গুজব প্রতিরোধে কোরআনের দিক-নির্দেশনা

একুশে জার্নাল

একুশে জার্নাল

জুলাই ১৩ ২০১৯, ১৮:৫৬

হুসাইন আহমদ বাহুবলী:

নবীপত্নী হযরত জুয়াইরিয়া রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহার পিতা হযরত হারিস বনী মুসতালিক গোত্রের নেতা ছিলেন। নবীজির দরবারে এসে ইসলাম গ্রহণ করলেন। নবীজি তাঁকে পাঁচ ওয়াক্ত নামায এবং যাকাত আদায়ের জন্য তার খান্দানের লোকদেরকে উৎসাহিত করতে বললেন।

তিনি বললেন- নবীজি আমি যাচ্ছি আমার এলাকায় লোকজনের কাছ থেকে যাকাতের উট-দুম্বা সংগ্রহ করে রাখবো, এগুলি বায়তুল মালে জমা দেয়ার জন্য আপনি কখন লোক পাঠাবেন?

নবীজি একটি তারিখ নির্ধারণ করলেন আগামী মাসের ১ তারিখে। তিনি তার বাড়িতে গিয়ে এলাকার লোকজনকে নামাজের বিধান বলে সাথে সাথে যাকাত আদায় করতে হবে এই মর্মে বুঝিয়ে বললেন। সকলেই যাকাত দিতে উদ্বুদ্ধ হলো। তিনি অপেক্ষা করতে থাকলেন। আগামী মাসের ১ তারিখে যাকাত সংগ্রহকারী আসবেন। তার হাতে যাকাতের সমুদয় সম্পদ তুলে দেবেন। মাসের প্রথম তারিখে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য গ্রামের বাইরে মরুভূমির পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন। প্রথম দিন কাউকে আসতে দেখা গেল না, দ্বিতীয় দিনও কাউকে আসতে দেখা গেল না। গ্রামবাসী মনে করল তৃতীয় দিনে অবশ্যই তারা আসতে মিস করবেন না। তাই গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা-নারী-পুরুষ নবীজির দূত এবং নিজেদের মেহমানদের শুভেচ্ছা স্বাগতম জানানোর জন্য গ্রামের বাইরে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।

হঠাৎ করে একজন বললেন- ওই দেখা যায় কারা যেন ঘোড়া দৌড়িয়ে আসছেন। আনন্দে আত্মহারা, আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে চোখ বুজে আনন্দের গান গাইছিলেন সবাই। এদিকে নবীজি হযরত ওলীদ বিন উকবা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিলেন। তারা যখন বনী মুস্তালিক গোত্রের কাছাকাছি চলে আসলেন; হঠাৎ করে শুনতে পেলেন কে যেন বলছে- আমরা কোথায় যাচ্ছি ওই দেখো গোত্রের লোকেরা আমাদের সাথে পূর্বশত্রুতার জের ধরে লড়াই করার জন্য রণ প্রস্তুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে!

সত্যি তারা দেখলেন গ্রামের বাহিরে লোকজন সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তারা চিন্তায় পড়ে গেলেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলেন। কি করব এখন?
এমন সময় ওলীদ ইবনে উকবা রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু বললেন না আমরা আর সামনে এগুতে পারি না।
নবীজির কাছে আমরা নালিশ করব। তারা ফিরে গেলেন নবীজির কাছে। গিয়ে বললেন বনী মুসতালিক গোত্রের লোকেরা গাদ্দারী করেছে। প্রতারণা করেছে। আমাদেরকে যাবার জন্য আহবান করে রণ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। নবীজি অত্যন্ত মর্মাহত হলেন। রাগান্বিত হলেন। তাহলে কি তারা আমাদেরকে ধোঁকা দিয়ে বোঁকা বানিয়ে আমাদের লোকদের হত্যা করার জন্য পায়তারা করছিল?
নবীজী সাথে সাথে ওলীদ বিন উকবা রা. -কে বললেন, আপনি আর প্রতি দলের নেতা হতে পারবেন না। এখন থেকে এদের মোকাবেলায় জিহাদ পরিচালনা করা হবে। যুদ্ধ হবে, যুদ্ধ! সেনাপতি হবেন খালিদ বিন ওলীদ। প্রস্তুতি গ্রহণ করো। হযরত খালিদ বিন ওলীদ প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। জিহাদের প্রস্তুতি নিতে কিছু সময় লাগে। কারণ অনেক অস্ত্রের প্রয়োজন, অনেক রসদের প্রয়োজন হয়। শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়। এজন্য তাদের একদিন সময় লেগে গেল।

