জামিলের স্বপ্ন ও দাখিলের রেজাল্ট

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুন ০৪ ২০২০, ১৮:৫২

হোসাইন আল আমিন


আগামীকাল দাখিলের রেজাল্ট পাবলিশ হবে। রাত অনেক হয়েছে, কিন্তু জামিলের চোখে ঘুম তো দূরের কথা, ঘুমের কোনো আলামতও নেই।

কী জানি, রেজাল্ট কেমন হবে! পাশের নাগাল পাবে নাকি ফেইলের তালিকায় নাম লিখা হবে! যদিও আল্লাহর রহমতে পাশ করার মোটামুটি একটা কনফিডেন্সও আছে তার। কিন্তু মনের আবহাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। আবার এটাও মনে হচ্ছে যে, যদি পাস করে তাহলে জিপিএ-৫ -ই পেয়ে যেতে পারে সে।

এইসব আলুতালু চিন্তায় কখন জানি ঘুমিয়ে পড়ে জামিল। এই রকম ডিপ্রেশন নিয়ে ঘুমালে ঘুমটা কেমন হবে তা তো জানাই। আবছা ঘুমের ঘোরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তার। হতাশার ঘন কুহেলিকার আবরণ তাকে আবার আচ্ছাদিত করে ফেলে। “কাল তো রেজাল্ট! আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে! খুশির পেয়ালা নাকি দুঃখের শ্বাসরুদ্ধ অসহ্য যন্ত্রণা!

এসব কল্পনার পথ ধরে সে দ্রুত চলে যায় পেছনে। দুই বছর আগে জেডিসির রেজাল্ট পাবলিশের দিনে। জামিল মুলত কওমী মাদরাসার  ছাত্র। দারুল আজহার মডেল মাদরাসা, সিলেট ক্যাম্পাস থেকে ওই বছর সে অষ্টম শ্রেণীতে বোর্ড পরিক্ষায় অংশ নিয়েছিলো। সরকারি মাদ্রাসায় পরীক্ষার রেজাল্টের জন্য এই প্রথম তার অপেক্ষা। জেডিসিতে তার মনে মনে ছিলো, A গ্রেডে পাস করতে পারাটাই তার জন্য যথেষ্ট।

যাই হোক আল্লাহর অশেষ করুণায় রেজাল্ট-এর দিন তার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল‌ই পেয়েছিলো সে। এতে জামিলের পরিবারের সবাই খুশি। সে সরকারি ধারায় প্রথম বারের মত পরীক্ষা দিয়ে শুধু পাস করে নাই, বরং A গ্রেডে উত্তীর্ণ হয়েছে। শুধু কি তাই? ঐ দিন সন্ধ্যায় তার বাসায় বিশেষ মিষ্টান্ন ভোজনের আয়োজন করেন তার বড় ভাই। তাদের কাছে এটাই অনেক বড় পাওয়া ছিলো এবং জামিল নিজেও সেবার রেজাল্ট নিয়ে ছিলো সন্তুষ্ট।

কিছুদিন পর তার মাদ্রাসায় এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিগত জেডিসি পরীক্ষায় যারা বৃত্তি পেয়েছে তাদেরকে মাদরাসার পক্ষ থেকে সম্মাননা দেয়া হবে। তা শুনে বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীরা ভীষণ আনন্দিত। তাদের সম্মাননা দেয়া হবে অনেক লোকের সামনে। অনেক বড় বড় অতিথিরা উপস্থিত থাকবেন। সবার সামনে তাদের নাম ঘোষণা করা হবে। আহ…! কি রোমাঞ্চকর একটি দৃশ্য! ভাবতেই খুশির শিহরণ উঠে!

ঐ অনুষ্ঠানে জামিলও অংশ নিয়েছিলো। তখন থেকে জামিলের মনের মধ্যে এক ধরনের ঈর্ষার আলো প্রতিভাত হয় এবং সেটা অনুষ্ঠানের দিনই পূর্ণতা লাভ করে।

তখন থেকেই জামিল প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়, দাখিল পরীক্ষায় সে ইনশাআল্লাহ জিপিএ ফাইভ অর্জনের সৌভাগ্য লাভ করবে। আজকের মত সেও বড় বড় ব্যক্তিদের হাত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করবে।

