জিলহজ মাসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

আগস্ট ০৬ ২০১৯, ১৮:১৯

 

একজন মুসলিমের জীবনে কাজ-কর্ম সবই ইবাদত হিসেবে গণ্য। তবে প্রতিটি কাজ হতে হবে আল্লাহর আনুগত্য ও রাসুল (সা.)-এর তরিকায় (পদ্ধতিতে)। তাই মুসলমানের স্বাভাবিক কর্ম-পদ্ধতি ও জীবনযাপনের সামগ্রিক উপকরণ ইবাদত-বন্দেগির সঙ্গে সামঞ্জস্য ও সঙ্গতিপূর্ণ।

সারা বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলিম প্রতিবছরের একটি মাস রমজানের রোজাব্রত পালন করেন। এরপর শাওয়াল ও জিলকদ—দুই মাস পেরিয়েই আসে পবিত্র হজের মাস জিলহজ। জিলহজের প্রথম দশ দিন অত্যন্ত তাৎপর্যবহ ও পুণ্যময়। হাদিসের বিভিন্ন বর্ণনা মতে, এ দশ দিন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠতম দিন। এ দিনগুলোতে ইবাদত ও আমলের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

জিলহজ মাসের প্রথম দশদিনের মর্যাদা, মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব বোঝানোর জন্যে আল্লাহ তাআলা এ দিনগুলোর কসম করে বলেন, ‘শপথ প্রভাতের। শপথ দশ রাতের।’ (সুরা ফাজর, আয়াত-১-২)

তাফসিরবিদরা বলেন, এখানে যে ১০ রাতের কথা বলা হয়েছে, এর মাধ্যমে জিলহজের প্রথম দশ দিনকেই বোঝা যায়।
(তাফসিরে ইবনে কাসির, চতুর্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫৩৫)

মোট চারটি মাসকে রব পবিত্র ও সম্মানিত করেছেন। তন্মধ্যে জিলহজ অন্যতম। পবিত্র কোরআনে মহান রব বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর বিধান ও গণনায় আসমান ও জমিন সৃষ্টির দিন থেকে মাস হচ্ছে ১২টি, । তারমধ্যে চারটি মাস সম্মানিত।’ (সুরা তাওবা, আয়াত: ৩৬)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় হাদিস শরিফে এসেছে, ওই চারটি সম্মানিত মাস হলো—জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব।

আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দশকের নেক আমলের চেয়ে অন্য কোনো দিনের আমলই উত্তম নয়।’ সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন,
হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রামও এই দশকের আমলের চেয়ে উত্তম নয় কি? রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ-সংগ্রামও এর চেয়ে উত্তম নয়; তবে ওই ব্যক্তি ছাড়া, যে তার সর্বস্ব নিয়ে জিহাদে অংশগ্রহণ করল এবং কিছুই নিয়ে ফিরে এলো না।’ (আবু দাউদ, হাদিস নং: ২৪৩৮;
বুখারি, হাদিস নং: ৯৬৯)

অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর কাছে জিলহজ মাসের প্রথম দশকের নেক আমলের চেয়ে বেশি প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। এ দিনগুলোর এক দিনের রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য এবং এক রাতের ইবাদত শবেকদরের ইবাদততুল্য।’ (তিরমিজি, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৫৮)

এ মাসের প্রথম দশ দিন রোজা রাখা উত্তম আমল হিসেবে গণ্য। তাই এ দিনগুলোতে নফল রোজা রাখা খুবই পুণ্যময়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জনৈক স্ত্রী থেকেও এমন বর্ণনা পাওয়া যায় যে, রাসুল (সা.) জিলহজ মাসের নয় তারিখ, আশুরার দিন ও প্রত্যেক মাসের তিন দিন রোজা পালন করতেন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস-২৩৭২)

আরাফার দিন রোজা রাখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে প্রমাণিত, আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আরাফার দিনের রোজা সম্পর্কে আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের পাপের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করা হবে।’
(মুসলিম, হাদিস-১১৬২)

তবে হজপালনে গিয়ে আরাফায় অবস্থানকারী হাজিদের জন্য রোজা রাখা মুস্তাহাব নয়। কেননা মহানবী (সা.) রোজাবিহীন অবস্থায় আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করেছিলেন।

জিলহজের প্রথম দশকের সর্বশ্রেষ্ঠ আমল হলো—হজ ও ওমরাহ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এক ওমরাহ থেকে আরেক ওমরাহ—এতদুভয়ের মাঝের গুনাহগুলোর কাফফারা। আর মাবরুর হজের প্রতিদান শুধুই জান্নাত। বুখারি, হাদিস-১৭৭৩

এই দিনগুলোতে তাকবির (আল্লাহু আকবার), তাহমিদ (আলহামদু লিল্লাহ), তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ) পড়া সুন্নাত। হাদিসে এ দিনগুলোয় জিকির-আজকারের ব্যাপারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এ ১০ দিন নেক আমল করার চেয়ে আল্লাহর কাছে বেশি প্রিয় ও মহান কোনো আমল নেই। তাই তোমরা এ সময় তাহলিল, তাকবির ও তাহমিদ বেশি বেশি করে পাঠ করো।’ (বায়হাকি, শুআবুল ঈমান, হাদিস নং: ৩৪৭৪)

জিলহজ মাসের চাঁদ উঠার পর থেকে চুল, গোঁফ, নখ, বগল ও অন্যান্য স্থানের লোম বা পশম না কাটা মুস্তাহাব। এ সম্পর্কে উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জিলহজের চাঁদ দেখে এবং কোরবানির ইচ্ছা করে, সে যতক্ষণ কোরবানি না করে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন চুল বা নখ না কাটে।’ (মুসলিম, হাদিস-৩৬৫৬)

চুল, গোঁফ, নখ ও অন্যান্য পশম না কাটার আমলটি ওয়াজিব নয়; মুস্তাহাব। ফিকাহবিদরা বলেছেন, এগুলো না কাটার হিকমত হলো- হজযাত্রীদের সঙ্গে সাদৃশ্য ধারণ করা।

আল্লামা ইবনু কায়্যিমিল জাওজিয়্যাহ (রহ.) বলেন, পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে নিজের কিছু অংশ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কোরবানি (ত্যাগ) করায় যেন অভ্যস্ত হতে পারেন, এ জন্য এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

জিলহজ মাসের ৯ তারিখ ফজরের নামাজ থেকে ১৩ তারিখের আসরের নামাজ পর্যন্ত মোট ২৩ ওয়াক্ত নামাজের পর তাকবিরে তাশরিক পড়া ওয়াজিব।

ফরজ নামাজের পর প্রত্যেক বালেগ পুরুষ, মহিলা, মুকিম, মুসাফির, যে কেউ জামাতের সঙ্গে নামাজ পড়ুক বা একাকী পড়ুক—প্রত্যেকের ওপর একবার করে তাকবিরে তাশরিক পাঠ করা কর্তব্য। (ফাতাওয়ায়ে শামি, বাহরুর রায়েক)

তাকবিরে তাশরিক হচ্ছে —‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’

এ দিনগুলোর শেষ দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তির জন্য কোরবানি করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার নবী (সা.)-কে কোরবানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘আপনি আপনার প্রতিপালকের উদ্দেশে সালাত আদায় করুন ও কোরবানি করুন।’ (সুরা আল-কাউসার, আয়াত-০২)

লেখক: সাদ সাইফুল্লাহ মাদানী
সাহেবজাদা- আল্লামা ইসহাক মাদানী রহ.
সম্পাদক- তাবলীগ বার্তা ও মাসিক মুক্তধ্বনি।