অপরদিকে বনী মুস্তালিক গোত্রের লোকেরা কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে আনন্দ নাচের পর যখন আবার কাউকে দেখতে পাচ্ছে না। তারা চিন্তায় পড়ে গেলেন! কি হলো আমাদের মেহমানদের? তারা কি রাস্তা হারিয়েছেন? বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারা যখন দেখলেন যে না, আর মেহমান দেখা যাচ্ছে না, বুঝতে পারলেন আমাদের মেহমানরা হয়তো কোন কারণে ফিরে গেছেন। এখানে হয়তো কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।
তারা তিন জনের একটি প্রতিনিধিদল নবীর কাছে পাঠালেন। তারা সবেগে ঘোড়া দৌড়িয়ে নবীজির দরবারে হাজিরা দিলেন। জোহরের নামাজের সময় তারা গিয়ে দেখলেন সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে জিহাদের সাজ সাজ রব। সকলেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তারা ভাবতেও পারেননি এই যুদ্ধ যে, তাদের সাথে করার জন্য সাহাবায়ে কেরাম তৈরি হচ্ছেন।
বনু মুস্তালিক গোত্রের প্রতিনিধিদল দেখে সাহাবীরা উত্তেজিত হয়ে গেলেন। বলতে শুরু করলেন তোমরা আবার এসেছো? প্রতারণা করেছো, গাদ্দারী করেছো আবার এখানে এসেছো?
তারা সমস্বরে বলে উঠলেন, আস্তাগফিরুল্লাহ নাউজুবিল্লাহ মিন জালিক। আমরা কস্মিনকালেও এমন প্রতারণা করতে পারি না। এমন গাদ্দারী করতে পারি না। আমরা তো আমাদের বহু প্রতীক্ষিত মেহমানদের অভ্যর্থনা দেওয়ার জন্য, শুভেচ্ছা স্বাগতম জানানোর জন্য গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা, নারী-পুরুষ সকলেই আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে মাঠে সারিবদ্ধ হয়ে ছিলাম। আপনাদের কে সম্মান জানাবার জন্য।

আমরা একদিন, দুইদিন, তিনদিন অপেক্ষা করে যখন আপনাদের দেখা পেয়েছিলাম আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলাম। এই ফাঁকে আপনারা কখন যে আমাদেরকে পিঠ দিয়ে চলে আসলেন আমরা বুঝতেই পারিনি। সাহাবায়ে কেরাম সন্দেহ করলেন, তারা পিঠ বাঁচাবার জন্য এই কথা বলছে কি না! নবীজি চিন্তায় পড়ে গেলেন। যেহেতু তিনি আলেমুল গাইব ছিলেন না।

এই আলাপচারিতায় অনেক সময় চলে গেল। আসরের সময় হয়ে গিয়েছে। হযরত বেলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু নামাজের সময় হয়ে গেলে নামাজ কায়েমের জন্য নবীজিকে আহবান করতে এসেছেন।
এমন সময় দেখলেন নবীজির উপর একটা বিশেষ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, যা সাধারণত ওহী নাযিল হবার সময় হয়ে থাকে। তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ পর নবীজি এই আয়াত তিলাওয়াত করলেন,
يا ايها الذين امنوا ان جائكم فاسق بنبأ فتبينوا ان تصيبوا قوما بجهاله فتصبحوا على ما فعلتم نادمين-
حجرات٦
হে ঈমানদারগণ! যদি কোন পাপিষ্ঠ তোমাদের কাছে কোন খবর রটায়, তাহলে তোমরা তাৎক্ষণিকভাবে তা যাচাই করবে। তা না হলে, তোমরা এমন কাজ করে বসবে যাতে নিজেরাই লজ্জিত হতে হবে। (হুজুরাত ৬)