যেমন প্রতিজ্ঞা তেমনি দাখিলের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে জামিল। মাদরাসার ক্লাস, কোচিং, প্রস্তুতি যতই এগুচ্ছিল তার অাত্মবিশ্বাস ততই বেশী পাকাপোক্ত হচ্ছিলো।

দেখতে দেখতে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এলো। পরীক্ষার জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত সে। একদিন শুরু হলো কাঙ্খিত দাখিল পরীক্ষা।

একদিন দুইদিন করে পরীক্ষার একেকটি বিষয় শেষ করে এক পর্যায়ে পরীক্ষার সমাপ্তি ঘটলো। আশা অকাঙ্ক্ষা নিয়ে সবাই নিজ নিজ বাড়ির পথ ধরলো। জামিলও ঐ দিন স্বপ্ন জয়ের বুকভরা আশা নিয়ে বাড়ি যায়।

এর পর থেকে শুরু হলো আরেক অপেক্ষা। রেজাল্টের অপেক্ষায় শুধু দিন গোনা। অবশেষে এই অপেক্ষারও শেষ দিন এলো। রাত পেরুলেই রেজাল্ট। আশা আর নিরাশার জলে হাবুডুবু খায় জামিল।

এইসব ভাবনার ঘোরে কখন যে ফজরের আযান হয়ে গেল মোটেই বুঝতে পারেনি জামিল। ওযু করে নামায আদায় করে সে। নামায শেষে দোয়া করে ক্লান্ত শরীর ও মন নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। যাতে একটু সময় ঘুমানো যায়। কিন্তু ঘুম পাবে কোথায়? সে তো পালিয়ে গেছে ওর থেকে বহু দূরে। পরে অনেক কষ্টে ঘুমের নাগাল পাওয়া গেলো। দু চোখ জুড়ে আসলো ঘুম। কিন্তু মনের অস্থির দোলাচলে বেশি সময় ঘুমাতে পারলো না জামিল। সকাল নয়টার দিকে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ কচলে সাথে সাথে মোবাইলটা হাতে নেয় সে। নিউজ ফিডে রেজাল্টের কোনো খবর আছে কি না দেখে। না, এখনো কোনো খবর নেই।

সকাল দশটায় প্রধানমন্ত্রী লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে ফলাফল ঘোষণা করবেন। এখনো তা এক ঘন্টা বাকি। একেক মূহুর্ত যেন তখন জামিলের একেক বছর। এভাবে এক সময় ঘড়ি দশটার জানান দিলো। হ্যাঁ, রেজাল্ট পাবলিশ হয়ে গেছে। এসএমএস এর মাধ্যমে সহজেই জানা যাবে। কিন্তু এ কি? হায় হায়! মোবাইলে যে টাকা নেই, শুধু মিনিট। বিষয়টি খেয়ালই ছিলো না জামিলের। তাড়াতাড়ি ওয়ালেট হাতে দোকানে গিয়ে মোবাইলে টাকা ফেক্সি করে সে।

এরপর যা হবার তাই হলো। রেজাল্ট দেখে জামিল পুরোই অস্থির। তার চোখের কোনে নোনা জলের ফোটা এসে গেল। সে চেয়েছিলো A প্লাস, কিন্তু তা তো পায়নি। পেয়েছে এ গ্রেড। স্বপ্ন ভাঙার বুকফাটা এক অস্ফুট আর্তনাদ আসে মুখ দিয়ে তার। নিজেকে সামাল দিতে পারে না। সবাই জিজ্ঞাসা করছে রেজাল্ট কি হয়েছে? কিন্তু কী বলবে এখন সে! কোনো উত্তরই দিতে পারছে না অথবা চাচ্ছে না জামিল। জামিল বোবার মত হয়ে গেলো। মুখে কোনো কথা নেই। এভাবে অনেক সময় পার হয়ে গেলো।

অবশেষে লন্ডন থেকে বড় ভাইয়ার ফোন আসল। ফোন হাতে নিয়ে কিছু বলার সাহস নাই তার। সে নিশ্চুপ। বড় ভাই তা দেখে আঁচ করলেন  হয়তো ফেল করেছে জামিল। এমনটি অনুমান করে সে অবশেষে বলে রেজাল্টের কথা। কিন্তু তার বলার ধরনটা উনার কাছে অন্যরকম মনে হলো। তাই সরাসরি মাদরাসার প্রিন্সিপাল স্যারের নিকট তিনি ফোন করলেন। প্রিন্সিপাল স্যারের কাছ থেকে জামিলের কথার সত্যতা পাওয়া গেলো। ফলে উনি কিছুটা স্থির হয়ে বিকালে আবার বাসায় কল করলেন। জামিলের তো টেনশনে জান যায় যায় অবস্থা।

