চরম দুর্ভোগে পরিবহন শ্রমিক: হদিস নেই শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

মে ০৩ ২০২০, ২১:৪৬

স্টাফ রিপোর্টার: করোনা ভাইরাস সংক্রমণে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে সারা দেশের প্রায় ৭০ লাখ পরিবহন শ্রমিকের। অথচ শ্রমিকের কাছ থেকে কল্যাণ তহবিলের নামে প্রতিদিন ৭০ টাকা করে চাঁদা আদায় করেছে মালিক সমিতি। সেই তহবিলে বছরে জমা হওয়া প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, এই টাকার কোনো হিসাব নেই।

বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জর্জরিত পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। তারা পরিবহন খাতের চাঁদাবাজিতে মিলেমিশে একাকার। ফলে শ্রমিকদের ভয়াবহ দুর্দিনেও পাশে নেই শাজাহান খান, মসিউর রহমান রাঙ্গা, শিমুল বিশ্বাস, ওসমান আলীর মতো পরিবহন খাতের হেভি ওয়েট নেতারা। জানা গেছে, সব মিলিয়ে সারা দেশের ৮ লাখের বেশি বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে দৈনিক ৭০ টাকা হারে চাঁদা আদায় হয় মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নামে। এ হিসাবে বছরে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা আদায় হয়। এর বাইরে অঘোষিত নামে বেনামে অনেক চাঁদা আদায় হয়। এই রহস্যময় চাঁদার হিসাবও অজানা।

ফলে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে বেকার হয়ে পরা শ্রমিকদের এখন ত্রাহি অবস্থা। শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের নামে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা চাঁদা আদায় হলেও করোনার চরম দুর্দিনে শ্রমিকদের পাশে নেই নেতা নামধারীরা। আরো জানা গেছে, যে ৭০ টাকা চাঁদা আদায় হয়, তা ভাগাভাগি করে নেন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতারা। এর মধ্যে ৪০ টাকা নেয় মালিক সমিতি আর ৩০ টাকা নেয় শ্রমিক ইউনিয়ন। মালিক সমিতিগুলো বহু ভাগে বিভক্ত হলেও মূল সংগঠনের কান্ডারি জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গা, আওয়ামী লীগের নেতা ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। আর শ্রমিক সংগঠনগুলোর একক কর্তৃত্বে রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। তার সঙ্গী বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। ওই চাঁদার বাইরেও ঢাকাসহ ছোট-বড় শহরগুলোতে গেটপাস (জিপি) নামে বিপুল অঙ্কের চাঁদা তোলা হয়।

এ ছাড়া দূরপাল্লার সড়কপথে কেউ বাস নামাতে চাইলে মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায় করে বিভিন্ন জেলা মালিক-শ্রমিক সমিতি। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, কল্যাণ তহবিলের নামে চাঁদা তুলে তা আত্মসাৎ করেছেন মালিক ও শ্রমিক নেতারা। এতো অপকর্ম করেও শ্রমিকদের দুরবস্থায় পাশে নেই কেউ। এর পরও কিন্তু শ্রমিকরা গাড়ি পাহারা দিচ্ছে।

অথচ নেতারা পরিবহন খাতে ভয়াবহ লুটপাট করেছেন। এখন শ্রমিকরা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেক পরিবহন মালিকের হাজারো গাড়ি আছে। তারা অঢেল সম্পদের মালিক হলেও শ্রমিকদের জন্য কিছুই করছেন না। তারা সব সরকারের আমলেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আবদুল ওয়াদুদ নয়ন অভিযোগ তুলে বলেন, শ্রমিকরা এখন সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় আছেন। এক জায়গার শ্রমিক এখন আরেক জায়গায় গাড়ি নিয়ে গিয়ে আটকা পড়েছেন। তাদের কেউ ত্রাণও দেয় না। এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের সরকার সরাসরি কোনো ত্রাণ দেয়নি। দু-এক জায়গায় বিচ্ছিন্ন ভাবে আমাদের অনুরোধে দেওয়া হয়েছে। আর মালিক সমিতি ৭০ টাকা করে কল্যাণ তহবিলের নামে যে চাঁদা আদায় করত, তা নিজেরাই লুটে নিয়েছে।বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাধারণ সম্পাদক ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান বলেন, পরিবহনসহ সব খাতের শ্রমিকদের অবস্থা খুবই দুঃখজনক। আগে রাস্তায় ভিক্ষুক কম ছিল, কিন্তু করোনা ভাইরাসের এই চরম দুর্দিনে সবখানে ভিক্ষুকের আহাজারি। শ্রমিকরা এখন খুবই অসহায়। তাদের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা দেওয়ার প্রস্তাব করেছি। তবে শ্রম মন্ত্রণালয়ের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে চরম অভাব-অনটনে থাকা পরিবহন শ্রমিকদের কাজে আসছে না।

আইন অনুযায়ী, সারা দেশে সক্রিয় ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন কর্মকান্ডের মাধ্যমে অর্জিত মুনাফার ৫% শ্রমিক কল্যাণে খরচ করতে হবে। আর লভ্যাংশের একটি নির্দিষ্ট অংশ সরকারের বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিলে জমা দিতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় তহবিলে এখন ৪০০ কোটি টাকার বেশি জমা রয়েছে। আইনি বিধিবিধান না থাকায় করোনা ভাইরাসের সময় শ্রমিকদের কল্যাণে ওই অর্থ খরচের সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে শ্রম মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে শ্রম মন্ত্রণালয়ের শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত সচিব ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে অনুদান দেওয়ার আইনি বিধিবিধান নেই। এই তহবিল থেকে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি দিক বিবেচনা করে শ্রমিকদের অর্থ প্রদান করা হয়। তবে চিকিৎসার জন্য কোনো শ্রমিক আবেদন করলে টাকা দেওয়া হবে। বিআরটিএর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত যানবাহন আছে প্রায় ৪৪ লাখ। এসব পরিবহনের সঙ্গে প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক যুক্ত আছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ২৬ মার্চ থেকে সারা দেশে পরিবহন চলাচল বন্ধ। তবে কিছু পরিবহন চলছে। এর মধ্যে রয়েছে পণ্যবাহী যান, অল্পসংখ্যক ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল।

পরিবহন মালিক সমিতিগুলো বলছে, নজিরবিহীন এই পরিবহন সংকটে দৈনিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন আইন অনুসারে, পরিবহন শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়া বাধ্যতামূলক। আর তাদের বেতনও হওয়ার কথা মাসিক, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বাস-ট্রাকের চালকদের অধিকাংশই দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন। অল্প কিছু বড় কোম্পানি বাসচালকদের মাসিক বেতন দেয়। তবে তাদের মূল আয় হয় ট্রিপের (যাত্রা) ওপর। অন্য বাণিজ্যিক যানের শ্রমিকদেরও একই চিত্র। জানা গেছে, দেশে পণ্য পরিবহনের যানবাহন আছে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। এর মধ্যে আছে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রেইলর, পিকআপ ভ্যান। আবার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে যাত্রী পরিবহনের বাস-মিনিবাস আছে ৮০ হাজারের বেশি। পণ্যবাহী পরিবহনগুলোতে চালকসহ কমপক্ষে ২ জন শ্রমিক থাকেন। আর যাত্রীবাহী যানে চালক, সহকারী ও ভাড়া আদায়ের জন্য ৩ জন করে।