯টিতে উন্নীত হয়েছে। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে এই গ্যাসক্ষেত্রেরই ৭ নম্বর কূপে খনিজ তেলের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই প্রথম তেল কূপ। এ কূপ থেকে ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই পর্যন্ত মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৬৯ ব্যারেল তেল উত্তোলন করা হয়েছিল। খনিজ তেলের আশায় হরিপুরে আরও দুটি কূপ (৮ ও ৯) খনন করা হলেও শেষপর্যন্ত সেগুলো থেকে গ্যাসই উত্তোলন করা হচ্ছে।

১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের দুর্ঘটনায় হরিপুরের ভূগর্ভস্থ প্রাকৃতিক গ্যাসের মূল্যবান এক ভান্ডার বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আজও সেখানকার গ্যাস নির্গত হওয়া বন্ধ হয়নি! দুর্ঘটনার ছয় দশক পেরিয়ে গেলেও ওই এলাকাটি আজও জ্বলছে! দুর্ঘটনার সময় সেখানে যে অগ্নিকুণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল, তা ১৫-২০ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যেত বলে জানা যায়। প্রবীণদের মুখে শোনা যায়, হরিপুরের সেই অগ্নিকুণ্ডের আলোতে রাতের বেলায় আশেপাশের ১০-১৫ কিলোমিটার পর্যন্ত এলাকা আলোকিত হয়ে যেত; সেই আলোতে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে বসেও বই পড়া যেত! সেই দুর্ঘটনায় যে কত গ্যাস পুড়ে গেছে এবং গত ছয়-সাত দশক ধরে সেখানকার কী পরিমাণ ভূগর্ভস্থ গ্যাস বাইরে বেরিয়ে গেছে, তা ভাবতেই গা শিউরে ওঠে!

প্রাকৃতিক সম্পদের এই অবিশ্বাস্য ধ্বংসলীলার বিনিময়ে জৈন্তিয়াবাসী আজও কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি। বরং উলটো তাদের আজ নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় গ্যাস কিনতে হচ্ছে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির কাছ থেকে চড়া দামে। জৈন্তিয়ার বুক চিরে প্রতিদিন যে কোটি কোটি ঘনফুট গ্যাস তোলা হয়, তা বিক্রি করে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো হয় নিজেদের প্রয়োজন মেটায়; নতুবা সরকারের ভান্ডার সমৃদ্ধ করে। এ সম্পদে জৈন্তিয়াবাসীর কোনোই অধিকার নেই।

যুগ যুগ ধরে জৈন্তিয়াবাসী তাদের সবই হারিয়েছে। নিজেদের রাজ্য হারিয়েছে, সম্পদ হারিয়েছে, অধিকার হারিয়েছে, প্রত্নসম্পদগুলোও হারাচ্ছে। যদি এভাবে চলতে থাকে তাহলে আগামীতে হয়তো একদিন দেখা যাবে যে, জৈন্তিয়াবাসীর হারানোর মতো আর কিছু বাকী নেই।

লেখক: আসিফ আযহার, বার্মিংহাম