কি হবে এই রেজাল্ট দিয়ে! সবাইকে সে বলেছিলো তার রেজাল্ট এবার এমন এমন হবে, কিন্তু যা হলো তা সম্পূর্ণ বিপরীত। কল্পনাতীত।

ভাইয়া তাকে বললেন, যে রকম আশা ছিল সেরকম হয় নাই কিন্তু অল্প সময়ে তোমার এতটুকু অর্জনই কম না, অনেক বেশি। এইসব বলে তাকে সান্ত্বনা দিলেন এবং আরো বললেন আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা চাই, তিনি না চাইলে তো তোমাকে আরো খারাপ রেজাল্ট পেতে হত, তাই মন খারাপের কোন সুযোগ নেই। ভাইয়া অনেকক্ষণ বুঝালেন। উনার কথাগুলো শুনে সাময়িক কিছু স্বস্তি পেলেও মনের মধ্যে কারো কোন সান্ত্বনা কাজে আসছে না তার।

এভাবে দিন শেষ হয়। সন্ধ্যা নামে। মাগরিবের পর নিউজের পাতায় চোখ পড়তেই আঁতকে উঠে জামিল। “এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার দরুণ সুমনা নামের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা!”

শিরোনামটি পড়ে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে গেল তার। এরপর সে ভাবে, হায়! আমিও তো ওর মত অকৃতকার্য হতে পারতাম। তখন কি হত আমার! চমকে উঠে সে। নিজের মধ্যে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করে সে ভাবে, যা হইছে ভালোই হইছে। আলহামদুলিল্লাহ! নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করে সে।

এর খানিক পরই প্রিন্সিপাল স্যারের কল বেজে উঠে তার মোবাইলে। তিনি ফোন করে জামিলকে রেজাল্টের জন্য অভিনন্দন জানালেন এবং সান্ত্বনা দিলেন। একই সাথে বিভিন্ন রকম যুক্তিযুক্ত আলোচনার মাধ্যমে প্রিন্সিপাল স্যার তার হৃদয়ের অস্থির যখমে শান্তির প্রলেপ দিলেন। তার জন্য দোয়া দিয়ে বললেন, সফল হতে হলে যে জিপিএ ফাইভই পেতে হবে তা নয়। অনেক জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তরাও তো রাস্তায় বেকার ঘুরে। তাদের জিপিএ ফাইভ তাদের লাইফের কোনো উন্নতি সাধন করতে পারে না।  অনেক সফল ব্যাক্তিদের পরীক্ষার রেজাল্ট তেমন ভালো ছিলো না। কিন্তু জীবনে অনেক কিছু অর্জন করতে পেরেছেন তারা। যা জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তরাও পারেনি। তাই মন খারাপের কিছু নাই, মেহনত চালিয়ে যাও। তিনি অনেক কিছু বুঝিয়ে বললেন, জামিল! আমি দেখতে পাচ্ছি তোমার মাঝে অনেক ঈর্ষনীয় প্রতিভা লুকিয়ে আছে। যা এক দিন এই সমাজ ও ইসলামের বড় বড় খেদমতে কাজে আসবে। জীবনের ভবিষ্যৎ খাতায় এখনো তোমার জন্য অনেক বড় বড় সফলতা অপেক্ষা করছে , ইনশাআল্লাহ। তুমি এগিয়ে যাও।

প্রিন্সিপাল স্যারের এই কথাগুলো শুনে হৃদয়ে প্রশান্তি পায় জামিল। নিজের মাঝে অনেক শক্তি অনুভব করে সে। আবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। সংকল্প করে মেধার বহুমুখী বিকাশ সাধন করে নিজেকে পূর্ণরূপে গড়বে সে। আরো ভালোভাবে পড়াশুনা, আরো ব্যাপক মেধার চর্চায় সে নিজেকে আবার নিয়োজিত করবে।

জামিল প্রিন্সিপাল স্যারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলে স্যার, দোয়া করবেন। আপনার প্রেরণা আর নির্দেশনা থাকলে আমি বহুদূর যেতে পারব ইনশাআল্লাহ!


লেখক: হোসাইন আল আমিন,
ধনকান্দি, শাহপরাণ, সিলেট।