বর্তমান সময়ের আলোচিত, সমালোচিত বিষয় হচ্ছে পদ্মা সেতুর কল্লা চাওয়া। অনলাইনে-অফলাইনে সমান হারে রটে চলেছে- পদ্মা সেতু কল্লা চায়। যে কারণে তা আতঙ্কের বিষয় হয়ে গিয়েছে। আমরা আমাদের সন্তানদেরকে মাদ্রাসা-স্কুলে পাঠাতে ভয় পাচ্ছি।
আমরা কেউই যাচাই করিনি একটা সেতু কেন কল্লা চাইবে ? রাজমিস্ত্রি-নির্মাণ কর্মীরা মানুষের মাথা দিয়ে কি করবেন? আমরাও তো কিছু কিছু নির্মাণ কাজ করি। আমাদের আশপাশেও তো সেতু নির্মাণ হয় কোথাও তো মানুষের মাথার প্রয়োজন হয় না। তাহলে পদ্মা সেতু মানুষের মাথা চাইবে কোন যুক্তিতে?

আমি নিজেই একটি পোস্ট পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে পোস্টদাতা একটি নির্মাণ কাজের চিত্র দিয়েছেন। যেখানে দেখা যায় নির্মাণ কর্মীরা ঢালাই ছাড়ার আগে মাঠের মধ্যে পলিথিন বিছিয়ে রেখেছেন। এর উপর রক্ত ছড়ানো! ক্যাপশনে লেখা আছে পদ্মা সেতুর নির্মাণে চীনা কর্মীরা তাদের ধর্মবিশ্বাস অনুপাতে পশুর রক্ত ঢেলে দিচ্ছেন। আমি তা দেখে ভাবছিলাম হয়তো গুজবের উৎসটা এখানেই। কিন্তু যখন গভীরভাবে চিন্তায় নিমগ্ন হলাম। তখন দেখলাম এই চিত্র কোন উঁচু স্থানের। শুকনা জায়গার।
ভাবলাম পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ তো হচ্ছে এমন স্থানে যেখানে যেমন উঁচু স্থান হওয়ার সম্ভাবনা নেই তেমন সম্ভাবনা নেই শুকনো স্থান হওয়ারও।

দ্বিতীয়তঃ ভাবলাম চীনা কর্মীরা তো বৌদ্ধ হওয়ার কথা। ওরা বিশ্বাস করে জীব হত্যা মহাপাপ। তাহলে তারা পশু হত্যা করে রক্ত দেবে তাদের ধর্ম বিশ্বাস অনুসারে এটা কেমন করে হতে পারে?

সুতরাং আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে, এটা ফটোশপের কাজ ।
সুতরাং আমরা যদি কোন কাহিনী, কোন ঘটনা শোনার সাথে সাথে একটু চিন্তা করি তাহলে আশা করি আর গুজব তৈরি হবে না। কোরআনের এই নির্দেশনা মানলে আমাদেরকে আর কোন কষ্টে নিপতিত হতে হবে না।

বর্তমান সময়ে মা সন্তান নিয়ে যখন কোন বাজার-হাট দিয়ে অতিক্রম করেন। বাবা তার সন্তান নিয়ে যখন রিকশায় চড়েন। তখন অতি উৎসাহিত জনতা ছেলে ধরার মানুষ বলে তাদেরকে হেনস্থা করছে। মানুষ ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে সদুত্তর দিতে পারে না। যে কারণে সন্দেহ আরও ঘনিয়ে আসে। কোন কোন সময় দেখা যায় ভারসাম্যহীন ব্যক্তির উপর যখন এই অপবাদ দেওয়া হয় তখন তো তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। তার পক্ষে কোন উত্তর দেওয়ার সুযোগ থাকে না, সম্ভব হয় না।
মানুষ মনে করে সত্যিই এই লোকটা ছেলে ধরার জন্য এসেছিল। মানুষের মাথা কেটে নেয়ার জন্য এসেছিল। এইভাবে বিনা যাচাই-বাছাই আমরা কোন পথিকের পথ রোধ করতে পারি না। কাউকে অপমান করতে পারি না।

কোরআন আমাদেরকে সেই শিক্ষাই দেয়। তাই আসুন কোরআনের দিকনির্দেশনা মানি। যে কোনো ঘটনা-কাহিনী শুনে উত্তেজিত না হয়ে, ঠান্ডা মাথায়, শীতল মস্তিষ্কে একটু যাচাই বাছাই করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। অামীন।